নারী দিবস পালন ও সচেতনতা

নারী দিবস পালন ও সচেতনতা

আনোয়ারা আজাদ : বেগুনি রঙের শাড়িতে নারীদের ছবি দেখে যদি আমরা ভেবে থাকি বেশ চলছে নারীদের জীবন, নীল অপরাজিতার ভালোবাসায় ডুবে আছে, ভুল বোঝা হবে। এই ছবি ওই পর্যন্তই! মুষ্টিমেয় নারী ছাড়া বেশিরভাগ নারীর জীবনেই এর কোনও পজিটিভ প্রভাব নেই। বরং সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ রিপোর্ট করছে যে, দিনকে দিন হাওয়া বইছে উল্টোদিকে!

এখনো, হ্যাঁ এখনো এই সমাজের অধিকাংশ সাধারণ ও শিক্ষিত নারীদের চিন্তাভাবনার তেমন কোনও পার্থক্য চোখে পড়ে নি। তাঁরা গৎবাঁধা ভাবনা থেকে বের হতেই চায় না। অধিকাংশই ঠাস করে বলে বসে, না বাপু, বেশি বুঝতে চাই না। মাথা ঘুরায়! শিক্ষিতদেরই মাথা ঘুরানোর কথা বেশি বলতে দেখেছি।

এমএসএফ জানায়, এই বছরে জানুয়ারি মাসের চেয়ে ফেব্রুয়ারিতে ১১টি বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ৪২টি ধর্ষণ, ১৩টি সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, ৩টি ধর্ষণ ও হত্যা, ৩২টি যৌন নিপীড়ন, ৩১টি শারীরিক নির্যাতন ও ৭০টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। প্রতিবেদন বলছে, ফেব্রুয়ারি মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে ১ জনের মৃত্যু হয়েছে ও কারা হেফাজতে ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই মাসে রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে।

আমার জিজ্ঞাসা, এসব ঘটনা শুনে মাথা ঘুরায় না? এসব ঘটনা থেকে মুক্তি পেতে হলে মাথা ঘুরানো বন্ধ করতে হবে। ঘটনার রিপিটেশন যেন না হয় সেগুলো নিয়ে আলোচনা করতে হবে, সচেতন হতে হবে। এই যুগ হলো প্রযুক্তিনির্ভর যুগ, এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে, তাদের ভালো-মন্দের ব্যবহার বোঝাতে হবে। ভালোটা গ্রহণ করে মন্দকে কীভাবে মোকাবিলা করবে সেসব শেখাতে হবে।

অথচ হচ্ছেটা কী দেখুন! শিক্ষিত নারীদের অধিকাংশই পুরনো ধ্যান-ধারণা থেকে বের হতে পারছে না। বেগম রোকেয়ার জীবনী নিয়ে আলোচনা করে হাততালি কুড়িয়ে বাসায় গিয়ে ময়লা ফেলার ঝুড়িতে ঝেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে তারা ঘুমোতে যায়! বহু বছর আগে বেগম রোকেয়া যে মূল্যবান কথাগুলো লিখে গেছেন পুরোপুরি তার সুফল ভোগ করার পরও কনক্লুশন হলো ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দেওয়া!

রোকেয়া তখনই বলে গিয়েছেন, কন্যাগুলিকে সুশিক্ষিত করিয়া কার্যক্ষেত্রে ছাড়িয়া দাও, নিজের অন্ন-বস্ত্র উপার্জন করুক। দেখুন, আজকে বিশ্বের শিক্ষিত, কম শিক্ষিত কিংবা অশিক্ষিত অধিকাংশ নারীই উপার্জন করে খাচ্ছে। যদিও তাদের বৈষম্যর শিকার হতে হচ্ছে এবং পুরুষের প্রভুত্বকে মেনে নিতে হচ্ছে সর্বক্ষেত্রেই। এর কারণও হলো রোজগার করলেও চিন্তাভাবনার জায়গাটাকে সংকুচিত করে রাখা। সত্যি কথা বলতে কী, চিন্তাভাবনার অগ্রগতি হচ্ছে না বলেই সার্বিক দিক দিয়ে আরও পিছিয়ে পড়ছে। ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। একটা অংশ যেন অন্ধকার যুগের দিকে হাঁটছে! তারা অদ্ভুত একটা সংস্কৃতির সঙ্গে আপস করতে চাইছে। তাদের চিন্তা-চেতনা যে কোথাও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, বুঝতেই পারছে না। তাই এই একবিংশ শতাব্দীতেও নারীর কূপমণ্ডূকতা যেন সমাজে নারীর অগ্রগতিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে না পারে সেদিকে আমাদের মনোযোগী হওয়া খুব জরুরি।

আমাদের সমাজে এখনো কন্যাশিশু জন্ম নিলে, গ্রামেই হোক কিংবা শহরে, গরিব কিংবা ধনী যেই পরিবারেই হোক না কেন, অন্য একটা হিসাব অটোমেটিক চালু হয়ে যায়! মুখে বলার প্রয়োজন হয় না, চোখে চোখে, নীরবে-নিভৃতে মগজে সে বার্তা পৌঁছে যায়! লেখাপড়া না জানা বা গরিব মানুষদের কথা পরে, অনেক লেখাপড়া জানা মানুষের কথা শুনেও হয়রান হয়েছি, হয়রান হই।

এখনো নারীরাই নিজ কন্যাটিকে স্বাবলম্বী না করে, বিয়ের উপযুক্ত সময় না হলেও বিয়ের পিঁড়িতে ঘাড় ধরে বসিয়ে দেয়। নারী দিবস, নারীবাদী শব্দগুলো মেয়েটির কোনো কাজে লাগে? এ রকম লাখ লাখ মেয়ের জীবনে বেগুনি শাড়ির ফটোসেশন কোনো মানেই তৈরি করে না।

বছর ঘুরে কোলে বাচ্চা নিয়ে অনেক মেয়েকেই ফিরতে হয়। ফেরার পর কী হয় ভাবুন। নিজেই সে একজন বালিকা তার ওপর কোলে শিশু। যে নিজেই পুষ্টিকর খাওয়া পায় না, আরেকজনের পুষ্টি জোগাবে কেমন করে? তাই করজোড়ে অনুরোধ, কন্যাদের আগে নিজের পায়ের নিচের মাটি শক্ত করতে দিন, তুমি মেয়ে, তুমি মেয়ে এই ভাবনায় বুঁদ না হয়ে তুমি মানুষ এই ভাবনায় বড় করতে চেষ্টা করুন।

মুখ বুজে নির্যাতন সহ্য করার দিন নেই এখন। এখন প্রযুক্তির দিন। প্রযুক্তির ভালো দিকগুলো মেয়েগুলো ব্যবহার করতে শিখুক সেদিকে সবার দৃষ্টি দিতে হবে। কেননা কত কত নির্যাতন যে হচ্ছে হিসাব নেই।

পুরনো ধারণাগুলো পেছনে রেখে সামনে এগিয়ে যাওয়ার দিন এখন। মেয়েটিকেও ওই একইভাবে কাজে লাগিয়ে মানসিক শক্তি যোগাতে সাহায্য করুন। এই সময়ের সবচেয়ে অমানবিকতা হলো নারীর প্রতি অন্যায়-অবিচার, তাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত যৌন সন্ত্রাস। পুরুষ এটা জেনেই বড় হয় যে, নারীর চেয়ে সে শক্তিশালী, নারীকে অবদমন করাতেই তার পুরুষত্ব।

মানবিকতা না হলে রাষ্ট্র কী রকম ভারসাম্যহীন হয়ে যায়, কোভিড-১৯ এসে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিল। মানুষ সমষ্টিগতভাবে কতটা মানবিক হতে পারে, সে উদাহরণও যেমন আমাদের সামনে এসেছে, মানুষ কতটা অমানবিক ও নিকৃষ্ট হতে পারে, লোভী হতে পারে, সেসবও প্রত্যক্ষ করেছি। প্রত্যেকটি মানুষ নিজেই এক একটি রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের প্রতি তার দায়িত্ব আছে, প্রতিটি মানুষের ভেতরে মানবতা থাকলে পৃথিবী এতটা কলুষিত হতে পারতো না।

আমাদের সংবিধানে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব নাগরিকের সমান অধিকারের কথা বলা হলেও পারিবারিক আইন থেকে শুরু করে নারী নির্যাতন প্রতিরোধবিষয়ক আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে এবং প্রয়োগে পুরুষের স্বার্থকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, নিরাপত্তা সবখানেই নারী কোনো না কোনোভাবে হোঁচট খাচ্ছে এবং এসব বিষয় নিয়ে নারীরা যতটা সোচ্চার হয়েছে, সমাধান হয়েছে অতিসামান্য। আসলে পিতৃতন্ত্র, ধর্ম, নারীত্ব, মাতৃত্ব, কাজ করার ক্ষমতা এসব মন ভোলানো কথার অন্তরালে নারীকে দমিয়ে রাখার পাঁয়তারা যুগ যুগ ধরেই চলে আসছে। মুখে যতই নারী দিবসের স্লোগান দিক না কেন, প্রশংসায় ভেসে যাক না কেন, ভেতরে ভেতরে নারীকে দমন করার স্পৃহা প্রায় প্রতিটি পুরুষের। ব্যতিক্রমের সংখ্যা হাতে দু-একটা গোনা যায় শুধু!

পুঁজিবাদী বিকাশের সবকালেই নারীরা, বিশেষ করে দরিদ্র নারীরা সস্তা শ্রমিক হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে এবং এখনো হচ্ছে। মজুরির বৈষম্য ও শ্রমিক শোষণের প্রতিবাদ করতে ১৯০৭ সালে স্টুটগার্ডে প্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলে ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসাবে স্বীকৃতি পায়।

কিন্তু মজুরির বৈষম্য নিয়ে এতদিনেও কোনো সঠিক সমাধান তৈরি হয় নি।

একটি শতক পার হলে সব ভাবনার সঙ্গে নারীর অগ্রগতি বা সামাজিক অবস্থান নিয়ে মূল্যায়ন করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। নারীর মৌলিক অধিকারের জন্য কতটুকু লড়াই করতে হবে, সমাজ এসব লড়াই কীভাবে মেনে নিচ্ছে বা নেবে, সবকিছুরই মূল্যায়ন হওয়া দরকার। নারীর অবস্থানের মূল্যায়ন, নারীর অধিকার আদায়, নারীবাদ, নারী মুক্তি নিয়ে তর্ক-বিতর্কের মুখোমুখি, কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে উপহাস ইত্যাদি নিয়ে আমাদের কতটা পথ পাড়ি দিতে হবে, কবে এই পথচলা শেষ হবে, এসব চিন্তার অগ্রগতি কতটুকু এসবই আমাদের আজকের ভাবনার বিষয়। কেন এবং কতদিন আমাদের পালন করতে হবে বিশ্ব এইডস দিবসের মতো করে বিশ্ব নারী দিবস এসবও ভাবতে হবে।

নারীর সম্পত্তিতে অধিকার, বিবাহবিচ্ছেদে অধিকার, উচ্চশিক্ষার অধিকার, সংসদে বসার অধিকার আইনত পাস হলেও কার্যত কতখানি কার্যকর হয় সে ব্যাপারে সচেতন হতে হবে নারীদেরই, আর এজন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন শিক্ষা এবং স্বাবলম্বী হওয়া। এখনো নারীরা ক্রমাগত স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে গেলেও শুধু শিক্ষা এবং দিকনির্দেশনার অভাবে পিছিয়ে পড়ছে। অনেক নারীই এখনো তাদের অধিকারের হিসাবটুকু জানে না। উত্তরাধিকারের অধিকার সমান হলে অন্যান্য হিসাবগুলোও সমান হয়ে আসবে এটুকুও অনেক নারীকেই বোঝানো যায় না। নারীই যদি তাদের অধিকার ঠিকমতো বুঝে নিতে না চায় তা হলে পুরুষদের দোষ দিয়ে কোনো লাভ নেই।

নারী মুক্তি সংগঠনগুলো সাধারণ নারীদের এসব বিষয় সম্পর্কে বিশদ জানাতে তেমন কোনো উদ্যোগ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। এটা সচেতন নারীদের ব্যর্থতা। সাধারণ নারীদের, অর্থাৎ যাদের জন্য আজকের এই বিশ্ব নারী দিবস পালন করা তাদের কাছাকাছি পৌঁছাতে সংগঠনগুলোর যে ভূমিকা রাখা প্রয়োজন, তার এক অংশও কার্যত হচ্ছে না। কিসের নারী দিবস?

আনোয়ারা আজাদ : কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক।