বিদেশে ব্যবসা নিয়ে প্রশ্নের জবাব দিলেন সাবেক ভূমিমন্ত্রী
নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলার কাগজ : যুক্তরাজ্যে সম্পদ ও ব্যবসা থাকার বিষয়ে জাতীয় নির্বাচনের আগে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি যে তথ্য দিয়েছে, সেটি স্বীকার করে নিয়েছেন চট্টগ্রাম-১৩ আসনের সংসদ সদস্য সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী। তবে সেই সম্পদ ও ব্যবসা বাংলাদেশ থেকে পাঠানো টাকায় করা হয় নি দাবি করে বলেছেন, তাঁর বাবা আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর ৫০ বছর আগেই বিদেশে ব্যবসা করেন। তিনি সেই ব্যবসার উত্তরাধিকারী। আর যুক্তরাষ্ট্রে পড়ার সময়ও তিনি ব্যবসা করেছেন। যুক্তরাজ্যে তার আয়কর নথিও আছে।
করোনাভাইরাস মহামারীর সময় যুক্তরাজ্যে সম্পদ ও ব্যাংক ঋণের সুদহার কমে যাওয়ার পর ঝুঁকি নিয়ে লাভবান হয়েছেন, এমন একটি কথাও বলেছেন আওয়ামী লীগ নেতা।
তাঁর এসব তথ্য যাচাইয়ে নাগরিক সমাজ ও সাংবাদিকদের নিয়ে কমিটি গঠনের চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছেন, দুর্নীতির প্রমাণ পেলে সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে দেবেন।
বিদেশে সম্পদ ও ব্যবসা থাকার বিষয়টি সামনে আসার দুই মাসেরও বেশি সময় পর শনিবার (২ মার্চ) জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে আসেন সাইফুজ্জামান, যিনি চট্টগ্রামের আনোয়ারা আসন থেকে টানা তিনটি জাতীয় নির্বাচনে জিতে সংসদ সদস্য হয়েছেন।
২০০৮ সালের ডিসেম্বরের শেষের নির্বাচনে আসনটি ছিলো চট্টগ্রাম-১২। ওই বছর সেখানে জেতেন সাইফুজ্জামানের বাবা। ২০১২ সালের নভেম্বরের শুরুতে তিনি মারা গেলে উপনির্বাচনে নৌকা নিয়ে জয় পান সাইফুজ্জামান। পরের নির্বাচনে আসন পুনর্বিন্যাসে সেটি হয় চট্টগ্রাম-১৩।
২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনের পর মন্ত্রিসভায় ভূমি প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান তিনি। একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর ২০১৯ সালের শুরুতে নতুন সরকারে ভূমিমন্ত্রী হন সাইফুজ্জামান।
গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের ডামাডোলের মধ্যে ২৬ ডিসেম্বর টিআইবি গত ২৬ ডিসেম্বর ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকারের মন্ত্রিসভার অন্তত একজন সদস্যের নিজ নামে বিদেশে একাধিক কোম্পানি থাকার প্রমাণ রয়েছে, যার প্রতিফলন হলফনামায় নেই। মন্ত্রী ও তাঁর স্ত্রীর মালিকানাধীন ছয়টি কোম্পানি এখনও বিদেশে সক্রিয়ভাবে রিয়েল এস্টেট ব্যবসা পরিচালনা করছেন। যে সকল কোম্পানির মোট সম্পদ মূল্য প্রায় ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকা।
সরকার জানতে চাইলে তাঁর নাম এবং এ বিষয়ক সকল তথ্য ও তথ্যসূত্র দেওয়া হবে বলে জানালেও পরে ইফতেখারুজ্জামান বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমকে সেই ‘মন্ত্রীর’ নাম জানান। তিনি হলেন সাইফুজ্জামান চৌধুরী।
এরপর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ পায় সাইফুজ্জামানের যুক্তরাজ্যে যে সম্পত্তি রয়েছে, সেগুলো অন্তত আটটি কোম্পানির কেনা। এসব কোম্পানির প্রতিটিতেই তাঁর উল্লেখযোগ্য অংশীদারত্ব রয়েছে। কোম্পানিগুলো হলো : আরামিট প্রপার্টিজ, রুখমিলা প্রপার্টিজ, সাদাকাত প্রপার্টিজ, নিউ ভেঞ্চারস (লন্ডন) লিমিটেড, জিটিএস প্রপার্টিজ, জেবা প্রপার্টিজ, জিটিজি প্রপার্টি ভেঞ্চারস লিমিটেড ও জারিয়া প্রপার্টিজ। এসব কোম্পানি ২০১০ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে যুক্তরাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
তবে এসব ব্যবসার কোনও কিছুই আওয়ামী লীগ নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া নেতার হলফনামায় উল্লেখ করেন নি। নির্বাচনের আগে গণমাধ্যমের কাছে এ নিয়ে তিনি কথাও বলেন নি। তবে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় এক নির্বাচনি জনসভায় বলেছিলেন, আমি এক টাকাও দুর্নীতি করেছি, কেউ বলতে পারলে রাজনীতি ছেড়ে দেবো। এমপি, মন্ত্রী হলেও আমি ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান।
তিনি বলেছিলেন, ব্যবসা করেছি, ব্যবসা না করে আমি উপোস করে থাকবো? চুরি করবো নাকি আমি? মানুষের হক খেয়ে তো আমি চলতে পারবো না। হারাম পয়সার আমার দরকার নেই। আমার পদ বেচে আমি ব্যবসা করি না, আমার এই পদের অনেক আগে, আমার বাবাও ব্যবসায়ী ছিলেন, আমিও ব্যবসায়ী ছিলাম।
বিএনপির বর্জনের এই নির্বাচনে সাইফুজ্জামান বড় জয় পেয়েছেন। তবে নতুন সরকারের মন্ত্রিসভায় স্থান হয় নি তাঁর।
‘বিদেশে বাবার ব্যবসা ৫০ বছর ধরে’ :
বিদেশে ব্যবসা তাঁর বাবার করে যাওয়া উল্লেখ করে সাইফুজ্জামান বলেন, আমার ক্যারিয়ারটাই হলো ব্যবসায়ী ক্যারিয়ার। আমার ব্যবসায়ী ক্যারিয়ার ৩০ বছরেরও বেশি। আমার বাবার বিদেশের ব্যবসা প্রায় ৫০ বছরেরও বেশি। এই ব্যবসার অর্থ বাংলাদেশ থেকে নেওয়া হয় নি জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া দেশের বাইরে টাকা নেওয়ার কোনও সিস্টেম নেই। আমি বাংলাদেশ থেকে বাইরে কোনও টাকা নেই নি।
আনোয়ারা ও কর্ণফুলী আসনের সংসদ সদস্য বলেন, আমি আমার ব্যবসাকে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করি নি এবং রাজনীতিকে ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত করি নি। পারিবারিক সূত্র থেকেই আমি ব্যবসায়ী। আমি একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীর সন্তান। আমাদের পারিবারিক ব্যবসা ছিলো। দীর্ঘদিন ধরে আমি ব্যবসা করে আসছি। আমেরিকায় যখন আমার পড়াশোনা শেষ পর্যায়ে তখন থেকে আমি ব্যবসা শুরু করেছি। আমি ১৯৯১ সাল থেকে ব্যবসা শুরু করেছি এবং আমার বাবা ১৯৬৭ থেকে শুরু করেছে।
সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বাবা আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। সাবেক ভূমিমন্ত্রী বলেন, মহামারির সময় আমার জন্য সুযোগ হয়ে আসে। সে সময় লন্ডনে বাড়ির দাম পড়ে যায়, ব্যাংক ঋণের সুদ কমে যায়। সে সময় আমি ঝুঁকি নিয়ে লাভবান হয়েছি।
সাইফুজ্জামানের বাবা আখতারুজ্জামান বাবু ছিলেন চট্টগ্রামের একজন নেতৃস্থানীয় শিল্পোদ্যোক্তা। তিনি আরামিট গ্রুপ ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) চেয়ারম্যান ছিলেন।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি এবং চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে চট্টগ্রামের আনোয়ারা-পশ্চিম পটিয়া থেকে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। পরে একই এলাকা থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৭ সাল থেকেই চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন তিনি। পরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হন।
‘হলফনামায় যে কারণে বিদেশে সম্পদের তথ্য নেই’ :
নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামায় যে সম্পদের হিসাব দেওয়া হয়েছে, তাতে বিদেশে ব্যবসার তথ্য কেনো নেই, তারও জবাব দিয়েছেন সাইফুজ্জামান।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে নির্বাচনকালীন সময়ে যে হলফনামা করতে হয়, সেখানে ট্যাক্স রিটার্নের সঙ্গে মিল রেখে হলফনামা করতে হয়। আমি আমার হলফনামাটি অনেকবার এক্সপার্ট দিয়ে চেক করিয়েছি। বিদেশি সম্পত্তি উল্লেখ করতে হবে, হলফনামায় এ রকম কোনও কলাম নেই। এজন্য আমি হলফনামায় কোনও সময় বিদেশি সম্পত্তির কোনও তথ্য দেই নি।
তিনি বলেন, আমি আমার বিদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য একত্র করি নাই। এর কারণ হলো, বাংলাদেশের ট্যাক্স রিটার্ন আলাদা এবং যুক্তরাজ্যের ট্যাক্স রিটার্ন আলাদা। আমার কোনও খারাপ উদ্দেশ্য নেই।
‘এক টাকার দুর্নীতি প্রমাণ হলেই পদত্যাগ’ :
ব্যবসায় কখনো দুর্নীতি করেন নি দাবি করে সাইফুজ্জামান চৌধুরী বলেছেন, কেউ এটি প্রমাণ করতে পারলে তিনি সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে দেবেন।
সাবেক ভূমিমন্ত্রী বলেন, সুশীল ও সাংবাদিক সমাজের প্রতিনিধিসহ সরকারের উচ্চ মহলের লোক দিয়ে কমিটি করা হোক। আমি চ্যালেঞ্জ নিয়ে বলছি, ওই কমিটি যদি আমার এক টাকার দুর্নীতি পায়, তাহলে আমি সংসদ থেকে পদত্যাগ করবো।