জেকেজির জালিয়াতি : আরিফুল ও সাবরীনাসহ ৮ আসামির ১১ বছর করে সাজা।
নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলা কাগজ : করোনাভাইরাস পরীক্ষা নিয়ে জালিয়াতির দায়ে জেকেজি হেলথকেয়ারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আরিফুল হক চৌধুরী, তাঁর স্ত্রী ডা. সাবরীনা চৌধুরীসহ ৮ আসামির সবাইকে ১১ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।
ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম তোফাজ্জল হোসেন মঙ্গলবার (১৯ জুলাই) আসামিদের উপস্থিতিতে আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণা করেন।
তিনি বলেন, ‘এ মামলায় একই অভিপ্রায় নিয়ে সকল আসামি ঘটনা ঘটিয়েছে। তাই সকলেই একইভাবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছে।’
মহামারির প্রথম বছর জেকেজির জালিয়াতির ঘটনাগুলো প্রকাশ্যে এলে সারাদেশে আলোড়ন তৈরি হয়। এর সঙ্গে সরকারি চাকরিতে থাকা চিকিৎসক সাবরীনার যোগসাজশ বিষয়টিকে নতুন মাত্রা দেয়।
রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের চাকরিচ্যুত চিকিৎসক ডা. সাবরীনা বলেন, ‘আমি চেয়ারম্যান ছিলাম না, এই সাজা কীভাবে হলো? আপিলের কথা তো পরে। কী হবে বুঝতে পারছিলাম, কিন্তু এতোটা হবে বুঝতে পারি নি।’
সাবরীনা ও তাঁর স্বামী আরিফুল ছাড়া মামলার বাকি ৬ আসামি হলেন : আরিফুলের বোন জেবুন্নেছা রিমা, সাবেক কর্মচারী হুমায়ুন কবির হিমু ও তাঁর স্ত্রী তানজিলা পাটোয়ারী, জেকেজির কোঅর্ডিনেটর আবু সাঈদ চৌধুরী, জেকেজির কর্মচারী বিপুল দাস এবং শফিকুল ইসলাম রোমিও।
বিচারক তাঁর রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেন, কোভিড-১৯ মহামারি রাষ্ট্র এবং জনগণ সকলের জন্যই ছিলো একটি দুর্যোগ। সেই দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকার কিছু হাসপাতালকে বিনামূল্যে করোনা পরীক্ষার দায়িত্ব প্রদান করে। যেসব শর্তে করোনা পরীক্ষার দায়িত্ব পেয়েছে জেকেজি হেলথ কেয়ার, সেসব শর্ত লঙ্ঘন করে লাভবান হতে প্রতারণা, জাল রিপোর্ট তৈরি এবং জাল প্রত্যয়নপত্রকে খাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে দণ্ডবিধির ৪২০, ৪৬৬ ও ৪৭১ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।’
এদিকে এই রায়কে স্বাগত জানালেও আরও বেশি সাজা না হওয়ায় আপিল করার ভাবনার কথা বললেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এবং মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর আজাদ রহমান।
রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, ‘যে সাজা হয়েছে, তাতে কয়েকটি অভিযোগে আসামিরা খালাস পেয়েছেন। যেসব ধারায় দণ্ড হয়েছে, তাতে আরও বেশি সাজা হতে পারতো। খালাস বা অপর্যাপ্ত দণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে কি-না, তা পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার পর আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা মনে করছেন, এই রায়ে তাঁদের মক্কেলরা ন্যায়বিচার থেকে ‘বঞ্চিত হয়েছেন’।
আসামিপক্ষের অন্যতম আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ বলেন, রায়ে আদালত কোনও পর্যবেক্ষণ দেন নি, তবে সাক্ষ্য প্রমাণে এসেছে, জেকেজি ‘বৈধ প্রতিষ্ঠান’। এখন বলছে যে, আমরা জাল সার্টিফিকেট দিয়েছি। বাদিসহ ভিকটিম যাঁদেরকে আমরা চিকিৎসা দিয়েছি, তাঁরা কেউ তাঁদের কোনও সার্টিফিকেটের কপি আদালতে দাখিল করেন নি। তাঁরা ই-মেইলের মাধ্যমেও কপি দেন নি। তদন্তকারী কর্মকর্তা কিছু কাগজ নিয়ে এসে বলছে, এগুলো নাকি ফটোকপি। ফটোকপি তো সাক্ষ্য আইনে গ্রহণযোগ্য নয়।
তিনি আরও বলেন, ‘এখানে কোনও প্রমাণ না থাকার পরও বিজ্ঞ আদালত আমাদের সাজা দিয়েছেন। আমরা মনে করি, আমাদের প্রতি অন্যায় করা হয়েছে, অবিচার করা হয়েছে এবং একটা পক্ষকে খুশি করা হয়েছে।’
মামলার বৃত্তান্ত : দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্যে ২০২০ সালের মার্চে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আবেদন করে পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহের দায়িত্ব নিয়েছিলো ওভাল গ্রুপের প্রতিষ্ঠান জেকেজি হেলথকেয়ার।
কিন্তু জুনের শেষদিকে অভিযোগ আসে, সরকারের কাছ থেকে বিনামূল্যে নমুনা সংগ্রহের অনুমতি নিয়ে বুকিং বিডি ও হেলথকেয়ার নামে দুটি সাইটের মাধ্যমে টাকা নিচ্ছিলো জেকেজি। নমুনা পরীক্ষা না করে রোগীদের ভুয়া সনদও দিচ্ছিলো তাঁরা।
রাজধানীর কল্যাণপুরের কামাল হোসেন নামে এক ব্যক্তির অভিযোগের সত্যতা পেয়ে গত ২২ জুন জেকেজি হেলথ কেয়ারের সাবেক গ্রাফিক ডিজাইনার হুমায়ুন কবীর হিরু ও তাঁর স্ত্রী তানজীলাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
পরে তাঁদের কম্পিউটার থেকে ৪ জন প্রবাসীসহ ৪৩ জনের নামে তৈরি করা করোনাভাইরাস পরীক্ষার ভুয়া সনদ পাওয়া যায়।
পরদিন কামাল হোসেন বাদি হয়ে তেজগাঁও থানায় একটি মামলা করেন ওই দুইজনের বিরুদ্ধে। সরকারি নাম ব্যবহার করে টাকা আত্মসাৎ, কাজে অবহেলার মাধ্যমে জীবন বিপন্নকারী রোগের সংক্রমণ বিস্তারের ঝুঁকি তৈরি, করোনাভাইরাসের সনদ জালিয়াতির অভিযোগ আনা হয় সেখানে।
হুমায়ুন ও তাঁর স্ত্রীর কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পরে তেজগাঁও থানা পুলিশ জেকেজির সিইও আরিফুল চৌধুরী, তাঁর বোন জেবুন্নেছাসহ ৭ জনকে গ্রেপ্তার করে।
পরে ১২ জুলাই জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক ডা. সাবরীনাকেও গ্রেপ্তার করা হয়।
সরকারি চাকরিতে থাকা অবস্থায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জেকেজির সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
প্রায় ২ মাস তদন্ত শেষে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক লিয়াকত আলী ১৩ আগাস্ট অভিযোগপত্র দেন। নমুনা পরীক্ষা না করেই ২৭ হাজার মানুষকে ভুয়া রিপোর্ট দেওয়ার অভিযোগ আনা হয় সেখানে।
অভিযোগপত্রে সাবরীনা ও আরিফকে জালিয়াতির হোতা বলে উল্লেখ করা হয়। আর বাকি আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁরা ওই জালিয়াতিতে ‘সহযোগিতা’ করেছেন।
ওই বছর ২০ আগস্ট দণ্ডবিধির ১৭০/২৬৯/৪২০/৪০৬/৪৬৬/৪৬৫/৪৭১/৩৪ ধারায় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ঢাকার মহানগর হাকিম সারাফুজ্জামান আনছারী।
গত ২০ এপ্রিল এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। অভিযোগপত্রের ৪০ জন সাক্ষীর মধ্যে ২৬ জন বিভিন্ন সময়ে সাক্ষ্য দেন। পরে ১১ মে আত্মপক্ষ সমর্থনে আসামিরা নিজেদের নির্দোষ দাবি করে ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করেন।
রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে গত ২৯ জুন মামলাটি রায়ের পর্যায়ে আসে।
কোন ধারায় কী সাজা : এ মামলায় দণ্ডবিধির ১৭০ ধারায় সরকারি কর্মচারীর ভুয়া পরিচয় ব্যবহার, ২৬৯ ধারায় বিপজ্জনক রোগের সংক্রমণ ছড়াতে পারে জেনেও অবহেলা, ৪০৬ ধারায় অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ, ৪২০ ধারায় প্রতারণা, ৪৬৫ ধারায় জালিয়াতি, ৪৬৬ ধারায় সরকারি নথি জাল, ৪৭১ ধারায় জাল দলিলকে খাঁটি হিসেবে দেখানোর অভিযোগ আনা হয়েছিলো।
এর মধ্যে ৪২০ ধারায় আসামিদের ৩ বছর করে কারাদণ্ড এবং ৩ হাজার টাকা করে জরিমানা করেছেন আদালত। জরিমানা অনাদায় আরও ৩ মাস কারাভোগ করতে হবে তাঁদেরকে।
দণ্ডবিধির ৪৬৬ ধারায় ৮ আসামির প্রত্যেককে ৪ বছর করে কারাদণ্ড এবং ৪ হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায় আরও ৪ মাসের সাজা দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া দণ্ডবিধি ৪৭১ ধারায় ৪ বছর করে কারাদণ্ড এবং ৪ হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরও ৪ মাসের সাজা দেওয়া হয়েছে।
৩ ধারার সাজা পর্যায়ক্রমে কার্যকর হবে; ফলে তাদের সবাইকে ১১ বছর করে জেলে কাটাতে হবে। এ সাজা থেকে হাজতবাসের সময় বাদ যাবে।
দণ্ডবিধির ১৭০, ২৬৯, ৪০৬ ও ৪৬৫ ধারায় অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় এসব ধারায় আসামিদের খালাস দেওয়া হয়েছে রায়ে।
আসামিপক্ষের অন্যতম আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ রায়ের পর সাংবাদিকদের বলেন, ‘এই মামলায় ৩টি ধারায় আলাদাভাবে সাজা দেওয়া হয়েছে। সাধারণত পৃথক অভিযোগে সাজা হলে সবচেয়ে বেশি মেয়াদের দণ্ড ভোগ করতে হয়। কিন্তু এখানে বলা হয়েছে, সাজাগুলো একটার পর একটা চলবে, ফলে তাদের ১১ বছর সাজা ভোগ করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ ধরনের রায় আমরা আগে কখনো দেখি নি। আমরা মনে করি, উচ্চ আদালতে গেলে এই বিষয়টার সমাধান হয়ে যাবে।’