শীতের আবাহনী বার্তা নিয়ে এলো হেমন্ত
নিজস্ব প্রতিবেদক, বাঙলার কাগজ ও ডন : ‘শুয়েছে ভোরের রোদ ধানের উপরে মাথা পেতে/ অলস গেঁয়োর মতো এইখানে কার্তিকের ক্ষেতে;/ মাঠের ঘাসের গন্ধ বুকে তার,—চোখে তার শিশিরের ঘ্রাণ,/ তাহার আস্বাদ পেয়ে অবসাদে পেকে ওঠে ধান...।’
বাংলার হেমন্তকাল ধূসর পাণ্ডুলিপির কবি জীবনানন্দ দাশেরই। ভোরের কাক হয়ে কিংবা শঙ্খচিল, শালিকের বেশে যিনি এই কার্তিকের নবান্নের দেশে ফেরার আকুতি জানিয়েছেন কবিতায়।
জীবনানন্দের সেই কার্তিকের আজ প্রথম দিন। আজ পয়লা কার্তিক, হেমন্তের শুরু। কার্তিক ও অগ্রহায়ণ—এই দুই মাস নিয়ে চিরায়ত হেমন্তকাল। শীতের আগমনী বার্তা নিয়ে ধীর পায়ে প্রকৃতিতে আসে হেমন্ত।
তবে পঞ্জিকার পাতায় যতই আজ দিন-তারিখ দিয়ে হেমন্ত শুরু হোক না কেন, প্রকৃতিতে ঋতুটি এসে গেছে এক সপ্তাহ কিংবা এর একটু আগেই। গত সপ্তাহে ঢাকা থেকে ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ হয়ে বাগেরহাট যাওয়া ও আসার পথে হেমন্তের আগমনের রং খানিকটা দেখা হলো। কুয়াশামাখা ভোর। দুপুরের পর রোদের তীব্রতা কমে একটু একটু শীতের পরশ। শীতল বাতাস। বিকেলগুলো যেন স্বল্পায়ু। সন্ধ্যা নামতেই শীত শীত মিষ্টি অনুভূতি।
এত কিছুর পরও শরৎ ও শীতের মাঝে এই হেমন্ত ঋতু কি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মনোজগতে কম ঠাঁই পেয়েছে? কবির কথায়, ‘আজি এল হেমন্তের দিন/ কুহেলীবিলীন, ভূষণবিহীন’। অর্থাৎ হেমন্তের না আছে শীতের কুহেলি বা কুয়াশা, না আছে শরতের নীলাকাশ-সাদা মেঘের ভূষণ। বলা হয়ে থাকে, বাংলায় শরৎ আসে নববধূর মতো।
আর হেমন্ত আসতে আসতে সেই নববধূ পুরোপুরি সেজে ওঠেন ধানের রঙে।
হেমন্তকাল ফসলের ঋতু। প্রথম মাস কার্তিক একসময় বাংলার ঘরে ঘরে অভাবের মাস হিসেবে পরিচিত ছিল। কার্তিকের সেই মঙ্গার কাল মানুষ পার করেছেন আগেই। অগ্রহায়ণ পুরোপুরি ধান কাটার মাস। মাঠে, কৃষকের বাড়িতে নতুন ধানের ঘ্রাণ। এ সময়েই সূচনা হয় নবান্ন উৎসবের। জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম গেয়েছেন, ‘উত্তরীয় লুটায় আমার—/ ধানের খেতে হিমেল হাওয়ায়।/ আমার চাওয়া জড়িয়ে আছে/ নীল আকাশের সুনীল চাওয়ায়।/ ভাঁটির শীর্ণা নদীর কূলে/ আমার রবি-ফসল দুলে,/ নবান্নেরই সুঘ্রাণে মোর/ চাষির মুখে টপ্পা গাওয়ায়।’
প্রকৃতিতে সব সময় সবকিছুই বইয়ের পাতার মতো হয় না। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পাল্টে গেছে ঋতু পরিবর্তনের আবহমানকালের পাণ্ডুলিপি। যেমন দেশের উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে হেমন্ত না আসতেই যেন শীত নেমে গেছে পাকাপাকিভাবেই। দুই দিন ধরে রাতে টিপটিপ বৃষ্টির মতো কুয়াশা ঝরেছে। সকাল পর্যন্ত কুয়াশায় ছেয়ে গেছে পুরো জেলা। ভিজে গেছে পিচঢালা পথ। গাছের পাতা, ধানের খেত আর ঘাসে চকচক করছে শিশিরবিন্দু। হেডলাইট জ্বালিয়ে চলাচল করছে যানবাহন। সূর্যের দেখা পাওয়া যাচ্ছে সকাল নয়টার পর। শনিবার সকালে তাপমাত্রা ছিল ২১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা সারা দেশের মধ্যে সর্বনিম্ন। স্বাভাবিক পোশাকে কাজে বের হওয়া চা-শ্রমিক তরিকুল ইসলাম বলছিলেন, কুয়াশা দেখে মনে হচ্ছে শীত এসে গেছে।
এখন নাগরিক কিংবা গ্রামীণ জীবনে নানা সংকটে হাঁসফাঁস অবস্থা মানুষের। চাল, ডাল, মাছ-মাংস, সবজিসহ নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি আর চারপাশে মানবিকতার সংকটে পড়ে মানুষ যেন পরিণত হয়েছে প্রাণহীন রোবটে। শরতের কোজাগরী পূর্ণিমার চাঁদ, হেমন্তের রূপমাধুর্য অনুভবের ফুরসত কোথায়! এর ওপর এ বছর বর্ষাকালটা ছিল প্রায় বৃষ্টিহীন। বৃষ্টির কিছুটা দেখা মিলল সেপ্টেম্বরে এসে। তার আগে আউশ-আমন খেতে দিতে হলো সেচের পানি, যা খরচ বাড়ালো কৃষকের।
তারপরও প্রতিকূলতাকে জয় করে টিকে থাকা মানুষ একটু সুযোগ পেলেই বন-পাহাড়ে, নদী-সাগরে আনন্দ ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন। এই হেমন্ত বেড়ানোরই মৌসুম। সংবাদপত্রের প্রতিবেদন বলছে, গত দুই সপ্তাহে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত ভ্রমণ করেছেন অন্তত আট লাখ পর্যটক।
করোনা মহামারি কমে এলেও এখন প্রাণঘাতী ডেঙ্গুর ভরা মৌসুম। সামনে শীতকালীন নানা রোগের চোখরাঙানি। এসব কিছু মনে রেখেই মানুষ হেমন্তের স্পর্শ নেবে। কারণ, হেমন্তের তীব্র আবেদন অনুভূতিসম্পন্ন কোনো মানুষই ভুলে থাকতে পারে না। বাংলায় হেমন্ত উদ্যাপিত হোক চিরাচরিত আনন্দের রঙে। হেমন্তের কবি জীবনানন্দের কবিতার মতো, ‘সেদিনো এমনি গেছে ঘরে/ প্রথম ফসল;—/ মাঠে-মাঠে ঝরে এই শিশিরের সুর,—/ কার্তিক কি অঘ্রানের রাত্রির দুপুর!—/ হলুদ পাতার ভিড়ে ব’সে,/ শিশিরে পালক ঘ’ষে-ঘ’ষে,/ পাখার ছায়ায় শাখা ঢেকে,/ ঘুম আর ঘুমন্তের ছবি দেখে-দেখে,/ মেঠো চাঁদ আর মেঠো তারাদের সাথে/ জেগেছিল অঘ্রানের রাতে/ এই পাখি!’