জঙ্গিবাদের প্রশিক্ষণ নিতে যাওয়া ২ জন এক মাস হেঁটে আসেন পাহাড় থেকে সমতলে
নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলার কাগজ ও ডন : নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল ইন্দাল শারক্বীয়ার দুই সদস্য পালিয়ে প্রায় এক মাস হেঁটে পাহাড় থেকে সমতলে আসেন। তারা এক বছর ধরে নতুন জঙ্গি সংগঠনের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। সমতলে আসার পর গোয়েন্দা নজরদারির ভিত্তিতে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের হাতে গ্রেপ্তার হন এই দুই জঙ্গি।
গ্রেপ্তাররা হলেন— সাইফুল ইসলাম তুহিন (২১) এবং মো. নাঈম হোসেন (২২)। তাদের মধ্যে তুহিনের বাড়ি সিলেটে ও নাঈমের বাড়ি চাঁদপুরে।
বৃহস্পতিবার (২২ ডিসেম্বর) দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সিটিটিসি প্রধান আসাদুজ্জামান।
তিনি বলেন, কুকি-চিনের সাহায্যে নতুন জঙ্গি সংগঠন পার্বত্য অঞ্চলে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প তৈরি করেছিলো। প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালায়। অভিযানের ফলে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অভিযানে নতুন জঙ্গি সংগঠনটির অনেক সদস্য গ্রেপ্তার হয়, অনেকে আবার গ্রুপে গ্রুপে পাহাড়ে অবস্থান নেয়। আবার কেউ কেউ সমতলে ফিরে আসার চেষ্টা করে এবং পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে। পাহাড় থেকে সমতলে আসা এমনই দুই জঙ্গিকে গ্রেপ্তারের করেছে সিটিটিসি। গ্রেপ্তার দুইজন পাহাড়ের ক্যাম্পে প্রায় এক বছর প্রশিক্ষণ নিয়েছিলো।
গ্রেপ্তারদের জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে আসাদুজ্জামান বলেন, নতুন জঙ্গি সংগঠনের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে অনেকেই স্বেচ্ছায় গেলেও অনেককে মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে নেওয়া হয়েছে। ক্যাম্পে গিয়ে অনেকেই ফিরে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শত চেষ্টা করেও সেখান থেকে বের হতে পারেন নি। সিলেট থেকে সাইফুল ইসলাম ২০২১ সালের ১৫ নভেম্বর হিজরতের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যান। সাইফুল ইসলাম একটি কওমি মাদরাসায় পড়তেন। সেখানের একজন ইমামের মাধ্যমে তিনি উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে হিজরতে যান। তবে হিজরতে গিয়ে কি করবেন সেটি সাইফুল জানতেন না।
তিনি বলেন, ১৫ নভেম্বর সিলেট থেকে একটি মাইক্রোবাসে সাইফুলসহ তিনজন প্রথমে ঢাকায় আসেন। ঢাকায় তাদের আরও চারজন হিজরতকারীর সঙ্গে দেখা হয়। সেখান থেকে তারা বাসে করে বান্দরবানের দিকে রওনা হন। রাস্তায় তাদের ফোন ও বাসা থেকে নিয়ে আসা টাকা সংগঠনটির এজেন্ট তাদের কাছ থেকে নিয়ে নেয়। তাদের বলা হয়েছিল, সেখানে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি তারা ব্যবসাও করতে পারবেন, তাই তারা টাকা নিয়ে এসেছিলেন। যাত্রা পথে তাদের চুল ও দাড়ি কেটে ফেলা হয়। পরে সাইফুল ইসলাম বান্দরবানে গিয়ে দেখেন, তাদের সঙ্গে একই বাসে আরও ১০ জন হিজরতকারী এসেছিলেন। বান্দরবান থেকে তারা থানচি যান, সেখান থেকে এক রাতে ১২ ঘণ্টা হেঁটে প্রথম প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে পৌঁছান।
ডিএমপির এই কর্মকর্তা বলেন, অন্যদিকে মো. নাঈম হোসেন রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ সেমিস্টারের ছাত্র ছিলেন। করোনার সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় তিনি বাড়ি চলে যান। বাড়ি গিয়ে বিশুদ্ধভাবে কোরআন শেখার জন্য একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভর্তি হন। সেই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের এক হুজুরের মাধ্যমে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয় নাঈম। পরে তিনি ঢাকায় হলে চলে আসেন। হল থেকে তিনি কাউকে কিছু না বলে গত বছরের অক্টোবর মাসের ২ তারিখে কুমিল্লায় সেফ হাউজে চলে যান। সেখান থেকে নাঈম একইভাবে আরও ৮-১০ জনের সঙ্গে থানচি হয়ে পাহাড়ের প্রশিক্ষণ শিবিরে চলে যান।
ডিএমপির এই অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, ক্যাম্পে ডেইলি রুটিন মোতাবেক সামরিক কায়দায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো হিজরতকারীদের। সারাদিন তারা বিভিন্ন শারীরিক ও অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিতেন, রাতে তাদের সংগঠনের বিভিন্ন সিনিয়র নেতারা বয়ান দিত। এই বয়ানের মাধ্যমে তারা অল্প কিছুদিনের মধ্যে বুঝতে পারেন, শামিন মাহফুজ এই সংগঠনের প্রধান। শামিন মাহফুজ ক্যাম্পের যেই কক্ষে থাকতেন সেখানে সশস্ত্র পাহারা থাকতো। কুকি-চিনের প্রধান নাথান বম মাঝেমধ্যে ক্যাম্পে এলে শুধু শামিন মাহফুজের কক্ষে গিয়ে আলোচনা করতেন। প্রথম ক্যাম্পটিতে ৭-৮ দিন প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর শামিন মাহফুজ সিদ্ধান্ত নেয় তারা মিজোরাম সীমান্ত লাগোয়া কোনও পাহাড়ে নয়তো মিজোরামের ভেতরে কোথাও প্রশিক্ষণ ক্যাম্প করবে। কিন্তু সেখানে যেতে না পেরে, তারা ফিরে আসে। এটি কুকি-চিনের ক্যাম্প ভেবে পরে তাদের ক্যাম্পে একদিন জেএসএস হামলা করে। এরপর শামিন মাহফুজ সেখান থেকে আরেকটি পাহাড়ে গিয়ে দ্বিতীয় প্রশিক্ষণ ক্যাম্প করেন।
আসাদুজ্জামান আরও জানান, এরই মধ্যে সাইফুল ইসলাম তুহিনসহ সিলেট থেকে আসা তিনজন এই প্রশিক্ষণের সঙ্গে একমত পোষণ না করে বিদ্রোহ করেন। তারা সেখান থেকে ফিরে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাদের বিদ্রোহের বিষয়টি টের পেয়ে তাদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালায় সংগঠনটির কমান্ডাররা। তাদের সারাদিন গাছের সঙ্গে বেঁধে নির্যাতন করা হতো এবং দোররা মারা হতো। পরে একপর্যায়ে তারা নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে আবার সংগঠনের কার্যক্রমে ফিরে আসতে চান। পরে তাদের দিয়ে সারাদিন ক্যাম্পের সব কাজ করানো হতো।
তিনি বলেন, পরে অক্টোবর মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা যখন পাহাড়ের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে অভিযান চালায়, তখন জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পাহাড়ে ছড়িয়ে পড়ে। এই গ্রুপ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সাইফুল ও নাঈম হাঁটতে হাঁটতে একটি মার্মা গ্রামে গিয়ে উঠেন। পরে ওই গ্রামের লোকজন তাদের ধরে কুকি-চিনের কাছে দিয়ে দেয়। কুকি-চিন তাদের পরিচয় জানতে পেরে একমাস আটকে রেখে নির্যাতন করে। পরে কুকি-চিন বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করে নাঈম ও সাইফুলকে ছেড়ে দেয়। শেষে তারা সূর্য ও বাড়িঘর দেখে দেখে দিক নির্ণয় করে একমাস হেঁটে বান্দরবান শহরে এসে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন। ২৫ নভেম্বরে তারা বান্দরবানে আসেন। এরই মধ্যে আমাদের গোয়েন্দা নজরদারিতে তাঁদের সন্ধান পাওয়া যায়। গোয়েন্দা নজরদারির এক পর্যায়ে বুধবার (২১ ডিসেম্বর) সিলেট থেকে সাইফুল ইসলাম ও ঢাকা থেকে নাঈমকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের আদালতে রিমান্ড আবেদন করে পাঠানো হয়েছে। রিমান্ডে নিয়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য তাঁদের কাছ থেকে জানা হবে।
নতুন জঙ্গি সংগঠনের প্রধান শামিন মাহফুজ ও তার পরিবার কোথায়— জানতে চাইলে আসাদুজ্জামান জানান, এ বিষয়ে আমদের তদন্ত চলছে।