সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে দরপত্র আহ্বানের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে

সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে দরপত্র আহ্বানের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে

নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলার কাগজ : সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে দরপত্র আহ্বান করা হতে পারে আগামী সপ্তাহে। এরই মধ্যে এ দরপত্র আহ্বানের কাজ চূড়ান্ত করে ফেলেছে পেট্রোবাংলা ও জ্বালানি বিভাগ। পেট্রোবাংলা জানিয়েছে, নতুন এ দরপত্র আহ্বানের সম্ভাব্য দিন ১০ মার্চ। এ দরপত্র আহ্বানের মধ্য দিয়ে দেশের সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বিদেশি কোম্পানিগুলোর পুনরায় যুক্ত হওয়ার সুযোগ তৈরি হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

গভীর বঙ্গোপসাগরে নিজ সীমানায় অনুসন্ধান চালিয়ে এরই মধ্যে বড় সাফল্যের দেখা পেয়েছে ভারত ও মিয়ানমার। চলতি বছরের শুরুতে অন্ধ্রপ্রদেশের উপকূল থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরত্বে গভীর সাগরে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের বড় মজুদ আবিষ্কার করেছে ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকারী প্রতিষ্ঠান অয়েল অ্যান্ড ন্যাচারাল গ্যাস করপোরেশন লিমিটেড (ওএনজিসি)। খনিটি থেকে দৈনিক ৪৫ হাজার ব্যারেল জ্বালানি তেল এবং ১০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা যাবে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। খনিটি থেকে উত্তোলন কার্যক্রম শুরু হলে দেশটির শুধু জ্বালানি তেল আমদানি বাবদ অর্থ সাশ্রয় হবে ১০ হাজার কোটি রুপির মতো। 

আরেক প্রতিবেশি মিয়ানমারও এরই মধ্যে গভীর সাগরে অনুসন্ধান চালিয়ে বড় সাফল্যের দেখা পেয়েছে। বাংলাদেশের সীমানার নিকটবর্তী এলাকার মিয়া ও শোয়ে নামে দুটি গ্যাসকূপ থেকে এরই মধ্যে কয়েক ট্রিলিয়ন গ্যাস উত্তোলন করে ফেলেছে দেশটি। স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে এ গ্যাস তারা এখন চীনেও রপ্তানি করছে। 

দেশের জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিবেশী দুই দেশ সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম চালিয়ে বড় সাফল্যের দেখা পেয়েছে। যদিও পর্যাপ্ত বিনিয়োগ ও মনোযোগ না পাওয়ায় বাংলাদেশে সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম তেমন একটা এগোয়নি। নতুন এ দরপত্রের মধ্য দিয়ে সে অচলাবস্থা কাটিয়ে ওঠার সুযোগ তৈরি হয়েছে। জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সাগরের ব্লক বরাদ্দসহ দরপত্র আহ্বানে নানা বিষয় নিয়ে একটি রোডম্যাপ তৈরি হয়েছে। এ রোডম্যাপের আওতায় বিদেশি কোম্পানিগুলোর দরপত্রে অংশগ্রহণ প্রক্রিয়া, এ নিয়ে দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমে বিজ্ঞাপন, রোড শোসহ নানা ধরনের কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব নূরুল আলম বলেন, ‘সাগরে তেল গ্যাস অনুসন্ধানে দরপত্র আহ্বান (বিডিং রাউন্ড) মার্চের প্রথম সপ্তাহে না হলেও দ্বিতীয় সপ্তাহে হবে। বিষয়টি নিয়ে আমরা চূড়ান্তভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছি। এটি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন আকারে যাবে। সেখানেই বিস্তারিত তুলে ধরা হবে।’

সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশ অংশে বিরাট এলাকাজুড়ে টুডি সিসমিক সার্ভে করা হয়েছে। জার্মানির কোম্পানি স্লামবার্জার দুই বছর আগে এ জরিপকাজ করেছে। পেট্রোবাংলার সঙ্গে চুক্তির ভিত্তিতে স্লামবার্জারের করা এ জরিপের তথ্য-উপাত্ত এরই মধ্যে মার্কিন কোম্পানি শেভরন কিনে নিয়েছে। এরই মধ্যে শেভরন এসব ডাটা বিশ্লেষণ করে ফেলেছে। নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রে জানা গেছে, তারাও সাগরে অনুসন্ধান কার্যক্রম চালাতে ব্লক বরাদ্দ নিতে দরপত্রে অংশ নেবে।

এ বিষয়ে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে পেট্রোবাংলার এক কর্মকর্তা জানান, ১০ মার্চ দরপত্র আহ্বানের বিষয়টি এক প্রকার চূড়ান্ত হয়ে আছে। বিদেশি ৫৫টি কোম্পানিকে এ দরপত্রে অংশ নিতে আমন্ত্রণ জানানো হবে। এবার বিডিং রাউন্ডে বিভিন্ন পর্যায়ে কয়েকভাগে প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। দরপত্র আহ্বান শুরুর পর জমা দেওয়ার জন্য ছয় মাস সময় রাখা হয়েছে।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম রয়টার্সকে বুধবার (৬ মার্চ) জানিয়েছেন, ‘‌দেশে গ্যাসের স্থানীয় উত্তোলন বৃদ্ধির জন্য ১০ মার্চ আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হবে। বঙ্গোপসাগরের ২৪ ব্লকে (অফশোর ব্লক) তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য দরপত্র জমা দেওয়ার সময়সীমা থাকবে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত। এরপর এসব দরপত্র মূল্যায়ন করতে সময় লেগে যেতে পারে চলতি বছর।’

বাংলাদেশে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য গভীর সমুদ্রে বিনা দরপত্রে ১৫টি ব্লকে কাজ চেয়েছিল মার্কিন জ্বালানি খাতের জায়ান্ট এক্সনমোবিল। গত বছরের মার্চে কোম্পানিটি এ বিষয়ে দুই দফায় প্রস্তাব দিয়েছিল। পেট্রোবাংলাকে এ নিয়ে কোম্পানিটির পক্ষে চিঠিও দেওয়া হয়। এর মধ্যে গত বছরের ১৬ জুলাই দেওয়া চিঠিতে কোম্পানিটি গভীর সমুদ্রে ২৫-৩০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগেরও কথা জানায়। বিষয়টি নিয়ে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের সঙ্গেও এক্সনমোবিলের আলোচনা হয়। সর্বশেষ গত ২১ ফেব্রুয়ারি সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ পেতে ঢাকায় আসে এক্সনমোবিলের এক প্রতিনিধি দল। সচিবালয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, জ্বালানি সচিব ও পেট্রোবাংলার প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করেন তারা। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এক্সনমোবিলের সে প্রস্তাব নাকচ করে কোম্পানিটিকে আসন্ন দরপত্রে অংশ নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে মার্কিন কোম্পানিটি দরপত্রে অংশ নেবে কিনা, সে বিষয়ে এখনো কিছু জানায়নি।

বঙ্গোপসাগরে গভীর-অগভীর সমুদ্রে মোট ২৬টি ব্লক রয়েছে। এর মধ্যে গভীর সমুদ্রে ১৫টি এবং অগভীর সমুদ্রে ১১টি ব্লক রয়েছে। সর্বশেষ ২০১২ সালের ডিসেম্বরে বঙ্গোপসাগরে অনুসন্ধান চালানোর জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করেছিল পেট্রোবাংলা। সেই দরপত্রে নয়টি ব্লকের জন্য বিদেশি কোম্পানিগুলো কাজ করার আগ্রহ দেখালেও শেষ পর্যন্ত তিনটি ব্লক ইজারা নিয়েছিল আন্তর্জাতিক জ্বালানি তেল কোম্পানিগুলো। এর মধ্যে ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকারী কোম্পানি ওএনজিসি এসএস ৪ ও ৯ নম্বর ব্লক ইজারা নিয়েছিল। আর অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকারী প্রতিষ্ঠান সান্তোস ইজারা নিয়েছিল ১১ নম্বর ব্লক। তবে সে প্রক্রিয়া থেকে ইতিবাচক কোনো ফল পাওয়া যায়নি। 

সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে ২০২৩ সালে মডেল পিএসসির চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় সরকার। এর আওতায় বিদেশি কোম্পানিগুলোকে ব্লক ইজারা দেওয়া হবে। সংশোধিত এ মডেল চুক্তি অনুযায়ী, সাগরে গ্যাস পাওয়া গেলে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দামের ১০ শতাংশ ধরে সরকার প্রতি ইউনিট গ্যাস কিনবে। বিদ্যমান পিএসসিতে প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের প্রাথমিকভাবে অনুমিত মূল্য ধরা হয়েছে অগভীর ও গভীর সমুদ্রে যথাক্রমে ৫ ডলার ৬০ সেন্ট ও ৭ ডলার ২৫ সেন্ট। তবে এটি হিসাব করা হবে মূলত অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক বাজার আদর্শ ব্রেন্টের দামের সারা মাসের গড় মূল্যের ওপর ১০ শতাংশ ধরে। 

সংশোধিত মডেল পিএসসিতে দামের পাশাপাশি সরকারের শেয়ারের অনুপাতও নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর আগে মডেল পিএসসি-২০১৯-এ বলা হয়েছিল, গ্যাসের উত্তোলন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এতে বাংলাদেশের শেয়ার অনুপাতও বাড়তে থাকবে। আর কমতে থাকবে বহুজাতিক কোম্পানির শেয়ার।

এবারের মডেল পিএসসি চুক্তিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের হিস্যা গভীর সমুদ্রে ৩৫ থেকে ৬০ শতাংশ এবং অগভীর সমুদ্রে ৪০ থেকে ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত ওঠানামা করবে। তবে ঠিকাদার নির্ধারিত সময়ের দুই বছরের মধ্যে কূপ খনন করে গ্যাস না পেলে বা বাণিজ্যিকভাবে উত্তোলনযোগ্য না হলে শর্তসাপেক্ষে যথাক্রমে ১ ও ২ শতাংশ হিস্যা বাড়ানোর সুযোগ রাখা হয়েছে।

২০১২ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তি হয় মিয়ানমারের। এরপর ২০১৩ সালে এখান থেকে গ্যাস উত্তোলন শুরু করে দেশটি। এরপর ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তি হয় ২০১৪ সালে। এরই মধ্যে এ নিষ্পত্তিরও ১০ বছর পেরিয়েছে। দীর্ঘ এ সময়ের মধ্যে গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস উত্তোলন ও অনুসন্ধানে কোনো সাফল্যেরই দেখা পায় নি বাংলাদেশ।

বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ, সীমানা নিষ্পত্তির পর গভীর সমুদ্রে জ্বালানি অনুসন্ধানে মনোযোগ বাড়িয়েছে মিয়ানমার ও ভারত। বিনিয়োগ করেছে বিভিন্ন পর্যায়ে। ফলে প্রয়োজনমতো বিদেশি বিনিয়োগও পেয়েছে। আর বাংলাদেশ সময়ক্ষেপণ করেছে আমদানিনির্ভর জ্বালানি নীতি বাস্তবায়নে। 

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক বদরূল ইমাম বলেন, ‘দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করার পর বাংলাদেশ যে এ ধরনের একটি উদ্যোগ নিতে পেরেছে, সেটা অবশ্যই ইতিবাচক। আরো আগেই দরপত্র আহ্বানের কাজটি করা জরুরি ছিল। যদি এ দরপত্রে বিদেশি কোম্পানিকে আকৃষ্ট করা যায় তাহলে দেশের জ্বালানি খাতে ভালো কিছু প্রত্যাশা করা যেতে পারে। কারণ মিয়ানমার ও ভারত আমাদের সমুদ্রসীমার কাছে গ্যাস পেয়েছে। আমাদের সীমানায়ও গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।’

দেশে গ্যাসের চাহিদা ও সরবরাহে কয়েক বছর ধরে অব্যাহতভাবে সংকট চলছে। এ সংকট মেটাতে পেট্রোবাংলা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করছে। আরো দীর্ঘমেয়াদে এলএনজি আমদানি চুক্তি করেছে আরো তিনটি। আগামী ২০৩৩-৩৪ সাল নাগাদ দেশে গ্যাসের বিদ্যমান মজুদ শেষ হয়ে আসার আশঙ্কা রয়েছে। এ মজুদ শেষ হওয়ার আগেই স্থানীয় ও আমদানীকৃত গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করতে চায় পেট্রোবাংলা। এর মধ্যে পেট্রোবাংলা স্থানীয় গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে ২০২৫ সাল নাগাদ ৪৬টি কূপ খননের উদ্যোগ নিয়েছে। আরো ১০০টি কূপ খনন করতে চায় ২০২৮ সাল নাগাদ।