জাতিসংঘের ভাষণে প্রধানমন্ত্রী : যুদ্ধ ও স্যাংশন বন্ধ করুন
মাজহারুল আনোয়ার খান, বাসস : প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা সঙ্কট ও বিরোধ নিরসনে সংলাপের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে শান্তিপূর্ণ বিশ্ব গড়তে অস্ত্র প্রতিযোগিতা, যুদ্ধ ও নিষেধাজ্ঞা বন্ধ করতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘বিশ্ব বিবেকের কাছে আমার আবেদন, অস্ত্র প্রতিযোগিতা, যুদ্ধ, স্যাংশন বন্ধ করুন। শিশুকে খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও নিরাপত্তা দিন। শান্তি প্রতিষ্ঠা করুন।’
জাতিসংঘ সদর দপ্তরে সাধারণ পরিষদের ৭৭তম অধিবেশনে স্থানীয় সময় শুক্রবার (২৩ সেপ্টেম্বর) প্রদত্ত ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এ আহ্বান জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুদ্ধ অথবা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, পাল্টা-নিষেধাজ্ঞার মত বৈরীপন্থা কখনও কোনও জাতির জন্য মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না। পারস্পরিক আলাপ-আলোচনাই সঙ্কট ও বিরোধ নিষ্পত্তির সর্বোত্তম উপায়।
তিনি বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি যে, সংঘাতের মূল কারণগুলো সমাধান না করে আমরা শান্তি বজায় রাখতে পারি না।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ইউক্রেন ও রাশিয়ার সংঘাতের অবসান চাই। নিষেধাজ্ঞা, পাল্টা-নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে একটি দেশকে শাস্তি দিতে গিয়ে নারী, শিশুসহ ও গোটা মানবজাতিকেই শাস্তি দেওয়া হয়। এর প্রভাব কেবল একটি দেশেই সীমাবদ্ধ থাকে না বরং সকল মানুষের জীবন-জীবিকা মহাসঙ্কটে পতিত হয়। মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়। মানুষ খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। বিশেষ করে, শিশুরাই বেশি কষ্ট ভোগ করে। তাঁদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে হারিয়ে যায়।
তিনি বলেন, আমরা দেখতে চাই, একটি শান্তিপূর্ণ বিশ্ব-যেখানে থাকবে বর্ধিত সহযোগিতা, সংহতি, পারস্পরিক সমৃদ্ধি এবং ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা। আমাদের একটি মাত্র পৃথিবী এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এই গ্রহকে আরও সুন্দর করে রেখে যাওয়া আমাদের দায়িত্ব।
কোভিড-১৯ মহামারি প্রাদুর্ভাবের পর এই প্রথম ১৯৩টি সদস্য দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের সশরীরে উপস্থিতির মাধ্যমে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৭তম অধিবেশন ১৩ থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে সংস্থার সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
শেখ হাসিনা বলেন, এই অধিবেশন এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যখন খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সঙ্গে বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তন, সহিংসতা ও সংঘাত, কোভিড-১৯ মহামারির মতো একাধিক জটিল এবং বহুমাত্রিক প্রতিকূলতায় পৃথিবী নামক আমাদের এই গ্রহ জর্জরিত। মানবিক চাহিদা গভীর হচ্ছে, জলবায়ু লক্ষ্যগুলো মূলত অপূর্ণ থেকে যাচ্ছে, বৈষম্য আরও প্রকট হচ্ছে।
তিনি বলেন, বিশ্ব নেতারা সাধারণ পরিষদ হলে ব্যক্তিগতভাবে বিবৃতি বিনিময় করবেন, ‘একটি সঙ্কটপূর্ণ সন্ধিক্ষণ: আন্তঃসংযুক্ত প্রতিকূলতাসমূহের রূপান্তরমূলক সমাধান’ শীর্ষক এবারের প্রতিপাদ্যটি এ সকল প্রতিকূলতা মোকাবিলায় এবং আমাদের অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করে শান্তিপূর্ণ ও টেকসই পৃথিবী গড়ে তোলার উপায় খুঁজে বের করার জন্য সকলের ঐক্যবদ্ধ আকাঙ্ক্ষার প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। আর এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমাদের এখনই সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে।
শেখ হাসিনার ভাষণে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, শান্তি ও স্থিতিশীলতা, জলবায়ু পরিবর্তন, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা, কোভিড-১৯ মহামারি এবং অভিবাসন বিষয়ক বৈশ্বিক ও বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গি উল্লেখযোগ্যভাবে স্থান পেয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, গত আড়াই বছরে বিশ্ব যখন করোনাভাইরাস মহামারির বিধ্বংসী প্রভাব থেকে পুনরুদ্ধার করতে শুরু করেছে, তখন রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত বিশ্বকে একটি সম্মিলিত অনিশ্চয়তায় নিমজ্জিত করেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের ক্ষেত্রে সহায়তা-প্রার্থী ঝঁকিপূর্ণ দেশগুলো এখন আরও প্রতিকূলতার মুখে পড়েছে। বর্তমানে আমরা এমন একটি সঙ্কটময় সময় অতিক্রম করছি, যখন অতীতের যে কোনও সময়ের চেয়ে অধিক পারস্পরিক সংহতি প্রদর্শন করা আবশ্যক।
তিনি বলেন, আমাদের প্রমাণ করতে হবে যে, সঙ্কটের মুহূর্তে বহুপাক্ষিক ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হলো জাতিসংঘ। তাই সর্বস্তরের জনগণের বিশ্বাস ও আস্থা অর্জনের জন্য জাতিসংঘকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে সকলের প্রত্যাশা পূরণে কাজ করতে হবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে, ‘গ্লোবাল ক্রাইসিস রেসপন্স গ্রুপ’ গঠন করায় জাতিসংঘের মহাসচিবকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই গ্রুপের একজন চ্যাম্পিয়ন হিসেবে, আমি বর্তমান পরিস্থিতির গুরুত্ব ও সঙ্কটের গভীরতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি বৈশ্বিক সমাধান নিরূপণ করতে অন্যান্য বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি।’
শেখ হাসিনা জাতির পিতার রেখে যাওয়া পররাষ্ট্র নীতি ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’ এর উল্লেখ করে বলেন, বাংলাদেশ জন্মলগ্ন থেকেই এই প্রতিপাদ্য-উদ্ভূত জোটনিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করে আসছে।
১৯৭৪ সালের ২৫-এ সেপ্টেম্বর এই মহান পরিষদে জাতির পিতা প্রদত্ত ভাষণের একটি চুম্বকাংশ তিনি উদ্ধৃত করেন। জাতির পিতা বলেছিলেন, ‘শান্তির প্রতি যে আমাদের পূর্ণ আনুগত্য তা এই উপলব্ধি থেকে জন্মেছে যে, একমাত্র শান্তিপূর্ণ পরিবেশেই আমরা আমাদের কষ্টার্জিত জাতীয় স্বাধীনতার ফল আস্বাদন করতে পারবো এবং ক্ষুধা, দারিদ্র্য, রোগ-শোক, অশিক্ষা ও বেকারত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য আমাদের সকল সম্পদ ও শক্তি নিয়োগ করতে সক্ষম হবো।’
তিনি বলেন, বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই বক্তব্য এখনও সমভাবে প্রাসঙ্গিক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্বাস করতেন যে, শান্তি হলো বিশ্বের সকল নারী-পুরুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার বাস্তব প্রতিরূপ। যুদ্ধের ফলে মানবজাতি, বিশেষ করে শিশু ও নারীরা চরম কষ্ট ভোগ করে। কত মানুষ রিফিউজি হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশে কোভিড-১৯ মহামারির শুরু থেকে এ সঙ্কট মোকাবিলায় বাংলাদেশ মূলত তিনটি বিষয়ের দিকে লক্ষ্য রেখে কৌশল নির্ধারণ করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রথমত, মহামারি সংক্রমণ ও বিস্তাররোধ করতে আমরা জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা প্রসারিত করেছি। দ্বিতীয়ত, আমাদের অর্থনীতিকে সুরক্ষিত রাখতে কৌশলগত আর্থিক প্রণোদনা প্রদান করেছি; এবং তৃতীয়ত, আমরা জনগণের জীবিকা সুরক্ষিত রেখেছি।
‘এসব উদ্যোগ মহামারিজনিত মৃত্যুর সংখ্যা হ্রাস করার পাশাপাশি মানুষের দুর্ভোগ কমাতে সাহায্য করেছে,’ বলেন তিনি।
রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে জাতিসংঘের কার্যকর ভূমিকা রাখার পাশাপাশি বিশ্ব নেতাদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০১৭ সালে স্বদেশ থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে তাঁদের গণহারে বাংলাদেশে প্রবেশের ইতোমধ্যে পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে প্রত্যাবাসনের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ তৈরীতে দ্বিপাক্ষিক, ত্রিপাক্ষিক এবং জাতিসংঘসহ অন্যান্য অংশীজনদের নিয়ে আলোচনা সত্ত্বেও একজন রোহিঙ্গাকেও তাঁদের মাতৃভূমিতে ফেরত পাঠানো যায় নি। মিয়ানমারে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সশস্ত্র সংঘাত বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনকে আরও দূরূহ করে তুলছে। আশা করি, এ বিষয়ে জাতিসংঘ কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে বরাবরের মতো এবারও জাতিসংঘে বাংলা ভাষায় ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা।
বিশ্বসভায় প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিশ্ব নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আরও বলেন, বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের দীর্ঘায়িত উপস্থিতি বাংলাদেশের অর্থনীতি, পরিবেশ, নিরাপত্তা এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। তাঁদের প্রত্যাবাসনের অনিশ্চয়তা সর্বস্তরে ব্যাপক হতাশার সৃষ্টি করেছে। মানবপাচার ও মাদক চোরাচালানসহ আন্তঃসীমান্ত অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমনকি এ পরিস্থিতি উগ্রবাদকেও ইন্ধন দিতে পারে। এ সঙ্কট প্রলম্বিত হতে থাকলে, তা এই উপমহাদেশসহ বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় একাত্তর সালের যুদ্ধ এবং ’৭৫ সালে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর হত্যা-ক্যুর রাজনীতির কথা তুলে ধরে বলেন, যুদ্ধের ভয়াবহতা, হত্যা-ক্যু-সংঘাতে মানুষের যে কষ্ট-দুঃখ-দুর্দশা হয়, ভুক্তভোগী হিসেবে আমি তা উপলব্ধি করতে পারি। তাই যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই, মানবকল্যাণ চাই। মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি চাই। আগামী প্রজন্মের জন্য শান্তিময় বিশ্ব, উন্নত-সমৃদ্ধ জীবন নিশ্চিত করতে চাই। তাই বিশ্ব নেতাদের প্রতি আমার আকুল আবেদন- যুদ্ধ, অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করুন। সমুন্নত হোক মানবিক মূল্যবোধ। আসুন, সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে হাতে হাত মিলিয়ে আমরা একটি উত্তম ভবিষ্যত তৈরির পথে এগিয়ে যাই।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে অন্তর্ভূক্তিমূলক জলবায়ু কার্যক্রমের প্রসারের জন্য বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে আহ্বান জানিয়ে বলেন, মানবজাতির জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হলো জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব। জলবায়ু নিয়ে প্রতিশ্রুতি দেওয়া আর ভাঙার একটি দুষ্টচক্র আমরা অতীতে দেখেছি। আমাদের এখনই এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের সঙ্গে এবং টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ঠ অর্জনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ অসংখ্য পদক্ষেপ নিয়েছে। ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের সভাপতি থাকাকালে আমরা ‘মুজিব ক্লাইমেট প্রস্পারিটি প্লান’ গ্রহণ করি, যার লক্ষ্য হল বাংলাদেশকে ‘ঝুঁকির পথ থেকে জলবায়ু সহনশীলতা ও জলবায়ু সমৃদ্ধির টেকসই পথের’ দিকে নিয়ে যাওয়া। জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ সম্পর্কিত আমাদের জাতীয় পরিকল্পনা এবং নীতিগুলো জেন্ডার সংবেদনশীল করে তৈরি করা হয়েছে। ঝুঁকিতে থাকা অন্যান্য দেশগুলোকে তাঁদের নিজস্ব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা প্রণয়ণে সহায়তা করতে আমরা প্রস্তুত আছি। অন্তর্ভুক্তিমূলক জলবায়ু কার্যক্রমের প্রসারের জন্য তিনি বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে আহ্বান জানান।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে তাঁর সরকারের আমলে দ্রুতগতিতে দেশ এগিয়ে যাওয়ার বাস্তবচিত্র বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরে বলেন, একটি টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক শান্তিপূর্ণ সমাজ এবং সামাজিক সম্প্রীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল পাঁচটি অর্থনীতির মধ্যে অন্যতম।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জিডিপির হিসাবে আমাদের অবস্থান ৪১তম। বিগত এক দশকে আমরা দারিদ্র্যের হার ৪১ শতাংশ থেকে ২০ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছি। আমাদের মাথাপিছু আয় মাত্র এক দশকে তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, কোভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাবের পূর্বে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিলো ৮ দশমিক এক পাঁচ শতাংশ। এর আগে, আমরা টানা তিন বছর ৭ শতাংশের বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি। মহামারি চলাকালেও ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি ৬ দশমিক নয় চার শতাংশ হারে প্রসারিত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞার ফলে সরবরাহ ব্যবস্থায় ব্যাঘাত এবং জ্বালানি ও খাদ্যসহ নানা ভোগ্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে। এ কারণে, আমাদের মতো অর্থনীতি মারাত্মক চাপের মুখে পড়েছে। মুল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পেয়েছে। এ অবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য আমরা বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করছি।
তিনি বলেন, ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ হতে উন্নয়নশীল দেশে উত্তীর্ণ হতে যাচ্ছে। আমরা ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি জ্ঞানভিত্তিক উন্নত দেশে রূপান্তরিত করার জন্য এবং ২১০০ সালের মধ্যে একটি সমৃদ্ধ ও জলবায়ু-সহিষ্ণু বদ্বীপে উন্নীত করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। তিনি বলেন, সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা, খাদ্য নিরাপত্তা, মা ও শিশু মৃত্যু হ্রাস, লিঙ্গ বৈষম্য, নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। গত এক দশকে সাক্ষরতার হার ৫০ শতাংশ থেকে ৭৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। আমরা তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিতকরণের ওপর অধিক গুরুত্বারোপ করেছি। আমাদের শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ২১ জনে এবং প্রতি লাখ জীবিত জন্মে মাতৃমৃত্যু হার ১৭৩ জনে নেমে এসেছে। মানুষের গড় আয়ু এখন ৭৩ বছরের অধিক।
প্রধানমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, আমরা সমাজের সবচেয়ে দুর্বল ব্যক্তিদের প্রতি বিশেষ মনযোগ দিয়েছি; যাতে সমাজের কেউ পিছিয়ে না থাকে। স্বামী-পরিত্যাক্তা নারী, বিধবা, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, তৃতীয় লিঙ্গ এবং অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠির সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিদ্যমান সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় উপকৃত হচ্ছেন।
স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণের কথা জাতিসংঘে তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, উন্নত ভৌত অবকাঠামো মজবুত অর্থনৈতিক কাঠামোর ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। এজন্য আমরা নদীর তলদেশের টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এবং ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট সিস্টেমসহ টেকসই বৃহৎ অবকাঠামো নির্মাণ করছি। আমাদের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায় সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে আমাদের নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত ‘পদ্মা বহুমুখী সেতু’। এটি বাংলাদেশের স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে সহজতর করবে এবং আঞ্চলিক যোগাযোগ বৃদ্ধি করবে। এই সেতু জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে ১ দশমিক দুই তিন শতাংশ বাড়াতে অবদান রাখবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জটিল বৈশ্বিক সঙ্কট অনেক উন্নয়নশীল দেশের বিগত কয়েক দশকের উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে স্থবির করে দিচ্ছে। এই মুহূর্তে ২০৩০-এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা তাঁদের অনেকের কাছেই একটি অধরা স্বপ্ন বলে মনে হচ্ছে। আমরা দেখছি, কীভাবে নিত্য-নতুন প্রযুক্তি বিশ্বকে দ্রুত পরিবর্তন করে ফেলছে। এই প্রযুক্তিগুলো ব্যবহারের সকলের ন্যায্য এবং সমান সুযোগ পাওয়া অপরিহার্য। ক্রমবর্ধমান প্রযুক্তিগত বিভাজন অবশ্যই দূর করতে হবে। বাংলাদেশসহ ১৬টি দেশ এখন স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নীত হওয়ার পথে। তবে ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক সঙ্কট আমাদের টেকসই উত্তরণের পথে গুরুতর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। আমাদের উন্নয়নের অংশীজনদের কাছে বর্ধিত এবং কার্যকর সহযোগিতার আহ্বান জানাই। এ বিষয়ে দোহা কর্মসূচিকে আমরা স্বাগত জানাই।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটি দায়িত্বশীল সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে, বাংলাদেশ তাঁর জনগণের মানবাধিকার সংরক্ষণ ও উন্নয়নে অঙ্গীকারাবদ্ধ। জনগণের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য আমরা একটি সামগ্রিক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক পন্থা অবলম্বন করেছি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আমরা হিজড়া জনগোষ্ঠীর প্রয়োজনীয় অধিকার ও কল্যাণ সাধনের জন্য সংশ্লিষ্ট আইনি বিধি-বিধান প্রণয়ন করেছি।
তিনি বলেন, দেশের সকল ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের জন্য বিনামূল্যে আবাসন প্রদানের লক্ষ্যে ‘আশ্রয়ণ’ শীর্ষক একটি প্রকল্প আমরা বাস্তবায়ন করছি। ১৯৯৭ সাল থেকে আমার নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে বিগত ১৮ বছরে প্রায় ৩৫ লাখেরও বেশি মানুষের আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী সাইবার-অপরাধ এবং সাইবার সহিংসতা মোকাবিলার লক্ষ্যে একটি আন্তর্জাতিক বাধ্যতামূলক চুক্তি প্রণয়নে একসঙ্গে কাজ করার জন্য সদস্য দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশে সন্ত্রাস ও সহিংস উগ্রপন্থার বিষয়ে আমরা ‘শূন্য সহনশীলতা (জিরো টলারেন্স)’ নীতি গ্রহণ করেছি। বাংলাদেশের ভূখণ্ডে কোনোরূপ সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বা জনগণের ক্ষতি হয়; এমন কোনও কর্মকাণ্ড সংঘটিত হতে দেই না।
তিনি বলেন, পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তাররোধসহ সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের জন্য আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা ২০১৯ সালে পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ বিষয়ক ঐতিহাসিক চুক্তি অনুস্বাক্ষর করি। আমরা ধারাবাহিকভাবে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে আমাদের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করে আসছি। আমাদের শান্তি-কেন্দ্রিক পররাষ্ট্রনীতির প্রতিফলন হিসেবে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে সৈন্য ও পুলিশ প্রেরণকারী দেশগুলোর মধ্যে আমরা বর্তমানে শীর্ষে অবস্থান করছি।
শেখ হাসিনা আরও বলেন, শান্তিরক্ষাসহ, জাতীয় ও স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি, বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা প্রদান, নারী ও অন্যান্য পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে একটি টেকসই সমাজ গঠন করতে এ সকল অঞ্চলের জনগণকে তাঁরা সাহায্য করে যাচ্ছেন। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমাদের অনেক শান্তিরক্ষী নিহত হয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা বিশ্বাস করি যে, দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মূল কারণগুলোর সমাধান ব্যতিত টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। জাতিসংঘ শান্তি বিনির্মাণ কমিশনের বর্তমান সভাপতি হিসেবে আমরা সংঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে সহযোগিতার উদ্দেশে বহুমাত্রিক অংশীজনদের একসঙ্গে কাজ করার একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরিতে চেষ্টা করে যাচ্ছি। নারী, শিশু, শান্তি ও নিরাপত্তা এজেন্ডাকে আরও শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতেও আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।