সাকিবের প্রচারণায় একজন মুক্তিযোদ্ধার আক্ষেপ
নিজস্ব সংবাদদাতা, বাঙলার কাগজ; মাগুরা : শ্রীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে দুইশ গজ দূরেই মাগুরার শ্রীপুর এমসি পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়। নির্বাচনি প্রচারণার অংশ হিসেবে শুক্রবার (২২ ডিসেম্বর) ওই প্রতিষ্ঠানে গিয়েছিলেন সাকিব। তাঁর আগমন উপলক্ষে এমসি পাইলট বিদ্যালয়ের মাঠে মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করা হয়। দুপুর গড়িয়ে বিকেল সাড়ে ৩টা। টোকেন নিয়ে একে একে প্রায় উপস্থিত লোকজন খাবারের প্যাকেট ও তাঁর সঙ্গে একটি ‘খাম’ (টোকেনধারীরা প্রত্যেকে ৫০০ টাকা সমেত খাম পেয়েছেন) নিয়ে যাঁর যাঁর মতো বাড়ি ফিরছিলেন। ৫০০ থেকে ৬০০ লোকের আয়োজন হলেও তখন অধিকাংশ চেয়ার ফাঁকা। প্যান্ডেলের পেছনের অংশে সত্তরোর্ধ্ব এক ব্যক্তি ও বয়স্ক এক নারী পাশাপাশি অসহায়ভাবে বসেছিলেন। সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পর জানা গেলো তাঁরা স্বামী-স্ত্রী। সত্তরোর্ধ্ব ব্যক্তি জানান তাঁর নাম এলাহি শেখ। স্ত্রীর নাম আলেয়া বেগম। হাতে থাকা লাঠি ও স্ত্রীর সহযোগিতা ছাড়া চলাফেরা করতে পারেন না। বয়সের ভারে স্বামী-স্ত্রীর শরীরে চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে। তবে এলাহি বয়সের ভারে ন্যুব্জ হলেও কথায় দৃঢ়তার ছাপ স্পষ্ট। অসুস্থ স্বামীর হাতের ওপর যেভাবে আলেয়া হাত রেখে পাশাপাশি চেয়ারে বসে ছিলেন, তা যেনো ভালোবাসার এক নৈসর্গিক দৃশ্য। এলাহি হঠাৎ বলেন– ‘আমার বয়স ৭৫ পার হয়েছে। এক পা প্যারালাইজড। নিজে হাঁটতে চলতে পারি না। বউকে নিয়ে ভ্যান ভাড়া করে তিন কিলোমিটার দূরের বাড়ি থেকে নৌকার কর্মসূচিতে এলাম। ৩০ বছর ধরে শ্রীপুর ৪ নম্বর ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি। স্বাধীনতার আগে থেকে আওয়ামী লীগ করি। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। এখানে যাঁদের দেখছেন, তাঁদের অনেককে চোখের সামনে তরতর করে বড় নেতা হতে দেখেছি। সবাইকে খাবার দেওয়া হচ্ছে আর আমরা দু’জন এখনও অপেক্ষা করছি। হাঁটতে পারি না বলে স্টেজের সামনে যেতে পারছি না। একে-ওকে খাবার দেওয়ার কথা বললেও আমলেই নিচ্ছে না। এ সময় আলেয়া বললেন– ‘লোকটা অসুস্থ। ক্ষুধা নিয়ে আর কত সময় অপেক্ষা করবো। এই দেখেন এক্সরে রিপোর্টসহ চিকিৎসার কাগজপত্র। আজও সকালে ডাক্তার দেখাতে হয়েছে। দেখেন আপনারা কাউকে অনুরোধ করে দুই প্যাকেট খাবার জোগাড় করে আনতে পারেন কি-না। এতো বলি বয়স হয়েছে, রাজনীতি থামাও। এক পা ওপারে চলে গেছে। কিন্তু কিছু শুনলো না। আমাকে নিয়ে এখানে চলে এলো।’ এরপর কয়েক দফায় আয়োজকদের দৃষ্টি আকর্ষণের পর এলাহি ও তাঁর স্ত্রীর জন্য খাবার পাওয়া গেলো। যখন খাবার হাতে তুলে দেওয়া হলো এলাহির মুখাবয়বে হালকা হাসির রেখা। চোখের কোনাও ছলছল করছিলো। এমন দৃশ্য দেখে মনে হলো– এটা শুধু দুই প্যাকেট খাবার পাওয়া-না পাওয়ার বিষয় নয়, মুক্তিযোদ্ধা এলাহির জন্য আত্মসম্মানেরও প্রশ্ন।
এলাহি বলেন, ‘কত মানুষকে সরকারের কাছ থেকে পাওয়া বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতাসহ নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধার কার্ড দিয়েছি। এই জীবনে একটি পয়সা এদিক-ওদিক করি নি। অন্যায়ের সঙ্গে আপস তো প্রশ্নই আসে না।’
মাগুরায় দেখা গেলো সাকিবকে দেখতে আশপাশের জেলা থেকেও অনেকে এসেছেন। তাঁদের মধ্যে আছে ফরিদপুর সদরের তুষার কুমার বোসের পরিবার। প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূর থেকে তুষারের পরিবারের ৯-১০ সদস্য মাগুরার শ্রীপুর গিয়ে হাজির হলেন। স্ত্রী-সন্তানদের সাকিবকে সামনাসামনি দেখাবেন, সেলফি তুলবেন– চাওয়া তুষারের। তবে সাকিবের নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের কঠোর বলয় ভেঙে অনেকে যখন মাগুরার নানা প্রান্তে সেলফিতে মশগুল, পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধা এলাহি ও তাঁর স্ত্রীর মতো অনেকে রয়েছেন– তাঁরা ছোট-বড় কষ্ট বুকের গহিনে ধারণ করেই প্রতিদিন ঘুমাতে যান। ক্যামেরা, লাইট, জৌলুসের বাইরে বসবাস করেন তাঁরা। সামান্য টোকেন নেই বলে খাবার পেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরনা দিতে হয়।