ডন প্রতিবেদক, বাংলা কাগজ; চাঁদপুর : কুমিল্লার ঘটনা নিয়ে ১৩ অক্টোবর বিকেলে ফেসবুকে ঘোষণা দেওয়া হয়, সন্ধ্যায় হাজীগঞ্জ বিশ্বরোড থেকে আন্দোলন হবে। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় ‘মুসলিম ভাইদের’ জড়ো হওয়ার অনুরোধ জানানো হয় এতে। এরপর সেখানে জড়ো হয়ে মিছিল শুরু করে একদল কিশোর-তরুণ। একপর্যায়ে বড় হতে থাকে মিছিলের আকার। পরে পূজামণ্ডপে হামলার ঘটনা ঘটে।
খোঁজ নিয়ে স্থানীয় সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে, চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ পৌর এলাকার বাসিন্দা হৃদয় হাসান ওরফে জাহিদ (২০) ওই স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। তিনি হাজীগঞ্জ পৌর ছাত্রলীগের কর্মী। তাঁর মা শাহিদা বেগম ২০১৪-২০১৯ মেয়াদে হাজীগঞ্জ পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের নারী কাউন্সিলর ছিলেন। আওয়ামী লীগের সমর্থনে তিনি নির্বাচনে জিতেছেন। পুলিশ জানায়, হামলার ঘটনায় হৃদয় হাসানের বাবা দিলওয়ার হোসেন (৪২) ও ভাই জুবায়ের হোসেনকে (১৮) গত সোমবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হাজীগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ইউনুস মিয়ার করা মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশ বলছে, ঘটনার পর থেকে হৃদয় পলাতক।
স্থানীয় সূত্র ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হৃদয় হাসানের স্ট্যাটাসের পর সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা থেকে রাত সাড়ে আটটার মধ্যে সেখানে ১৫ থেকে ২২ বছর বয়সী একদল কিশোর-তরুণ জড়ো হয়। যাদের বেশির ভাগই স্থানীয়ভাবে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য হিসেবে পরিচিত। রাত আটটার দিকে তারা মিছিল শুরু করে। হাজীগঞ্জ পৌর এলাকার প্রধান সড়ক ধরে মিছিলটি শ্রীশ্রী রাজালক্ষ্মী নারায়ণ জিউর আখড়ার সামনে দিয়ে দুই দফা চক্কর দেয়। ওই সময় সেখানকার পূজামণ্ডপে প্রায় দেড় হাজার সনাতন ধর্মাবলম্বী উপস্থিত ছিলেন। মিছিল শুরুর সময় পুলিশ সদস্যরা পূজামণ্ডপের সামনে অবস্থান নেন।
স্থানীয় সূত্র জানায়, ধীরে ধীরে মিছিলে লোক বাড়তে থাকে। বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমর্থক ও স্থানীয় কিছু উৎসাহী মানুষ এতে যোগ দেন। হাজীগঞ্জের বিভিন্ন গ্রাম থেকে আসা কিশোর–তরুণেরাও মিছিলে যোগ দেওয়া শুরু করে। একপর্যায়ে মিছিলে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় দুই হাজারে। পূজামণ্ডপের সামনে গিয়ে হঠাৎ মিছিল থেকে ইট ছোড়া শুরু করে কিছু কিশোর-তরুণ। স্থানীয় কয়েকজন বয়োজ্যেষ্ঠ তাদের থামানোর চেষ্টা করেও পারেন নি।
সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে স্থানীয় দিলীপ কুমার সাহা বলেন, হামলার সময় উৎসবের মেজাজে থাকা পূজামণ্ডপে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্র জানায়, মিছিল বড় হতে দেখে হাজীগঞ্জ থানার পুলিশ সেখানকার ছয়টি পূজামণ্ডপে অবস্থান নেয়। কেন্দ্রীয় মণ্ডপের সামনে ছিল মিছিলের সবচেয়ে বড় অংশ। আটটা থেকে সাড়ে আটটার মধ্যে একযোগে ছয়টি মণ্ডপে হামলা চালানো হয়। পুলিশ প্রথমে লাঠিপেটা করে মিছিলকারীদের থামানোর চেষ্টা করে। এরপর ১০৯টি রাবার বুলেট ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হয়। পরে পুলিশ গুলি ছোড়ে। এতে ঘটনাস্থলে মারা যান চারজন। তাঁদের বয়স ২৩ বছরের মধ্যে। সেদিনের ঘটনায় গুলিবিদ্ধ আরেকজন গতকাল মারা গেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা অভিযোগ করেছেন, মিছিলে নেতৃত্ব দেওয়া কিশোর ও তরুণেরা পৌর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসানের অনুসারী। হাজীগঞ্জ পৌরসভার মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহবুব-উল-আলমও বলেন, হামলাকারীদের মধ্যে মেহেদী হাসানের অনুসারীও ছিলেন বলে তিনি শুনেছেন। তবে তিনি নিশ্চিত নন। তিনি আরও বলেন, তাঁরা হামলা ঠেকানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন।
জানতে চাইলে অভিযোগ অস্বীকার করে মেহেদী হাসান বলেন, ‘আমার পৌর ছাত্রলীগের কমিটির কেউ হামলায় ও মিছিলে অংশ নিলে তার দায়দায়িত্ব আমি নেব। আমি একটু দাপটের সঙ্গে রাজনীতি করায় অনেকে আমার বিরুদ্ধে ঈর্ষাণ্বিত হয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘হাজীগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি খোকন বলির অনুসারী ও পরিবারের সদস্যরা হামলায় অংশ নিয়েছেন, সেই প্রমাণ আমাদের কাছে আছে। আমরা উল্টো হামলা থামানোর চেষ্টা করেছি।’
‘আন্দোলনের’ ডাক দেওয়া হৃদয় হাসান ছাত্রলীগের কর্মী কি না, এ প্রশ্নের জবাবে মেহেদী হাসান বলেন, ছাত্রলীগ অনেক বড় সংগঠন। হৃদয় ছাত্রলীগের কর্মী কি না, তা তিনি জানেন না।
স্থানীয় সূত্র জানায়, খোকন বলির পরিবারের একাধিক সদস্য ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত। তাঁরা হামলায় অংশ নিয়েছিলেন বলে স্থানীয়ভাবে অভিযোগ আছে। তাঁরা বর্তমানে পলাতক।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে খোকন বলির মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে তা বন্ধ পাওয়া যায়।
হাজীগঞ্জ থানা সূত্র জানায়, হামলার ঘটনায় মামলা হয়েছে তিনটি। ওই ঘটনায় এ পর্যন্ত ১৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে আটজনের বয়স ২৩ বছরের মধ্যে। পাঁচজনের বয়স ৩০–এর মধ্যে। অন্যরা ৩৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সী।
পুলিশের হাজীগঞ্জ সার্কেলের এএসপি ও হামলার ঘটনায় জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে গঠন করা তদন্ত কমিটির সদস্য সোহেল মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের কাছে পূজামণ্ডপে হামলাকারীর কিছু ভিডিও ফুটেজ এসেছে। আমরা সেটা দেখে দেখে হামলাকারীদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করছি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়ে যাঁরা হামলার উসকানি দিয়েছেন, তাঁদেরও আমরা চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করছি।’
হাজীগঞ্জের ঘটনা তদন্তে চাঁদপুর জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ১৫ অক্টোবর গঠিত হওয়া কমিটি হামলার সঙ্গে জড়িত বেশ কয়েকজন জামায়াতের রোকন ও বেশ কয়েকজন হেফাজত কর্মীকে চিহ্নিত করেছে।
জানা গেছে, কমিটিকে এক সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছিল। তবে তদন্ত শেষ করতে আরও কিছু সময় চেয়েছে কমিটি। বেশ কিছু নতুন সূত্র পাওয়ায় ও আরও কিছু তথ্য অনুসন্ধানের জন্য কমিটি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে পারছে না।