শহিদ দিবসে মুক্তিযোদ্ধার কলম থেকে (র ফাইল / আনএডিটেড)

শহিদ দিবসে মুক্তিযোদ্ধার কলম থেকে (র ফাইল / আনএডিটেড)

দেবেশ চন্দ্র সান্যাল :: আমি একজন কিশোর বীর মুক্তিযোদ্ধা। আমার নাম দেবেশ চন্দ্র সান্যাল। ১৯৭১ সালের ২৬মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জণ পর্যন্ত আমাদের দেশে সশস্ত্র মহান মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। ১৪ মে’৭১ স্বাধীনতা বিরোধীদের সহযোগিতায় পাবনা জেলার ডেমরা,(বাউসগাড়ী, রুপসী) গ্রামে গণ হত্যা হয়। এই গণ হত্যায় আমার দুই দাদা সহ সাত শতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশু প্রান হারান। পোঁতা জিয়া গ্রামের মো: মাহতাব উদ্দীন সরকারের সহযোগিতায় শাহজাদপুরের গৌরকুন্ডু, প্রানগোপাল সাহা সহ অধিকাংশ হিন্দুদের বাড়ি ঘর ও দোকান লুটপাট ও অগ্নি সংযোগ করা হয়। আমাদের গ্রামের মুসলমানেরা খুব ভাল। আমাদের গ্রামের একজন মানুষও স্বাধীনতা বিরোধী ছিলেন না। জাতির ক্রান্তি কালে প্রতিবেশী মুসলমানেরা আমাদের নিরাপত্তা দিয়ে ছিলেন। জাতির পিতার স্বাধীনতা ঘোষনা ও যার কাছে যা কিছু আছে তাই নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহনের আহ্বানের কথা জানতে পেরে আমি দেশের ক্রান্তি কালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলাম। প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র নিয়ে পকিস্তানি সৈন্য ও তাদের এদেশিয় দোসরদের বিরুদ্ধে গেরিলা/সম্মুখ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করার উদ্দেশে যাত্রা করার দিন টি ছিল ২৩ জুলাই’৭১ (৬ শ্রাবণ ১৩৭৮) শুক্রবার। রাত ৯ টায় আমি শাহজাদপুরের তদানীন্তন এম.পি.এ জনাব মো: আব্দুর রহমান স্যারের সাথে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য ভারতের উদ্দেশে রওনা হলাম। আমরা এক সাথে ২২ জন রওনা হলাম। পাকিস্তানি হানাদারেরা ২৫ মার্চ’৭১ রাত ১১-০০ টার পর “অপারেশন সার্চলাইট” পরিকল্পনা করে বিশ্বের জখন্নতম জ্বালাও, পোড়াও ও হত্যা সহ বিভিন্ন মানবতা বিরোধী কাজ শুরু করে ছিল। তখন পর্যাক্রমে সারাদেশের অধিকাংশ স্থান পাকিস্তানি হানাদারদের দখলে চলে যায়। ২৭ মার্চ’৭১ ঢাকা ও অন্যান্য শহর থেকে আমাদের এলাকার চাকরি জীবি কোনো রকমে প্রান নিয়ে এলাকায় ফিরে আসেন। তাঁদের মুখ থেকে পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের এদেশীয় দোসরদের মানবতা বিরোধী জঘন্যতম বর্বতার কথা শুনতে পারি। টিক্কা খানের প্রলোভনে ৭০-এর নির্বাচনে পরাজিত আমাদের দেশের জামায়াতে ইসলামী সহ ইসলামী অধিকাংশ রাজনৈতিক দল তাদের সহযোগি হয়েছে। এ দেশীয় দোসরদের নেতৃত্বে সারা দেশে পাকিস্তানি সৈন্যদের সহযোগিতা করার জন্য পিচ কমিটি, রাজাকার, আল-বদর,আল-শামস ও অন্যান্য বাহিনী গড়ে উঠেছে। সারাদেশে পাকিস্তানি সৈন্যরা জ্বালাও,পোড়াও, লুটতরাজ, হত্যা, গণহত্যা নারী নির্যাতন, ধর্ষণ সহ বিভিন্ন মানবতা বিরোধী কাজ করে চলেছে। পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রধান টার্গেট ছিল এদেশের হিন্দুরা। পাকিস্তানি হানাদারেরা এদেশের হিন্দুদের খুঁজে বের করার জন্য মানুষকে জিজ্ঞেস করতো। মালাউন কাহা হ্যায়। পুরুষ কাউকে ধরলে বলতো-তুম মুসলিম হ্যায় ? কলেমা বাতাও। উলঙ্গ করে হিন্দু মুসলমান পরীক্ষা করতো। পাকিস্তানি সৈন্যদের সহযোগিতা করছে এদেশের বিভিন্ন স্বাধীনতা বিরোধীরা। আমি মুক্তিযুদ্ধে গেলে নিশ্চিত মারা যাব। এই ভেবে বাবা-মা কিছুতেই মুক্তিযুদ্ধে যেতে সম্মতি দিতেন না। তাই বাবা-মা ও পরিবারের অন্য কাউ কে না জানিয়ে ভারতের উদ্দেশে রওনা হলাম। রওনা হওয়ার আগে মাকে একটা চিরকুট লিখলাম। “মা, প্রনাম নিও, বাবাকে আমার প্রনাম দিও। বড় দাদা, মেজদাদা, ও বৌদিকে প্রনাম দিও। ছোট ভাই বোনকে আশীর্বাদ দিও। আমি মুক্তিযুদ্ধে গেলাম। তোমাদেরকে বলে গেলে যেতে দিতে না জন্য না বলে চলে গেলাম। অপরাধ ক্ষমা করিও। আশীর্বাদ করিও। আমি যেন বিজয়ী হয়ে তোমাদের কাছে ফিরে আসতে পারি। ইতি- তোমার ছেলে দেবেশ।”

যাবার সময়ে বাড়ির কাউকে জানিয়ে যাইনি। আমরা সুজানগর সাত বাড়িয়া হয়ে পদ্মা নদী পাড় হয়ে কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর থানার চিলমারি ইউনিয়নের খারিজাথাক গ্রাম দিয়ে বাংলাদেশের বর্ডার অতিক্রম করলাম। আমরা ভারতের পশ্চিম বাংলার জলঙ্গী বর্ডার দিয়ে ভারতে ঢুকলাম। এম.পি.এ স্যার আমাদের কে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণের ভর্তির ব্যবস্থা করে দিয়ে তিনি অস্থায়ী প্রবাসী সরকারের উদ্দেশে কলিকাতা চলে গেলেন। আমি প্রথমে ভর্তি হলাম কামারপাড়া ইয়ুথ ক্যাম্পে। বয়সের স্বল্পতার কারণে প্রথম ট্রেনিং কর্তৃপক্ষ আমাকে ভর্তি করতে চাইলেন না। কয়েক দিন ভারতের বিভিন্ন আত্মীয় বাড়িতে ঘুরলাম। আবার ফিরে এলাম কামার পাড়া ইয়ুথ ক্যাম্পে। আমাকে ভর্তি করার জন্য বিশেষ অনুরোধ করলাম। কর্তৃপক্ষ আমার একটা ইন্টার ভিউ নিলেন। আমার দেশ প্রেম, সাহসী মনোভাব ও অন্যান্য শুনে ভর্র্তি করলেন। প্রাথমিক ট্রেনিং ক্যাম্পে শুধু আমাদের ফলইং করিয়ে জাতীয় সংগীত গাওয়ানো ও পিটি প্যারেড করানো হতো। কদিন কামারপাড়া ইয়ুথ ক্যাম্পে থাকার পর আমাকে, রবীন্দ্র নাথ বাগচী, রতন কুমার দাস ও মো: নজরুল ইসলাম কে ট্রান্সফার করলো মালঞ্চ ক্যাম্পে, তারপর মালঞ্চ থেকে কুড়মাইল ট্রানজিট ক্যাম্পে। কুড়মাইল থেকে আমাদের কে আনা হলো পতিরাম ক্যাম্পে। পতিরাম ক্যাম্প থেকে এক যোগে ভারতীয় আর্মি লরিতে ২০/২২ জন কে নিয়ে আসা হলো দাজিলিং জেলার শিলিগুড়ি মহকুমার পানিঘাটা নামক ইন্ডিয়ান আর্মি ট্রেনিং ক্যাম্পে। প্রশিক্ষণ শুরুর দিনে ট্রেনিং কো-অর্ডিনেটর প্রথমে ফলইন করিয়ে প্রশিক্ষণের বিভিন্ন নিয়ম কানুন বিষয়ে বললেন। তারপর তিনি বললেন দুপুর ১২-০০টায় প্রশিক্ষণ প্রধান ডি এস ভিলন স্যার আসবেন। ঠিক দুপুর ১২-০০টায় প্রশিক্ষণ প্রধান শিখ সেনা ডি এস ভিলন এলেন। তিনি আমাদের সকল কে উদ্দেশ্য করে বললেন-“... আপনাদের কে স্যালুট। আপনারা বীর, আপনারা আপনাদের দেশ মাতাকে হানাদার মুক্ত করতে যুদ্ধ করতে এসেছেন। আমরা আপনাদের জন্য তেমন কিছু করতে পারবো না। আমরা মানবিক সহায়তা, প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দিব। আপনাদের দেশকে আপনাদেরই স্বাধীন করতে হবে। আপনাদের জন্ম দাতা পিতা মাতাকে স্যালুট জানাচ্ছি। তাঁরা দেশের জন্য তাঁদের সন্তানদের কে মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়েছেন...। পানিঘাটা ট্রেনিং ক্যাম্প টি ছিল ভারতের দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ি মহকুমায় অবস্থিত। এই ক্যাম্পে টি ছিল ৭ নং সেক্টর অধীন। পানিঘাটা স্থান টি ছিল চারি দিকে পাহাড়ের মধ্যে। কার্শিয়ান পাহাড় হইতে নেমে আসা একটি ক্যানেলের দক্ষিণ পার্শ্বের বনাঞ্চল। চাঁন মারি স্থানের বামপাশে পাহাড় থেকে  নেমে এসেছে ঝর্ণার জল। ক্যাম্পে নিয়ে আমাদের তাবুর মধ্যে থাকার সিট করে দিল। আমাদের প্রত্যেক কে একটা মগ, একটা প্লেট, দুই টা প্যান্ট, ২টা গেঞ্জি, একটি মশারি, ও বিছানা পত্র দেওয়া হলো। ট্রেনিং শুরু হলো। আমাদের ২১ দিনের ট্রেনিং হলো। আমাদের কে থ্রিনট থ্রি রাইফেল, এল, এম,জি, এস,এল,আর, ষ্টেনগান, টুইঞ্চ মর্টার, হ্যান্ড গ্রেনেড চার্জ, এক্সপ্লোসিভের ব্যবহার, ফাষ্ট এইড সহ অন্যান্য ট্রেনিং দিলেন। যুদ্ধের রণাঙ্গণের সহযোদ্ধা আহত হলে বা শহীদ হলে করণীয় সর্ম্পকে এবং ফাষ্ট এইড সম্পর্কে ধারণা দিলেন। ভারতীয় কয়েক জন হিন্দু বিহারী ও শিখ সৈন্য প্রশিক্ষণ দিলেন। আমাদের কোম্পানীর। প্রধান প্রশিক্ষক ছিলেন শিখ সেনা ডি.এস. ভিলন। তাঁর এর কাছ থেকে জানলাম আমার এফ.এফ নং-৪৭৪২। ট্রেনিং শেষে আমাকে, রবীন্দ্র নাথ বাগচী, মো: নজরুল ইসলাম ও রতন কুমার দাসকে নিয়ে আসা হলো ৭ নং সেক্টরের হেড কোয়ার্টার কালিয়াগঞ্জ থানার তরঙ্গপুরে। তরঙ্গপুর এনে সিরাজগঞ্জ জেলার ১০ জনের সমন্বয়ে একটি গেরিলা গ্রুপ করা হলো। আমাদের গ্রুপের গ্রুপ লিডার হলেন বেলুকুচি উপজেলার তামাই গ্রামের এম.এ মান্নান। ডেপুটি লিডার নিযুক্ত হলেন শাহজাদপুর উপজেলার জামিরতা গ্রামের অধিবাসী বাবু রবীন্দ্র নাথ বাগচী। আমাদের কে তরঙ্গপুর থেকে অস্ত্র, গোলা-বারুদ, রেশনিং ও পকেট মানি দেওয়া হলো। আমার নামে একটি থ্রি নট থ্রি রাইফেল, এক ম্যাগজিন গুলি, একটি হেলমেট ইস্যু করা হলো। অন্যান্য গোলা বারুদ, মাইন,গ্রেনেড ও এক্সপ্লোসিভ কমান্ডার স্যারের কাছে দিলেন। মৃত্যু যে হবেনা এমন কোন গ্যারান্টি ছিল না। তাই আমি সনাতন ধর্মের রীতি অনুসারে যুদ্ধ জয়ের জন্য তরঙ্গপুর বাজার থেকে একখানা শ্রী শ্রী চন্ডী গ্রন্থ, মৃত্যু হলে লাশ জাতীয় পতাকা মোড়ায়ে জলে ভাসিয়ে দেওয়ার জন্য একটি বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত জাতীয় পতাকা ও  সংবাদ ও উদ্বিপণা মূলক  গান শোনার জন্য একটি ৪ ব্যান্ডের রেডিও কিনলাম। তরঙ্গপুর থেকে কালিয়াগঞ্জ পর্যন্ত বাসে এসে ট্রেনে উঠলাম। শিলিগুড়ি রেলওয়ে জংসন ষ্টেশনে এসে আমাদের ট্রেন বদলাতে হলো। ট্রেন বদলীয়ে আসাম গামী ট্রেনে উঠলাম। ভারতীয়রা আমাদেকে জয় বাংলার লোক বলতো। সরকারি বাস ও ট্রেনে টিকেট চাইতে এলে “জয় বাংলা” বললেই আর টিকেট বা ভাড়া চাইতো না। আসাম গামী ট্রেনে ধুবরী নামক ষ্টেশনে আমরা নামলাম। তারপর বাস যোগে মানিকার চর এলাম। রাত হয়ে যাবার কারণে রাতে মানিকার চর একটা বডিং এ থাকলাম। পরদিন সকালে নদী পার হয়ে এলাম তদানীন্তন রংপুর জেলার কুড়িগ্রাম মহকুমার (বর্তমানে জেলা) মুক্তাঞ্চলে স্থাপিত রৌমারী মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। রৌমারী ক্যাম্পে আমরা স্নান খাওয়া দাওয়া করলাম। আমাদের কমান্ডার স্যার সিরাজগঞ্জ জেলার মুক্তাঞ্চল যমুনার চড়ে পৌঁছানোর জন্য একটি বড় ছই ওয়ালা নৌকা ভাড়া করলেন। রৌমারী ক্যাম্প থেকে রাতের খাবার খেয়ে রাত ৯:০০ টার দিকে আমাদের নৌকা ছাড়লো। ইহা ছিল ৬ সেপ্টেম্বর’৭১। নৌকা বাহাদূরাবাদ ঘাট, জগন্নাথগঞ্জ ঘাট ও অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা দিয়ে আসতে হয়। আমরা জানতে পেরে ছিলাম। বাহাদূরাবাদ ঘাট অত্যন্ত ঝুঁকি পূর্ণ এলাকা। ঐ ক্যাম্পের পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকারেরা ভয়ানক। তারা স্পীড বোট নিয়ে রাতে নদী টইল দেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকা পেলে ধরে নিয়ে যায়। ক্যাম্পে নিয়ে অমানুষিক অত্যাচার করে নৃশংস ভাবে হত্যা করে। আমাদের কমান্ডার জনাব এম.এ মান্নান স্যার নির্দেশ দিলেন-”আপনারা সবাই নৌকার ডওরার মধ্যে পজিশন অবস্থায় থাকুন। পাকিস্তানি হানাদারেরা ধরতে এলে আমরা ধরা দিব না। যুদ্ধ করবো। যুদ্ধ করে শহীদ হবো কিন্তু ওদের হাতে ধরা দিব না”। রাত ২.০০ টার দিকে আমরা বাহাদূরাবাদ ঘাট এলাকা অতিক্রম করতে থাকলাম। ওদের সার্চ লাইটের আলো এসে বার বার আমাদের নৌকাতে পড়ছিল। ভগবানের কৃপায়-ওরা আর স্পীড বোট নিয়ে ধরতে এলোনা। আমরা বাহাদূরাবাদ ঘাট এলাকা অতিক্রম করলাম। আমাদের সাথে চিড়া গুড় ছিল। ভোরে মাঝিরা এক কাইসা খেতের মধ্যে নৌকা ঢুকিয়ে দিল। আমরা নীচে নেমে খেতের মধ্যে প্রস্রাব পায়খানা করলাম। আমাদের সাথে থাকা চিড়া ও গুড় দিয়ে সকালের জলখাবার খেলাম। তার পর নৌকা আবার ছাড়লো। তখন আমাদের নদী পথে আসার পথে অধিকাংশ এলাকা পাকিস্তানি হানাদারদের দখলে ছিল। কাজিপুর থানারও বিভিন্ন ঝুঁকি পূর্ণ স্থানের সম্মুখ দিয়ে আমাদের নৌকা আসবে। দেখে শুনে খোঁজ নিয়ে থামিয়ে থামিয়ে ৪ দিন ভরে নৌকা এসে পৌছালো সিরাজগঞ্জ হানাদার মুক্তাঞ্চল যমুনার চরে। ইহা ছিল টাঙ্গাইল জেলার সিংগুলির চড়ের নিকটবর্তী। নৌকাতেই রান্নার ব্যবস্থা ছিল। মাঝিরা কোন রকমে ডালভাত অথবা খিচুরী রান্না করে আমাদের খাওয়াতো। এই ভাবে খেয়ে না খেয়ে চলছিলাম। পরদিন রাতে যমুনা নদীর এপাড়ে চলে এলাম। চলে এলাম বেলকুচি-কামারখন্দ নির্বাচনী এলাকার এম.এন.এ জনাব মো: আব্দুল মোমিন তালুকদারের গ্রামের বাড়িতে। তিনি তখন বাড়িতে ছিলেন না। তাঁর ভাই মো: রশিদ তালুকদার আমাদের থাকা খাওয়া ও অন্যান্য বিষয়ে সহযোগিতা করলেন। অক্টোবর’৭১ মাসের মাঝা মাঝির আগ পযর্ন্ত আমাদের গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধা সংখ্যা কম থাকায় রেকি করে আমাদের কমান্ডার স্যার সম্মূখ যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন নি। আমরা পাকিস্তানি হানাদার সৈন্য ও তাদের দোসরদের আতঙ্কে রাখার  জন্য গেরিলা কার্যক্রম হিট এন্ড রান চালাতাম। পাকিস্তানি সৈন্য বা রাজাকার ক্যাম্পের নিকট বর্তী গিয়ে ২/৪ টা থ্রি নট থ্র্রি রাইফেলের আকাশ মুখি ফাঁকা গুলি ছুড়ে চলে আসতাম। পাকিস্তানি দালাল, পীচ কমিটির লোক ও অন্যান্যরা আমাদের অস্তিস্তের কথা জানতে পারতো। আমরা দিনের বেলা স্কুলে বা কারো বাড়িতে আত্মগোপন করে থাকতাম। মুক্তিযুদ্ধ কালীন সময়ে দেশের অভ্যন্তরে ছিল দুইটি পক্ষ। একটি স্বাধীনতার পক্ষে। অন্যটি স্বাধীনতার বিপক্ষে। স্বাধীনতার বিপক্ষের পীচ কমিটির সদস্য,রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও অন্যান্যরা। স্বাধীনতা বিরোধীরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ কারীদের তথ্য দিয়ে পাকিস্তানি সৈন্য নিয়ে এসে বাড়িঘরে অগ্নি সংযোগ, লুটতরাজ, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, নিপীড়ন, হত্যা, গণহত্যা ও অন্যান্য মানবতা বিরোধী কাজ করতো। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেওয়া বাড়ির মালিককে ধরে নিয়ে নির্যাতন ও হত্যা করতো। হিন্দু ও আওয়ামী লীগ নেতারা ছিল ওদের বড় টার্গেট। হিন্দু নারী পুরুষকে ধরে নিয়ে যেত। নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যা করতো। বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধারাও  পাকিস্তানি হানাদার পক্ষ ত্যাগ  করানোর জন্য ও তাদের সহযোগিতা না করার জন্য বিশেষ ভাবে অত্যাচারী পাকিস্তানি দালাল ও রাজাকারদের হত্যা করতো। আমাদের গ্রুপের নীতি ছিল- “আমরা আমাদের দেশী কোনো ভাই কে হত্যা করব না। বুঝিয়ে তাদের কে স্বাধীনতার পক্ষে আনবো” যে কারণে আমাদের মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ আমরা কোন স্বাধীনতা বিরোধীকে ধরি নাই, অত্যাচার বা হত্যা করি নাই। আমরা নিজেরা বা তাদের আত্মীয়ের মাধ্যমে বুঝিয়ে বিভিন্ন ভাবে স্বাধীনতা বিরোধীদের স্বাধীনতার পক্ষে আনার চেষ্টা করতাম। আমাদের বুঝানোর কারণে দৌলতপুর গ্রামের এক রাজাকারের মাধ্যমে বেলকুচি রাজাকার ক্যাম্পের ৫ জন সশস্ত্র রাজাকার অস্ত্র সহ পালিয়ে এসে আমাদের গ্রুপের কাছে আত্মসমর্পন করে ছিল। হাতে অস্ত্র থাকা শর্তেও আমরা প্রতিটি মুহূর্তে আতঙ্কে থাকতাম। যে কোন সময় পাকিস্তানি হানাদাররা আমাদের আক্রমন করতে পারে। আমাদের থাকা খাবার কোন নিশ্চয়তা ছিল না। আমরা আজ এ শেল্টারে কাল সে শেল্টারে থাকতাম। কোন শেল্টারেই একাধিক দিন থাকতাম না। কোন কোন দিন শেল্টারের অভাবে সারারাত চিড়া গুড় খেয়ে রাত্রি জেগে স্কুলের বেঞ্চে শুয়ে থাকতে হতো। গায়ে দেওয়ার লেপ কাথা ছিল না। মশার কামর থেকে রক্ষার জন্য মশারী ছিল না। অন্যান্য কি যে অমানবীয় কষ্ট। আমাদের শেল্টার পালা ক্রমে আমরা দুজন করে করে পাহাড়া দিতাম। প্রতি রাতে কমান্ডার স্যার আমাদের পাশওয়ার্ড দিতেন। স্থান পরিবর্তনের পর কমান্ডার স্যার মাঝে মাঝে কোনো কারণে শত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে,  আমরা কোথায় একত্রিত হবো তা নিদিষ্ট করে দিতেন। সাধারণত কোন শেল্টারে আমরা এক রাতের বেশী থাকতাম না। প্রতিরাতে শেল্টার পরিবর্তন করতাম। আমরা রাতে বিভিন্ন রাজাকারদের বাড়িতে গিয়ে তাদের বুঝাতাম। সকালে আমরা অস্ত্রে ফুল থ্রু মারতাম, পরিস্কার করতাম ও অস্ত্রে তেল দিতাম। তখন দেশের অধিকাংশ মানুষ ছিল স্বাধীনতার পক্ষে। তবুও স্বাধীনতা বিরোধীদের ভয়ে অনেকে আমাদের কে শেল্টার বা খাবার দিতে সাহস পেতেন না। কারণ অধিকাংশ গ্রামেই ছিল পাকিস্তানি দালাল ও রাজাকার। তারা খোঁজ জানলে পাশর্^বর্তী আর্মি বা রাজাকার ক্যাম্পে সংবাদ দিয়ে তাদেরকে নিয়ে এসে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিবে, বাড়ির মালিককে ধরে নিয়ে হত্যা করবে ও অত্যাচার চালাবে এই ছিল তাদের ভয়। আমাদের সাথে সব সময় চিড়া গুড় থাকতো। স্থানীয় কিছু আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ট্রেনিং দেওয়ায়ে আমাদের সাথে নিলাম। আমি মুক্তিযুদ্ধে যাবার কারণে আমার পিতৃদেব ও মাতৃদেবী পাগল প্রায় হয়ে গিয়ে ছিলেন। রাজাকারদের আলটিমেটামে গণহত্যার হাত হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য আমাদের বাড়িঘর সব কিছু গ্রামের মো: হোসেন আলীর তত্ত্বাবধানে রেখে গোটা পরিবার বাড়িঘর সবফেলে ভীষণ ঝুঁকি নিয়ে ভারতের আসামের মানিকার চড় শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়ে ছিলেন। কোথায় ও আক্রমণের পূর্বে আমরা রেকী করে দেখতাম। তারপর আক্রমন করতাম। আদের গ্রুপ ৩টি “হিট এন্ড রান” ১টি পাকিস্তানি হানাদার সৈন্য ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য এ্যাম্বুস ও ৩টি ভয়াবহ সম্মুখ যুদ্ধে অংশ গ্রহন করেছি। রণাঙ্গণের আমি মারা গেলে আমার লাশ নেওয়ার কোনো লোক ছিল না। আমাদের গ্রুপের গেরিলা/সম্মুখ যুদ্ধগুলো হলো :

০১। বেলকুচি থানা আক্রমণ যুদ্ধ : বেলকুচি সিরাজগঞ্জ জেলার একটি উল্লেখযোগ্য থানা। এই থানা আক্রমণ যুদ্ধে নেতৃত্বে ছিলেন গ্রুপ কমান্ডার জনাব এম.এ মান্নান স্যার। ২৪ অক্টোবর’৭১ কমান্ডার স্যারের ও আরো ৩ জনের রেকিতে একযোগে বেলকুচি থানা ও মুসলিমলীগ নেতা মোঃ আব্দুল মতিনের বাড়ি আক্রমন করলাম। সন্ধ্যায় বানিয়া গাতি শেল্টারে কমান্ডার স্যার বিস্তারিত ব্রিফ করলেন। আমাদের দুই গ্রুপে ভাগ করে দিলেন। সিদ্ধান্ত হলো কমান্ডার স্যারের নেতৃত্বে বড় গ্রুপটি থানা আক্রমন করবে। অন্য গ্রুপটি রবীন্দ্র নাথ বাগ্চীর নেতৃত্বে মতিন সাহেবের বাড়ি আক্রমন করে মতিন সাহেবকে ধরে আনবে। আমি কমান্ডার স্যারের গ্রুপে থেকে থানা আক্রমন যুদ্ধে অংশ নিলাম। রাত ৯ টায় বানিয়া গাতি থেকে যাত্রা করলাম। থানার কাছে গিয়ে দু গ্রুপ টার্গের উদ্দেশ্যে ভাগ হলাম। রাত ১২টায় একযোগে আক্রমনের সিদ্ধান্ত। পরিকল্পনা মোতাবেক থানার পশ্চিম পাশ দিয়ে স্ক্রোলিং করে থানার সামনে যেতেই সেন্ট্রি দেখে ফেললো। হুইসেল বাঁজিয়ে থানার সবাইকে জানিয়ে দিয়ে আমাদের কে লক্ষ্য করে গুলি করলো। আমাদের কমান্ডার স্যার কমান্ড করে ফায়ার ওপেন করলেন। আমরা সবাই একযোগে গুলি করলাম। এক ঘণ্টা ব্যাপি যুদ্ধ চললো।  ভয়া বহ যুদ্ধ মাথায় হেল মেট। দুইটি গুলি এসে হেলমেটে লাগলো। আমার ডান পার্শ্বে আমার কমান্ডার। আমাদের গ্রুপে২৭ জন।  হয় বিজয় আর না হয় মৃত্যু ছাড়া কোন পথ নাই। বৃষ্টির মত গুলি চালিয়ে যাচ্ছি। থানার বিহারী পুলিশ ও রাজাকার থানার পিছনদিক দিয়ে পালিয়ে সোহাগপুর নদীতে থাকা একটি লঞ্চে চড়ে আমাদের রেঞ্জের বাইরে যমুনার মধ্যে গেল। থানার সেন্ট্রি গুলি করা বন্ধ করে দুই হাত উপরে তুলে আত্মসমর্পণ করলো।
আমরা থানার ভিতরে ঢুকে পড়লাম। থানার মধ্যে গিয়ে দেখি ১জন পুলিশ ও ১জন রাজাকার গুলিতে মারা গেছে। আমরা থানার মাল খানা থেকে সকল গোলাবারুদ নিলাম। থানার দু’জন রাজাকারকে জ্যান্ত চোখ ও  হাত বেঁধে ধরে নিয়ে এলাম। রাজাকাররা যাতে আমাদের শেল্টার চিনতে না পারে সেই জন্য তাদের চোখ বেঁধে নিয়ে এলাম। ভোর হয়ে গেল। মতিন সাহেবের বাড়ি আক্রমন করা দলটিও এলো। মতিন সাহেব পালিয়ে গেছে। তাকে ধরা সম্ভব হয় নাই। থানার আশেপাশের লোকজন দোকান ও বাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দিল। বিজয়ী হয়ে চলে এলাম। পরদিন সিরাজগঞ্জ থেকে শতাধিক পাকি হানাদার ও রাজাকার এসে থানার আশে পাশে আগুন দিয়েছিল এবং মানুষদের নির্যাতন করেছিল। বেলকুচি থানা আক্রমণ যুদ্ধে আমরা ২ জন রাজাকার কে ধরে এনেছিলাম। কিছু সময় চোখ বেঁধে আমাদের শেল্টারে রেখে ছিলাম। তাদের কে চোখ বেঁধে পাশের রুমে রাখা হয়েছিল। আমি কমান্ডার স্যারের অনুমতি নিয়ে ওদের সাথে কথা বার্তা বললাম। তাদের কে রাজাকার হওয়ার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জিজ্ঞাস করলাম শুনলাম। ওদের সাথে জিজ্ঞাসা বাদে মনে হলো ওরা সহজ সরল ও অভাবী মানুষ। ওদের বাড়িতে স্ত্রী ও পুত্র কন্যা আছে। পীচ কমিটির লোকদের কথায় বিশ্বাস করে ওরা রাজাকার হয়েছে। ওরা মনে করে ছিল এটা একটা চাকুরী। উপার্জন করে সংসার পরিচালনার জন্য ওরা রাজাকার হয়েছে। তারা বলল আমরা কাউকে কোনো অত্যাচার করি নাই। কোনো বাড়িঘর লুটতরাজ করি নাই। পাকিস্তানি হানাদের নিয়ে এসে  কোনো গন হত্যা করি নাই। কোনো বাড়িতে আগুন দেয় নাই...। তাদের কথায় আমার মায়া হলো। আমি তাদের চোখ বাধা খুলে দিলাম। তাদের কে বিভিন্ন ভাবে বুঝিয়ে প্রতিজ্ঞা করালাম- “তারা আর রাজাকারে ফিরে যাবে না”। রাত্রিতে শেল্টার পরিবর্তনের সময় কমান্ডার স্যারে কে অনুরোধ করে রাজাকার দুই জনকে ছেড়ে দিয়ে ছিলাম।

০২। কালিয়া হরিপুর রেলওয়ে স্টেশন সংলগ্ন ব্রীজ পাহাড়ারত রাজাকার ক্যাম্প ও পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য অ্যাম্বুস : কালিয়া হরিপুর সিরাজগঞ্জ জেলার কামারখন্দ থানার একটি রেলওয়ে স্টেশন। এই এ্যাম্বুসের নেতৃত্বে ছিলেন গ্রুপ কমান্ডার জনাব এম.এ মান্নান স্যার। ৪ নভেম্বর’৭১ আমাদের গ্রুপের ঝাঐল গ্রামের সিরাজগঞ্জের এম,এন, এ জনাব মোঃ মোতাহার হোসেন তালুকদারের ভায়রা আওয়ামীলীগ নেতা জনাব মোঃ আব্দুল হামিদ তালুকদারের রেকির ভিত্তিতে কালিয়া হরিপুর রেলওয়ে ষ্টেশন সংলগ্ন ব্রীজ পাহাড়ারত রাজাকার ক্যাম্প অ্যাম্বুস করেছিলাম। কমান্ডার স্যার ক্রোলিং করে রেল লাইনে বৈদ্যুতিক মাইন বসিয়ে আসলেন। তথ্য ছিল ঈশ্বরদী থেকে পাকি হানাদার নিয়ে একটি ট্রেন সিরাজগঞ্জ যাবে। কমান্ডার স্যার ট্রেনটি উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করলেন। এই রাতে আমাদের পাসওয়ার্ড ছিল গোলাপ-জবা। পাকিহানাদের সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে বিছিন্ন হয়ে পড়লে আমরা একত্রিত  হবো কমান্ডার স্যারের গ্রামের বাড়ি তামাইতে। আমরা ধানক্ষেতের মধ্যে পজিশন অবস্থায় থাকলাম। কামান্ডার স্যারের হাতে মাইনের তার ও ব্যাটারী। টর্চ লাইট ও হ্যারিকেন হাতে পাকি মিলি শিয়া ও রাজাকারেরা টহল দিচ্ছিল। ওদের পায়ে লেগে হঠাৎ আমাদের মাইনের তার বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। মাইনটি ওদের নজরে পড়লো। হুইসেল দিয়ে রাজাকারদের লাইং পজিশনে রেডি থাকতে বললো। আমাদের দিকে টর্চ লাইট মেরে মেরে উর্দূতে বকাবকি করতে থাকলো। ইতিমধ্যে ঈশ্বরদী থেকে সিরাজগঞ্জ গামী পাকি হানাদার বাহী ট্রেন এলো। পাকি হানাদারেরা সিগন্যাল দিল। ষ্টেশনে ট্রেনটি থামিয়ে দিল। ট্রেনের পাকি হানাদারেরা অস্ত্র তাক করা অবস্থায় নেমে আমাদেরকে খুঁজতে থাকলো। আমাদের মাইনটি ব্রাষ্ট করা সম্ভব হলো না। পাকি হানাদারদের সংখ্যাধিক্যতায় ও অন্যান্য বিষয় বিবেচনা করে কমান্ডার স্যার উইথড্র হওয়ার কমান্ড করলেন। পরের দিন সিরাজগঞ্জ থেকে পাকি হানাদার ও রাজাকারেরা এসে কালিয়া হরিপুরের অনেক বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছিল এবং গ্রামের অনেককে ধরে নির্যাতন করেছিল। আমরা কালিয়া হরিপুর রেলওয়ে ব্রীজ সংলগ্ন রাজাকার ক্যাম্প এ্যাম্বুস থেকে ফিরে এসে তামাই গ্রামে কমান্ডার স্যারের বাড়িতে একত্রিত হই। কমান্ডার স্যারের মা আমাদের জন্য খাবার ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। আমরা কমান্ডার স্যারের বাড়িতে খাওয়া দাওয়া করলাম। খাওয়া-দাওয়ার পর আমাদের সবাইকে বসিয়ে কমান্ডার স্যার ব্রিফ করলেন। স্থানীয় ভাবে ট্রেনিং দেওয়া বেশ কিছু যুবককে আমাদের গ্রুপেভর্তি করা হয়েছিল। এত বড় প্লাটুন এক শেল্টারে শেল্টার নেওয়া সমস্যা। তাই কমান্ডার স্যার ডেপুটি কমান্ডার রবীন্দ্রনাথ বাগ্চী কে কমান্ডার করে আমাদের ১১ জনের আর একটি গ্রুপ করে দিলেন।

০৩। কল্যাণপুর যুদ্ধ : কল্যাণপুর সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি থানার একটি গ্রাম। এই যুদ্ধে নেতৃত্বে ছিলেন ডেপুটি কমান্ডার (কমান্ডার হিসাবে নিয়োগ প্রাপ্ত) বাবু রবীন্দ্র নাথ বাগ্চী। কমান্ডার স্যারের নির্দেশে আমরা ১১ জন রবীন্দ্র নাথ বাগ্চীর কমান্ডনাধীন হয়ে হেটে ভোরে বেলকুচি উপজেলার কল্যাণপুর নামক গ্রামে এক বাড়িতে আশ্রয় নিলাম। ৫নভেম্বর ’৭১ বাড়ির মালিক আমাদের সকালের খাবারের ব্যবস্থা করলেন। আমরা সারারাত নিদ্রাহীন থেকেও হেটে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। সকালের খাবার খেয়ে প্রকাশ্যে পিটি, প্যারেড করলাম। অস্ত্র পরিষ্কার করলাম। অস্ত্রে ফুলতুরী মারলাম। একজন করে ডিউটি করতে থাকলাম। অন্যান্যরা ঘুম বা রেষ্টে থাকলাম। কল্যানপুর একটি নিভৃত গ্রাম। আমাদের ধারনা ছিল এই গ্রামে পাকি হানাদার ও রাজাকার আসবে না। বেলা ১০টার দিকে সেন্ট্রিরত সহযোদ্ধা রতনকুমার দাস দৌড়ে এসে জানালেন আমদের কে ধরার জন্য বেলকুচি থানা থেকে কয়েকজন পাকি হানাদার মিলে শিয়া ও রাজাকার আসছে। বওড়া গ্রামের মধ্য দিয়ে কল্যানপুরের দিকে আসছে। দুইজন পাকিস্তানি দালাল গামছা দিয়ে মুখ বেধে নিয়ে হানাদার ও রাজাকারদের পথ চিনিয়ে নিয়ে আসছে। দূর থেকে অনুমান হলো এই দলে ৫জন মিলেশিয়া ও ৮জন রাজাকার আছে। আমাদের কমান্ডার যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। আমরা কল্যানপুরে রাস্তার ধারে বাংকারের মত বাঁশ ঝাড়ের মধ্যে পজিশন নিলাম। বাঁশ ঝাড়ের সামনে দিয়ে চলা রাস্তা ধরে ওরা আসছিল। আমাদের রেঞ্জের মধ্যে আসার সাথে সাথে আমাদের কমান্ডার রবীন্দ্রনাথ বাগ্চী কমান্ড ও ফায়ার ওপেন করলেন। এক লাফে হানাদারেরা রাস্তার উত্তর পার্শ্বে পজিশন নিল। ওরাও আমাদের লক্ষ্য করে গুলি চালালো। আমরাও একযোগে বৃষ্টির মতো গুলি ছাড়তে থাকলাম। গোলাগুলির শব্দ পেয়ে আশে পাশে অবস্থানকারী মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ আমাদেরকে সহযোগীতা করার জন্য এগিয়ে এলেন। এক ঘণ্টার অধিক সময় সম্মুখ যুদ্ধ চললো। তারপর পাকি হানাদারেরা লাশ নিয়ে পিছিয়ে গেল। এই যুদ্ধে ১জন মিলেশিয়া ও ১জন রাজাকার মারা গিয়েছিল। যুদ্ধে জয়ী হয়ে আমরা বিজয় উল্লাস করলাম। সকল স্তরের মানুষের আত্মবিশ্বাস দৃঢ় হলো। এক বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া করলাম তারপর হেঁটে দৌলতপুর গ্রামের সহযোদ্ধা মোঃ শামসুল হকের বাড়িতে শেল্টার নিলাম। কয়েক দিন দৌলতপুর, তেঞাশিয়া, খুকনী, বাজিয়ারপাড়া, দরগার চর ও অন্যান্য গ্রামে থাকতে থাকলাম।

০৪। ধীতপুর যুদ্ধ : ধীতপুর সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর থানার একটি গ্রাম। এই যুদ্ধে নেতৃত্বে ছিলেন ডেপুটি কমান্ডার (কমান্ডার হিসাবে নিয়োগ প্রাপ্ত) বাবু রবীন্দ্র নাথ বাগ্চী। ২৩ নভেম্বর’ ৭১ আমরা শেল্টার নিলাম সৈয়দপুর গ্রামের কালা চক্রবর্ত্তীর বাড়িতে। ২৫ নভেম্বর’৭১ সংবাদ পেলাম পাকি হানাদারেরা কৈজুরী হয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। টাঙ্গাইলের যুদ্ধে পাকি হানাদারেরা পরাজিত হয়ে লঞ্চে যমুনা নদী পাড় হয়ে মালিপাড়া ক্যাম্পে এসেছে। মালিপাড়া ক্যাম্প থেকে রাস্তা চিনানোর জন্য দুই জন রাজাকারকে সঙ্গে নিয়েছে। আমরা পাকি হানাদারদের আক্রমন করার জন্য ওদের পিছু নিলাম। ওরা ক্ষুধার্ত। কৈজুরী গ্রামের একজনের মুলা ক্ষেত থেকে মুলা খাওয়ার চেষ্টা করলো। ওরা হয়তো জানতো না কাচা মুলা খাওয়া যায় না। ওয়াপদা বাধ ধরে ওরা অগ্রসর হতে লাগলো। আমরাও নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে অস্ত্র তাক করে ওদের পিছু পিছু হাটতে থাকলাম। ওরা ভীষণ ক্রোধী ধীতপুর নামক স্থানে গিয়ে ওরা আমাদের দিকে অস্ত্র তাক করে গুলি করলো। আমরা জাম্প করে ওয়াপদা বাধের পশ্চিম দিকে পজিশন নিলাম। ওদের উপর গুলি ছুড়তে থাকলাম। ওরা ওয়াপদা বাধের পূর্ব পার্শ্বে পজিশন নিল। এক ঘণ্টা ব্যাপি গুলি ও পাল্টা গুলি চলতে থাকলো। গুলির শব্দে শাহজাদপুর ও বেড়া উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অবস্থানকারী মুক্তিযোদ্ধা দল আমাদের সহযোগিতা করার জন্য এগিয়ে এলেন। এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। সন্ধ্যার পর হানাদারেরা গুলি করা বন্ধ করলো। আমরাও অন্ধকারে গুলি করা বন্ধ করলাম। সারারাত আমরা পজিশন অবস্থায় ছিলাম। আমাদের গ্রুপটি ছিল বাবু রবীন্দ্র নাথ বাগচীর কমান্ডানাধীন। আমার বাম পাশের এল.এম.জি চালাচ্ছিলেন কমান্ডার রবীন্দ্র নাথ বাগচী। আমার ডান পাশের অন্যান্যরা। রাতে ধীতপুর সার গুদাম থেকে মাঝে মাঝে ২/১ টা করে গুলি আসছিল। ওদের গুলির প্রেক্ষিতে আমরা ২/১ টা করে গুলি করছিলাম। ভোরে ফর্সা হলে আমাদের কমান্ডার বরীন্দ্রনাথ বাগ্চী ও বেড়ার কমান্ডার জনাব আমির হোসেন ক্রোলিং করে ধীতপুর সার গুদামে এগিয়ে গেলেন। গিয়ে দেখতে পেলেন পাকিহানাদারেরা পালিয়ে গেছে। দুজন রাজাকার সারারাত কভারিং ফায়ার করেছে। কমান্ড করে রাজাকার দুজনকে স্যারেন্ডার করালেন। রাজাকার দুজনের নাম ছিল লতিফ ও কালাম। তাদের কাছ থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে নেওয়া হলো। তাদের কাছ থেকে জানা গেল রাত ১১ টার দিকে হানাদারেরা ক্রোলিং করে নিরাপদ দুরত্বে এসে হেঁটে বেড়া নদী পার হয়ে ঢাকা যাবার উদ্দেশ্যে পালিয়েছে। পরে জানা গেল। পাকি হানাদারেরা বেড়া ঘাটে গিয়ে ভেড়াকোলা গ্রামের হলদারদের নৌকায় নদী পাড় হয়ে বেড়া থানা সদরে গেছে। সেখান থেকে নগরবাড়ি ঘাট হয়ে ঢাকা যাবার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে। ধীতপুরের যুদ্ধে আমাদের সহযোদ্ধা বেড়ার আমির হোসেনের গ্রুপের মোঃ আব্দুল খালেক শহীদ হয়েছেন। স্থানীয় দুজন পথচারী গোলাগুলির সময়ে গুলি লেগে ওয়াপদা বাধের উপরে মারা গিয়েছেন। ধীতপুর যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে আমরা জামিরতা হাই স্কুলে ক্যাম্প করে অবস্থান নিয়েছিলাম। ক্যাম্পে অবস্থান নিয়ে জানতে পারলাম- কৈজুরী রাজাকার ক্যাম্পের রাজাকারেরা বেলতৈল গ্রামে হানা দিয়ে সুনীল ও অনিল নামে দুই সহোদর কে নির্যাতন ও গুলি করে হত্যা করেছে। কয়েকটি হিন্দু বাড়িতে ঘরে অগ্নি সংযোগ ও লুটতরাজ করেছে। গ্রামের আরো কয়েক জন্য হিন্দু নারী পুরুষকে নির্যাতন করেছে। রাজাকারেরা পুঠিয়া গ্রামের অধিবাসী খুকনী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিতেন্দ্র নাম চন্দ কে এবং পোরজনা গ্রামের অধিবাসী মনীন্দ্র নাথ ঘোষকে হত্যা করেছে। ব্যক্তিগত শত্রুতার কারণে রতন কান্দি হাট ভরা লোকের মধ্য থেকে ভৈরব পাড়ার নারায়াণ চন্দ্র সরকার কে ধরে নিয়ে নির্যাতন ও গুলি করে হত্যা করেছে। তাঁর লাশ পাওয়া গিয়াছিল বাজিয়ার পাড়া চরে। উল্লাপাড়ার চড়িয়া ও সিরাজগঞ্জ জেলার অন্যান্য স্থানে গণ হত্যা হয়েছে। ১৪ ডিসেম্বর’৭১ শাহজাদপুর উপজেলা হানদার মুক্ত হয়। পীচ কমিটির সদস্য, রাজাকার ও অন্যান্য স্বাধীনতার বিরোধীরা দেশ বিদেশে পালিয়ে যায়। শাহজাদপুরে মুক্তিযোদ্ধা প্রশাসন গড়ে উঠে। জনাব মো: আব্দুল বাকি মীর্জাকে শাহজাদপুরের মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বাধি নায়ক নিযুক্ত করা হয়। মুক্তিযোদ্ধা প্রশাসন  আমাদের জামিরতা হাই স্কুল মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প সহ শাহজাদপুর থানার সকল মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের পরিচালনা ব্যয় ভার বহন করেন। পাকিস্তানি হানাদার সৈণ্যরা ১৬ ডিসেম্বর’৭১ আত্মসমর্পন করে। পাকিস্তানি হানাদার সৈন্যদের আত্মসমর্পনের পর স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার, ভুটান, ভারত, রাশিয়া ও অন্যান্য  সরকারের চাপে ৮ জানুয়ারী’৭২ জাতির পিতা কে পাকিস্তান সরকার কারাগার হতে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানি কারাগার হতে মুক্ত হয়ে জাতির পিতা বিশেষ বিমানে লন্ডন আসেন। লন্ডনে জাতির পিতাকে সংবর্ধণা দেওয়া হয়। লন্ডন থেকে বিশেষ বিমানে ভারত হয়ে ১০ জানুয়ারী’৭২ বাংলাদেশে আসলেন। ১২ জানুয়ারী জাতির পিতা প্রথমে রাষ্ট্রপতি হিসেবে এবং পরক্ষণেই রাষ্ট্রপাতি পদের ইস্তেফা দিয়ে সংসদীয় গণতন্ত্র  প্রথা চালু করে প্রধান মন্ত্রী হিসাবে দেশের দায়িত্ব ভার গ্রহণ করলেন। জাতির পিতা আমাদেরকে অস্ত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। আমাদের গ্রুপ ২৪ জানুয়ারী’৭২ রবিবার সিরাজগঞ্জ সদরস্থ ইব্রাহিম বিহারী বাসায় অস্থায়ী অস্ত্র জমা নেওয়া ক্যাম্পে লেঃ সাইফুল্লাহ স্যারের কাছে অস্ত্র ও গোলা বারুদ জমা দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের দায়িত্ব শেষ করে সহোদর বিজয়ীর বেশে আমি আমার গ্রামের বাড়িতে ফিলে এলাম। সরকার থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের পুণর্বাসনের জন্য জাতীয় মিলিশিয়া ক্যাম্প করা হলো।  আমি মিলিশিয়াতে যোগ দিলাম না। কয়েক দিন পর সিরাজগঞ্জ এস.ডি.ও অফিস থেকে  আমাকে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের মুক্তি বাহিনী প্রধান কর্ণেল (অবসর প্রাপ্ত) এম.এ জি ওসমানী স্বাক্ষরিত একটি সনদ পত্র, একটি সাদা কম্বল ও  বকেয়া রেশনিং ও পকেট এ্যালাউন্সের ১১০/- দিলেন। আমি বাড়িতে এসে আমার রতন কান্দি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বাবু দেবেন্দ্র নাথ সান্যাল মহাশয় এর কাছ থেকে অষ্টম শ্রেণীর অটোপাশের টিসি নিয়ে শাহজাদপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে লেখা-পড়া শুরু করলাম।  

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও অবসর প্রাপ্ত ব্যাংকার।

---
দেবেশ চন্দ্র সান্যাল একজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা।
জন্ম : ২৬ নভেম্বর, ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে

তিনি সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার হাবিবুল্লাহ নগর ইউনিয়নাধীন রতন কান্দি গ্রামের এক সম্ভান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে ১৯৫৪ খিষ্ট্রাব্দের ২৬ নভেম্বর জন্ম গ্রহণ করেন। সার্টিফিকেট অনুসারে তাঁর জন্ম তারিখ ২৬/০৯/১৯৫৮ খ্রি:। তাঁর পিতৃ দেবের নাম: দ্বিজেন্দ্র নাথ সান্যাল, মাতৃদেবীর নাম: নিলীমা রানী সান্যাল। তিনি গ্রামের রতন কান্দি মধ্যপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণী এবং রতন কান্দি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত লেখা পড়া করেন। তিনি শাহজাদপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৭৪ সালে এস.এস.সি পাস করেন। ১৯৭৬ সালে জামিরতা কলেজ হতে বৃহত্তর পাবনা জেলার মধ্যে বানিজ্য বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করে বৃত্তিপ্রাপ্ত হয়ে এইচ.এস.সি (বানিজ্য) পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হন। ১৯৭৯ সালে শাহজাদপুর মহা বিদ্যালয় হতে বি.কম পাশ করেন। ১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.কম (মার্কেটিং বিভাগ) ভর্তি হন। ১৯৮৪ সালে পাবনা সংস্কৃত কলেজ থেকে কাব্যতীর্থ পাশ করেন। ১৯৭১ সালে অষ্টম শ্রেণীতে অধ্যয়ন কালীন সময়ে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ভারত গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে সশস্ত্র মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে ছিলেন। তিনি ৩টি “হিট এন্ড রান” একটি পাকিস্তানি হানাদার সৈন্য ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধের জন্য এ্যাম্বুস ও পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ তিনটি সম্মূখ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছেন। তিনি ১৯৮০ সালে ২২ সেপ্টেম্বর সোনালী ব্যাংকে জুনিয়র ক্লার্ক হিসেবে যোগদান করে ছিলেন। তিনি কর্মদক্ষতা ও যোগ্যতার  কারণে ব্যাংকিং জীবনে ৬ পদোন্নতি  এবং ৯ বার পুরস্কার পেয়েছেন । তিনি ৫টি শাখায় প্রায় ১১ বছর অত্যন্ত সুনামের সাথে ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ৩৮ বছরাধিক চাকরি জীবনে ধাপে ধাপে পদোন্নতি পেয়ে ২০১৮ সালে সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার হিসেবে অবসর গ্রহন করেছেন। তিনি তাঁর পিতা-মাতার তৃতীয় সন্তান। তাঁরা ৪ ভাই ও ১ বোন। বড় দাদা দেবেন্দ্র নাথ সান্যাল (সুকুমার), মেজদাদা- সমরেন্দ্র নাথ সান্যাল(ভবেশ), ছোট ভাই সৌমেন্দ্র নাথ সান্যাল (শমেন) ও একমাত্র ছোট বোন দুলালী রানী চক্রবর্তী। তিনি ১৯৮২ সালে নাটোর জেলার সিংড়া উপজেলার মুন্সী বাঁশ বাড়িয়া গ্রামের রবীন্দ্র নাথ মুন্সী ও সবিতা রানী মুন্সী এর একমাত্র বড় মেয়ে নিভা রানী মুন্সীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি ৩ সন্তানের জনক। বড় মেয়ে - চন্দনা সান্যাল, ছেলে - উত্তমকুমার সান্যাল ও ছোট মেয়ে বন্দনা সান্যাল। তিনি সনাতন ধর্ম ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখা লেখি করে থাকেন। তিনি লেখা- লেখি করে নিজ গ্রামে একটি শাখা ডাকঘর প্রতিষ্ঠা করেছেন। তার ধর্মীয় লেখা মাসিক ভারত বিচিত্রা, সমাজ দর্পন, শ্রী শ্রী গৌরবানী ও অন্যান্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখা দৈনিক প্রথম আলোসহ বিভিন্ন পত্রিকায় ও বইতে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি স্বউদ্দোগে জ্ঞান বিতরণের জন্য নিজ গ্রামে সনাতন ধর্ম ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গ্রন্থের ভ্রাম্যমাণ গণ পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেছেন। গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তদানীন্তন মহামান্য রাষ্ট্রপতি জনাব মো: জিল্লুর রহমান তাঁর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কর্মকান্ড বেগবান করার জন্য আর্থিক অনুদান দিয়েছেন। 
তাঁর মুক্তিযোদ্ধা পরিচিতি হলো :

জাতীয় তালিকা নম্বর : শাহজাদপুর -১০৪। লাল মুক্তিবার্তা নম্বর : ০৩১২০৪০০০৬, গেজেট নম্বর -বে-সামরিক সিরাজগঞ্জ-১৬৭৯। ভারতীয় প্রশিক্ষণ - এফ.এফ. নম্বর -৪৭৪২। সমন্বিত তালিকা জেলা ভিত্তিক- ১৪১১, উপজেলা ভিত্তিক- ১৫১ মুক্তিযোদ্ধা পরিচিতি ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম, ডিজিটাল সনদ ও পরিচয়পত্র নম্বর : ০১৮৮০০০১৪১১।