সোমালিয়ার জলদস্যুদের থেকে মুক্ত বাংলাদেশি ২৩ নাবিক

সোমালিয়ার জলদস্যুদের থেকে মুক্ত বাংলাদেশি ২৩ নাবিক

নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলার কাগজ : ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ার জলদস্যুদের কবলে পড়া বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ মুক্তিপণের অর্থ পাওয়ার পর ছেড়ে দিয়েছে জলদস্যুরা। স্থানীয় সময় রাত বারটার দিকে দস্যুরা জাহাজ থেকে নেমে যাওয়ার পর ২৩ ক্রুসহ জাহাজটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের দিকে রওনা হয়েছে জানিয়েছেন জাহাজটির মালিক প্রতিষ্ঠান কেএসআরএম গ্রুপের মিডিয়া অ্যাডভাইজার মিজানুল ইসলাম।

তিনি বলেন, শনিবার (১৩ এপ্রিল) রাত ১২টায় মুক্তিপণের অর্থ পাওয়ার পর দস্যুরা জাহাজ থেকে নেমে যায়। রাত ১২টায় জাহাজটি মুক্ত হওয়ার পর দুবাইয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে।

তবে জাহাজ ও ক্রুদের মুক্তি নিশ্চিত করতে কত টাকা দিতে হয়েছে তা জানা যায় নি। যদিও এ বিষয়ে রবিবার দুপুরে চট্টগ্রামে কেএসআরএম গ্রুপের পক্ষ থেকে একটি সংবাদ সম্মেলন করার কথা রয়েছে।

ওদিকে জলদস্যুদের হাত থেকে মুক্তির পর ক্রুরা তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছেন। জাহাজের চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খানের মা শাহানুর আক্তার বলেন তাঁর ছেলের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে।

গত ১২ মার্চ কয়লা নিয়ে আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক থেকে দুবাইয়ের দিকে যাওয়ার সময় জলদস্যুদের কবলে পড়ে এমভি আব্দুল্লাহ।

জলদস্যুরা নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর জাহাজটি আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিকের কাছাকাছি অবস্থান করছিলো।

‘গোল্ডেন হক’ নামের জাহাজটি কেএসআরএম গ্রুপের বহরে যুক্ত হওয়ার পরে এর নাম দেওয়া হয় ‘এমভি আবদুল্লাহ’। গত বছর এটি সংগ্রহ করে সাধারণ পণ্য পরিবহন করতে থাকে কেএসআরএম গ্রুপ।

কীভাবে মুক্তি পেলো :
জলদস্যুদের কবলে পড়ার পর আলোচনার মাধ্যমে জাহাজ ও নাবিকদের মুক্ত করার চেষ্টার কথা জানিয়েছিলো জাহাজটির মালিক কর্তৃপক্ষ। পরে বিভিন্ন সময় আলোচনায় অগ্রগতির কথাও জানানো হয়েছিলো।

শেষ পর্যন্ত আলোচনায় মুক্তিপণের পরিমাণ চূড়ান্ত হওয়ার পর শনিবার (১৩ এপ্রিল) রাতে মুক্তি পেলো জাহাজ ও এর ক্রুরা।

মিজানুল ইসলাম বলছেন দস্যুরা জাহাজ থেকে নেমে যাওয়ার আগে সোমালিয়া উপকূলে ডলার পাঠানো হয়।

তিনি বলেন, মুক্তিপণের অর্থ পাওয়ার পর তাঁরা আরও কিছুক্ষণ জাহাজে ছিলো। রাত বারটায় জাহাজটি মুক্ত হওয়ার পর দুবাইয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। ৫/৬ দিন পর এটি দুবাইয়ের বন্দরে পৌঁছাবে। সেখান থেকে নাবিকরা কিভাবে আসবে সেটা এখনো সিদ্ধান্ত হয় নি।

জানা গেছে, মালিকপক্ষের সঙ্গে আলোচনার পর মুক্তিপণের জন্য নির্ধারিত ডলার ভর্তি ব্যাগ ছোট উড়োজাহাজ থেকে দস্যুদের নিয়ন্ত্রণে থাকা এমভি আব্দুল্লাহ জাহাজটির আশেপাশে স্পিডবোটে অপেক্ষারত দস্যুদের লক্ষ্য করে ছোড়া হয়। যদিও মিজানুল ইসলাম বলেছেন, দস্যুদের মুক্তিপণের অর্থ দেওয়া হয়েছে হেলিকপ্টার থেকে।

ডলার ভর্তি ব্যাগ পাওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর জাহাজে অবস্থানরত দস্যুরা জাহাজ ছেড়ে চলে যায়। এরপর জাহাজটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।

জলদস্যুদের কবলে কীভাবে পড়েছিলো জাহাজটি :
কয়লাবাহী এম ভি আবদুল্লাহ আফ্রিকার মোজাম্বিক থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতে যাচ্ছিলো। ভারত মহাসাগর দিয়ে যাওয়ার সময় ১২ মার্চ দুপুরের দিকে হঠাৎই ছোট ছোট বোট নিয়ে জাহাজের দিকে চলে আসে সোমালিয়ান জলদস্যুরা। ওই জাহাজে থাকা একজন ক্রু ঘটনার সময় একটি ভিডিও ধারণ করেন। বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার অ্যাসোসিয়েশন সেই ভিডিও দিয়েছিলো গণমাধ্যমের কাছে।

ওই ভিডিওতে দেখা যায়, ছোট ছোট নৌকায় করে জাহাজটিতে ওঠার চেষ্টা করে জলদস্যুরা এবং এ সময় তাদের হাতে বন্দুক ছিলো।

জাহাজে ওঠার পরই সবাইকে জিম্মি করে ফেলে জলদস্যুরা।

জলদস্যুরা জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পরই হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজের মাধ্যমে মালিক প্রতিষ্ঠানকে একটি বার্তা পাঠায় জাহাজের একজন নাবিক।

যাতে বলা হয়, জলদস্যুরা জাহাজ দখলে নিয়েছে। আমাদের নাবিকেরা আটকা পড়েছেন। আমরা বিস্তারিত জানার চেষ্টা করছি।

গভীর সমুদ্রে পণ্যবাহী জাহাজগুলো কিভাবে জলদস্যুদের কবলে পড়ে, তা নিয়ে কথা হয় বিশেষজ্ঞ ও জাহাজের দুজন সাবেক ক্যাপ্টেনের সঙ্গে।

তাঁরা বলছেন, পণ্য বোঝাই থাকায় জাহাজগুলো সাধারণত ধীরে চলে আন্তর্জাতিক নৌ রুটে। এমভি আব্দুল্লাহর মতো আকারের জাহাজগুলোতে ৩০ থেকে ৪০ টন পণ্য বোঝাই থাকে। বেশি পণ্য বোঝাই থাকায় বেশিরভাগ জাহাজের গতি থাকে ১৮ থেকে ২০ নটিক্যাল মাইল।

এ কারণেই গতি থাকে কম। জলদস্যুরা যখন কোনও জাহাজকে টার্গেট করে, তখন তারা ছোট ছোট বোটে অস্ত্র নিয়ে তিন থেকে চারদিক থেকে আক্রমণ করে।

তিন চারদিক থেকে যখন আক্রমণ করে, তখন সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে যায়।

সোমালিয়ান জলদস্যুর হাতে জিম্মি হওয়া জাহাজটির বেলায়ও তাই দেখা গেছে।

সাধারণত জলদস্যুরা জাহাজটিতে ওঠার পরই কমিউনিকেশনের সব পথগুলো তারা বন্ধ করে দেয়। এরপর ডাকাতি শুরু করে।

যাদের কাছে টাকা পয়সা আছে, অন্য দামি জিনিসপত্র যা আছে সেগুলো নিয়ে নেয়। মোবাইল নিয়ে নেয়। টোটাল কমিউনিকেশন অফ করে দেয় বহির্বিশ্বের সঙ্গে।

জাহাজের সাবেক ক্যাপ্টেন ও বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বলেন, জাহাজে থাকা ক্রুদের সাহায্যে এই জলদস্যুরা তাদের নিয়ন্ত্রিত এরিয়ার কাছাকাছি যে কোনও একটি পোর্টে নিয়ে যায়। সেখানে নোঙ্গর করে দুয়েকদিন পর গিয়ে তারা মুক্তিপণ দাবি করে। এই মুক্তিপণ দাবি করা হয় মালিক কোম্পানির কাছে।