খুলনা থেকে আনসার আল ইসলামের জঙ্গি গ্রেপ্তার

খুলনা থেকে আনসার আল ইসলামের জঙ্গি গ্রেপ্তার

নিজস্ব সংবাদদাতা, বাঙলার কাগজ; খুলনা : খুলনায় র‌্যাবের অ‌ভিযানে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন ‘আনসার আল ইসলাম’ এর ৩ সক্রিয় সদস্যকে খুলনা থেকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব-৬। র‌্যাব এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানায়, পূর্বের মতো সারাদেশে একযোগে পরিকল্পিতভাবে নাশকতা সৃষ্টির সক্ষমতা না থাকলেও, সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে নাশকতা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালিয়ে আসছে জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা। তবে র‌্যাবের কঠোর গোয়েন্দা নজরদারি ও অভিযানের ফলে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা পুনরায় সংঘটিত হওয়ার চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হয়েছে এবং তাদেরকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে।

র‌্যাব জানায়, বৃহস্পতিবার (২৮ অক্টোবর) দিবাগত রাত দেড়টার সময় র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা এবং র‌্যাব-৬ এর একটি আভিযানিক দল গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে জানতে পারে যে, খুলনা জেলার বটিয়াঘাটা থানার সাচিবুনিয়া রেল ক্রসিং সংলগ্ন এলাকায় জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা একত্রে মিলিত হয়ে গোপন বৈঠক করছে। এরই প্রেক্ষিতে খুলনা জেলার বটিয়াঘাটা থানাধীন সাচিবুনিয়া রেল ক্রসিং সংলগ্ন একটি টিনসেড ঘরে অভিযান পরিচালনা করে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের ৩ জন আসামি : ১) ইলিয়াস দাস আব্দুল্লাহ ওরফে হুজাইফা উসামা (২৭), পিতা : জিতেন দাস, গ্রাম : উত্তর ঠাকুরগাঁও, থানা : সদর, জেলা : ঠাকুরগাঁও, ২) সাব্বিরুল ইসলাম সাব্বির ওরফে আবু সাব্বির আল বাঙালি (২০), পিতা : রবিউল ইসলাম, গ্রাম : খয়েরসুতি, থানা ও জেলা : পাবনা, ৩) শামিম লস্কর (১৯), পিতা : ইলিয়াস লস্কর, গ্রাম : কুলপাড়া, থানা : কোটালিপাড়া, জেলা : গোপালগঞ্জদের গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়। তাদের হেফাজত থেকে বিভিন্ন উগ্রবাদী বই, লিফলেট ও মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়। এ সময় অজ্ঞাত আরও ৩/৪ জন সদস্য পালিয়ে যায়।

গ্রেপ্তারকৃতদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তারা নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সদস্য। তারা আফগানিস্তানে তালেবানের উত্থানে উদ্বুদ্ধ হয়ে আল কায়েদা মতাদর্শের জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিলো। তারা বিভিন্ন সময় অনলাইনে বিভিন্ন উগ্রবাদী নেতার বক্তব্য দেখে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে সংগঠনের সদস্যদের মাধ্যমে ওই সংগঠনে যোগদান করে। পরে তারা নিজেরাই সংগঠনের সদস্য সংগ্রহে দাওয়াতি র্কাযক্রম পরিচালনা করছিলো। এ উদ্দেশ্যে সংগঠনের সদস্যদের তারা বিভিন্ন উগ্রবাদী পুস্তিকা, মুসলমানদের উপর নির্যাতন ও উগ্রবাদী নেতাদের বক্তব্যের ভিডিও সরবরাহ করতো। অন্যদিকে তারা সংগঠনের র্কাযক্রম পরিচালনার জন্য ভুল তথ্য প্রদান করে তাদের আত্মীয়-স্বজন, বিভিন্ন মাদরাসা ও সদস্যদের নিকট থেকে নিয়মিত অর্থ সংগ্রহ করতো। এর পাশাপাশি তারা মসজিদ, বাসা বা বিভিন্ন স্থানে সদস্যদের নিয়ে গোপন সভা পরিচালনা করে বিভিন্ন তথ্যের অপব্যাখ্যা ও মিথ্যা তথ্যের মাধ্যমে দেশের বিচার ও শাসন ব্যবস্থা সর্ম্পকে বিরূপ মনোভাব তৈরি করে তথাকথিত ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করার জন্য সদস্যদেরকে উগ্রবাদী করে তুলতো।

গ্রেপ্তারকৃত ইলিয়াস দাস আব্দুল্লাহ ওরফে হুজাইফা উসামার বাড়ি ঠাকুরগাঁও হলেও সে মিরপুরে অবস্থান করে একটি পণ্যের মার্কেটিংয়ে চাকরি করতো। সে একজন নব্য মুসলিম ছিলো। ২০১৮ সালে সে খ্রিস্টান ধর্ম ত্যাগ করে ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। প্রথমে ইন্টারনেটে বিভিন্ন দেশের নির্যাতিত মুসলমানদের উপর নির্যাতনের ভিডিও দেখে সে জিহাদে উদ্বুদ্ধ হয় এবং পরে পাশ্ববর্তী দেশের সমমনা একজনের সঙ্গে তার যোগাযোগ স্থাপিত হয়। ওই ব্যক্তি তাকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আনসার আল ইসলামের হয়ে সদস্য সংগ্রহ করে প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে দেশটিতে পাঠানোর সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করতো। হুজাইফা উসামা তার নিজ এলাকা ঠাকুরগাঁওয়ে ওই দাওয়াতি কাজ শুরু করে এবং বর্তমানে গ্রেপ্তার হওয়ার আগ পর্যন্ত ঠাকুরগাঁওয়ের দাওয়াতি শাখার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলো। ‘কিতাল ফি ছাবিলিল্লাহ’ নামে একটি মেসেঞ্জার গ্রুপের অ্যাডমিন এই হুজাইফা উসামা। এই গ্রুপে বিভিন্ন উগ্রবাদী ছবি, ভিডিও এবং কন্টেন্ট শেয়ার করে জঙ্গিদের উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ করা হতো। ঠাকুরগাঁও ছাড়াও সংগঠনের অন্যান্য জেলার সদস্যদের সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ ছিলো এবং মাঝেমধ্যেই সে অন্য জেলার সদস্যদের সঙ্গে গোপন বৈঠক করতো। সে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এবং বাইরে গাজোয়া-তুল হিন্দ প্রতিষ্ঠার নামে হিংসা-বিদ্বেষ ছড়াতো। পাশের দেশের উগ্র জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগের পাশাপাশি নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের জন্য সহমর্মিতা প্রকাশ করে বক্তব্য প্রদানকারী কয়েকজনের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে।

গ্রেপ্তারকৃত সাবিরুল ইসলাম সাব্বির ওরফে আবু সাব্বির আল বাঙালি একজন ছাত্র। তার বড়ি পাবনা জেলায়। সে পূর্বে গ্রেপ্তারকৃত আনসার আল ইসলামের দাওয়াতি শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত ইয়াকুব হুজুরের মাধ্যমে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়। সে ইয়াকুব হুজুরের সঙ্গে একাধিকবার দেশের বিভিন্ন স্থানে দাওয়াত ও বয়ান দেওয়ার জন্য গমন করেছে। তার সঙ্গে আনসার আল ইসলামের অন্য একটি দেশে অবস্থানরত মনিরুল ইসলামের যোগাযোগ রয়েছে। তাদের ভাষ্যমতে, গণতন্ত্র হচ্ছে কুফরি মতবাদ এবং এই গণতন্ত্রের নামে ভোটাভুটিও তাগুদের কাজ। তাই এই কুফরি কাজ নস্যাৎ করার জন্য তারা বদ্ধপরিকর ছিলো।

গ্রেপ্তারকৃত শামিম লস্করও একজন ছাত্র। সে ধৃত ইলিয়াস দাস আব্দুল্লাহ ওরফে হুজাইফা উসামার মাধ্যমে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে সংগঠনে যোগদান করে জঙ্গিদের দাওয়াতি কার্যক্রম করতে থাকে। সে তার নিজ এলাকা গোপালগঞ্জে দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করতো। এ ছাড়াও সে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সংগঠনের প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে সাধারণ মানুষকে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ করে আসছিলো। এ ছাড়াও সে তার নিজ এলাকা গোপালগঞ্জে দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি সংগঠনে নিয়মিত চাঁদা প্রদান এবং সংগঠনের অন্যান্য সদস্যদের নিকট হতে চাঁদা সংগ্রহ করতো।

গ্রেপ্তারকৃতদের সঙ্গে প্রাথমিকভাবে কথা বলে জানা যায়, তাদের সকলের নামেই পূর্বে জঙ্গি ও সন্ত্রাস বিরোধী আইনে মামলা রয়েছে। এ কারণে তারা বিভিন্ন সময় স্থান পরিবর্তন করে আত্মগোপনে ছিলো।

র‌্যাব আরও জানিয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘কেএনএফ’ এর সঙ্গে একত্রিত হয়ে পাহাড়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাধ্যমে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত জঙ্গি সংগঠন ‘জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ এর আমীর ও শীর্ষস্থানীয় জঙ্গি নেতাসহ প্রায় শতাধিক জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের প্রায় ৩ হাজার এবং হলি আর্টিজান হামলার পরবর্তী সময়ে প্রায় ২ হাজার জঙ্গিকে আইনের আওতায় নিয়ে এসেছে তাঁরা। যখনই জঙ্গিরা মাথাচাড়া দিয়েছে, তখনই র‌্যাব সাঁড়াশি অভিযানের মাধ্যমে জঙ্গিদের পরিকল্পনা ভেস্তে দিতে সক্ষম হয়েছে।