ডন প্রতিবেদন : আফগানিস্তানের রাজধানি কাবুলের পতনের মধ্য দিয়ে বদলে গেছে দেশটির স্বাভাবিক জীবনযাত্রা, বদলে যাচ্ছে অনেক সমীকরণ। গত সপ্তাহে ক্ষমতা দখলের পরপরই সরকার গঠনে তোড়জোড় শুরু করেছেন তালেবান নেতারা। দেশটিতে তালেবানের শাসনকাঠামো কেমন হবে, তা আলোচনা করতে কাবুলে হাজির হয়েছেন সংগঠনটির অনেক নেতা। তাঁদের মধ্যে দেখা গেছে পশ্চিমা বিশ্বের চোখে ভয়ঙ্কর হাক্কানি নেটওয়ার্কের প্রতিনিধিদেরও।
হাক্কানি নেটওয়ার্কের কথা সামনে এলেই উঠে আসে গোষ্ঠীটির নৃশংস এক ইতিহাস। তালেবানের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যাঁরা পরিচিত, তাঁরা হাক্কানি নেটওয়ার্ক সম্পর্কেও কমবেশি জানেন। কী অভিযোগ নেই তাদের বিরুদ্ধে? আফগানিস্তানের বেসামরিক লোকজন, সরকারি কর্মকর্তা ও বিদেশি সেনাসদস্যদের হত্যা থেকে শুরু করে সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া হামলা–সংঘাত তো আছেই।
এই হাক্কানি নেটওয়ার্কই তালেবানের নতুন সরকার গঠনে বড় ভূমিকা রাখবে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞেরা। চলতি সপ্তাতে কাবুলে তাদের প্রতিনিধির উপস্থিতি এমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন তাঁরা।
হাক্কানি নেটওয়ার্কের শুরু হয় জালালুদ্দিন হাক্কানির হাত ধরে। তাঁর নাম পরিচিতি পায় গত শতকের আশির দশকে আফগানিস্তানে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসনের সময়। সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ে তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন তিনি।
একই সময় চলছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার স্নায়ুযুদ্ধ। সেই যুদ্ধের প্রভাব পড়ে আফগানিস্তানেও। দেশটিতে সোভিয়েতের বিরুদ্ধে লড়তে তৎকালীন মুজাহিদিন যোদ্ধাদের অর্থ আর অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে ছায়াযুদ্ধ চালায় যুক্তরাষ্ট্র এবং মিত্ররা। মুজাহিদিনদের নানা রসদ জোগায় মার্কিন মিত্র পাকিস্তানও। নিজ স্বার্থ উদ্ধারের কাজে সে সময় মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইয়ের কাছে মূল্যবান হয়ে ওঠেন জালালুদ্দিন হাক্কানি।
সাবেক সোভিয়েতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় জালালুদ্দিন হাক্কানি আফগানিস্তানের বাইরে নানা দেশে সমমনা জিহাদিদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। সেই ধারা অব্যাহত ছিল ১৯৮৯ সালে দেশটি থেকে সোভিয়েত বাহিনী প্রত্যাহারের পরও। ওই সময়ে আল–কায়েদার নেতা ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ ছিল।
পরে ১৯৯৬ সালে এসে আফগানিস্তানে সরকার গঠন করে তালেবান। সে সময় তালেবানের সঙ্গে হাত মেলান জালালুদ্দিন হাক্কানি। তালেবান সরকারের একজন মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পেয়েছিলেন তিনি। ২০০১ সালে মার্কিন ও তার মিত্রদের সেনা অভিযানে তালেবানের পতনের আগপর্যন্ত ওই দায়িত্বে ছিলেন তিনি।
২০১৮ সালে এসে জালালুদ্দিন হাক্কানির মৃত্যুর খবর প্রকাশ করে তালেবান। দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন তিনি। জালালুদ্দিনের মৃত্যুর পর হাক্কানি নেটওয়ার্কের মসনদে বসেন তাঁর ছেলে সিরাজুদ্দিন হাক্কানি। এখনো তিনি নেটওয়ার্কটির প্রধান হিসেবেই আছেন।
হাক্কানিদের মূল ঘাঁটি আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলে। এ ছাড়া পাকিস্তানের উত্তর–পশ্চিম সীমান্ত এলাকাজুড়ে তাদের একাধিক ঘাঁটি থাকার কথা শোনা যায়। হাক্কানি নেটওয়ার্কের মূল শক্তি হলো তাদের আর্থিক ও সামরিক সক্ষমতা। রক্তাক্ত ইতিহাস তাদের আরও ভয়াবহ করে তুলেছে। মূলত এসব কারণেই তালেবানের অধীনে থেকেও মোটামুটি স্বাধীনভাবে কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে হাক্কানি নেটওয়ার্ক।
এদিকে গত কয়েক বছরে হাক্কানি নেটওয়ার্ক তালেবানের নেতৃত্বে বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ২০১৫ সালে সিরাজুদ্দিন হাক্কানি তালেবানের উপনেতা হিসেবে দায়িত্ব পান। সামনে এসেছেন তাঁর ছোট ভাই আনাসও। গত সপ্তাহে তালেবানের হাতে কাবুলের পতনের পর সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই ও সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আবদুল্লাহর সঙ্গে দফায় দফায় তাঁকে আলোচনা করতে দেখা গেছে। এই আনাসকেই গ্রেপ্তারের পর মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছিল তৎকালীন আফগান সরকার। ২০১৯ সালে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল।
আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের পতনের পর গত দুই দশকে একাধিক বিধ্বংসী হামলা চালানোর অভিযোগ রয়েছে হাক্কানি নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে। তাদেরকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞাও রয়েছে এই নেটওয়ার্কের ওপর।
বিভিন্ন সময়ে একের পর এক আত্মঘাতী বোমা হামলা চালিয়ে নিজেদের নৃশংসতার প্রমাণ রেখেছে হাক্কানি নেটওয়ার্ক। সামরিক ঘাঁটি ও দূতাবাসগুলোতে বড় হামলা চালিয়ে নিজেদের উচ্চ সক্ষমতার জানান দিয়েছে তারা। ২০১৩ সালের অক্টোবরে পূর্ব আফগানিস্তানে হাক্কানিদের একটি ট্রাক আটক করে আফগান সেনারা। মার্কিন কাউন্টার টেররিজম সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, ওই ট্রাকে প্রায় ২৮ টন বিস্ফোরক ছিলো।
হাক্কানিদের বিরুদ্ধে গুপ্তহত্যা চালানোর অভিযোগ আছে। বলা হয়, ২০০৮ সালে আফগানিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইকে হত্যার চেষ্টা চালিয়েছিল তারা। এ ছাড়া বিদেশি নাগরিক ও কর্মকর্তাদের অপহরণের ঘটনা তো রয়েছেই। এসবের মূল উদ্দেশ্য মুক্তিপণ আদায় এবং বন্দী থাকা তাদের সদস্যদের মুক্তি।
দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও রয়েছে হাক্কানি নেটওয়ার্কের তৎপরতা। বলা হয়ে থাকে, পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাদের সখ্যতা দীর্ঘ দিনের। ২০১১ সালে মার্কিন অ্যাডমিরাল মাইক মুলেন হাক্কানি নেটওয়ার্ককে পাকিস্তানের গোয়েন্দাদের ‘নির্ভরযোগ্য হাত’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। যদিও সে সময় ওই অভিযোগ নাকচ করেছিল পাকিস্তান।
চলতি বছরের জুনে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষকেরা জানান, তালেবানের হয়ে লড়াইয়ের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রস্তুতি থাকে হাক্কানি নেটওয়ার্কের যোদ্ধাদের। তালেবানের সঙ্গে আল–কায়েদার শুরুর দিকের যোগাযোগটাও তাদের মাধ্যমে হয়েছিল বলে জানিয়েছেন জাতিসংঘের পর্যবেক্ষকেরা।
তালেবানের নতুন সরকারে হাক্কানিদের প্রভাব কতোটা? : আফগানিস্তানে তালেবান সরকার কেমন হবে, তা কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই জানা যাবে বলে উল্লেখ করেছেন সশস্ত্র সংগঠনটির এক মুখপাত্র। সরকার গঠন নিয়ে আলোচনা করতে এই মুহূর্তে কাবুলে রয়েছেন হাক্কানি নেটওয়ার্কের দুই নেতা। নতুন সরকারে তাদের বড় প্রভাব থাকতে পারে বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকেরা।
বিশ্লেষকদের এই ধারণার পেছনে যথেষ্ট যৌক্তিক কারণ রয়েছে। বছর ছয়েক আগে সিরাজুদ্দিন হাক্কানির তালেবান উপনেতা পদ পাওয়া এসব কারণের মধ্যে একটি। গুরুত্বপূর্ণ এই নেতা গত বছর সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসে একটি কলাম লেখেন। সেখানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় তালেবানের ভূমিকা তুলে ধরেছিলেন। এ ছাড়া আফগানিস্তানের তৎকালীন অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা করেছিলেন তিনি।
এ ছাড়া সিরাজুদ্দিনের ভাই আনাসকেও তালেবানের হয়ে সম্প্রতি বেশ তৎপর দেখা গেছে। হামিদ কারজাই ও সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আবদুল্লাহর সঙ্গে বৈঠকে দেখা গেছে তাঁকে। ২০১৯ সালে আনাসের মুক্তি তালেবান ও যুক্তরাষ্ট্রের শান্তি আলোচনা শুরুর পেছনে প্রভাবকের কাজ করেছিলো। ওই আলোচনার জেরেই আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয় মার্কিন সরকার।
তালেবান নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তানে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে দেখা গেছে সিরাজুদ্দিন হাক্কানির চাচা খলিল হাক্কানিকে। গত শুক্রবারে তাঁকে কাবুলে জুমার নামাজে উপস্থিত থাকতে দেখা গেছে। সিরাজুদ্দিন ও খলিল দুজনেই যুক্তরাষ্ট্রের মোস্ট ওয়ান্টেডের তালিকায় রয়েছেন।