দুদকে ছালামের বিরুদ্ধে অভিযোগ : অর্থ পাচারও দেখা হবে খতিয়ে

দুদকে ছালামের বিরুদ্ধে অভিযোগ : অর্থ পাচারও দেখা হবে খতিয়ে

নিজস্ব প্রতিবেদক, বাঙলার কাগজ; রাহাতুল রাফি : রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক খাতের জনতা ব্যাংকের ‘সদ্য’ সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আব্দুছ ছালাম আজাদের বিরুদ্ধে বেশকিছু অভিযোগ জমা পড়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। মূলত তিনি অবসরে যাওয়ার পরই অভিযোগগুলো জমা পড়েছে। আর এসব অভিযোগের অধিকাংশ আমলেও নিয়েছে দুদক। অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে : ঋণ প্রদানে কমিশন গ্রহণের মাধ্যমে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেওয়া, পদোন্নতিতে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেওয়া, বিভিন্ন রকম জালিয়াতিতে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেওয়া এবং বিপুল পরিমাণে অর্থ পাচার। আব্দুছ ছালাম আজাদের ব্যবস্থাপক থাকার সময় থেকেই অনিয়মগুলোর অভিযোগ জমা পড়েছে। তবে দুদক সিদ্ধান্ত নিয়েছে আব্দুছ ছালাম আজাদ মহাব্যবস্থাপক (জিএম) থাকার সময় থেকে যেসব অভিযোগ রয়েছে, সেগুলোর আগে তদন্ত করা হবে।

জানতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ বাঙলার কাগজকে বলেন, আমাদের কাছে বেশ কয়েকটি ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তার অনিয়মের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়েছে। সেগুলো আমরা খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বাঙলার কাগজকে বলেন, জনতা ব্যাংক একটি ভালো ব্যাংক ছিলো। এ ব্যাংক গত কয়েক বছরে অনেক খারাপ হয়ে গেছে। আর এসব খারাপের প্রতিবেদনও আমরা দেখতে পাচ্ছি।

অভিযোগের ব্যাপারে জানার জন্য বৃহস্পতিবার (৩০ নভেম্বর) জনতা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুছ ছালাম আজাদের ‍মুঠোফোনে ফোন দেওয়া হলেও তিনি ফোন রিসিভ না করায় তাঁর বক্তব্য জানা সম্ভব হয় নি।

জানা গেছে, আব্দুছ ছালাম আজাদের আমলে যেসব ঋণে জালিয়াতির ব্যাপারে দুদকে অভিযোগ জমা পড়েছে, সেগুলোর অধিকাংশই এলএটিআর (বিশ্বাসের ভিত্তিতে ঋণ), করপোরেট গ্যারান্টি এবং আইবিপির (অভ্যন্তরীণ বিল ক্রয়) ঋণ। 

জনতা ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালের অক্টোবরে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন আব্দুছ ছালাম আজাদ। ওই সময়ে ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিলো ৪৫ হাজার ৯৫৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ছিলো ৭ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। আর তিনি অবসরে যাওয়ার সময় ব্যাংকটির ঋণ বেড়ে হয়েছে ৮৫ হাজার ২০৬ কোটি টাকা; যেখানে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ১৪ হাজার ৩৮৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত সাড়ে পাঁচ বছরে ঋণ বিতরণ ও খেলাপি ঋণ বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ঋণ জালিয়াতি হওয়ার কারণেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ এমন বেড়েছে বলে জানা গেছে। আবার বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র বলছে, জনতা ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও অনেক বেশি। তবে সেগুলোকে খেলাপি দেখাচ্ছে না রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এ ব্যাংক। আর এটি হয়েছে আব্দুছ ছালাম আজাদের আমলে। আর এসব বিষয়ই আমলে নিয়েছে দুদক।

জানা গেছে, জনতা ব্যাংক এক সময় ছিলো সরকারি খাতের সেরা ব্যাংক। সবচেয়ে ভালো শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা ছিলেন ব্যাংকটির গ্রাহক। এখন দেশের অন্যতম শীর্ষ ঋণখেলাপি অ্যাননটেক্স ও ক্রিসেন্ট গ্রুপ এবং প্রভাবশালী বেশকিছু ব্যবসায়ী ব্যাংকটির বড় গ্রাহক। এদিকে কয়েক বছর আগেও জনতা ব্যাংককে বিবেচনা করা হতো অন্য সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর জন্য তহবিলের উৎস হিসেবে। তবে জনতা ব্যাংকের অবস্থা বর্তমানে বড়ই খারাপ।

বেড়েছে ঋণ বিতরণ, সঙ্গে খেলাপি ঋণও :
২০১৭ সালে জনতা ব্যাংকের আমানতের পরিমাণ ছিলো ৬৪ হাজার ৯৪৪ কোটি টাকা ও বিতরণ করা ঋণ ছিলো ৪৫ হাজার ৯৫৮ কোটি টাকা। ২০২২ সাল শেষে আমানত ও ঋণ বেড়ে হয়েছে যথাক্রমে ১ লাখ ১ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা ও ৮৫ হাজার ২০৮ কোটি টাকা। ২০১৭ সালে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিলো ৭ হাজার ৬শ কোটি টাকা, ২০২২ সালে যা বেড়ে হয়েছে ১৪ হাজার ৩৮৭ কোটি টাকা। অবশ্য ২০১৮ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৮ হাজার কোটি টাকা ছুঁই ছুঁই হয়েছিলো।

খেলাপি ঋণ বাড়লেও আমদানি-রপ্তানিতে ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে জনতা ব্যাংকের। ২০১৭ সালে আমদানি অর্থায়ন ছিলো ১৪ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকার, ২০২১ সালে যা বেড়ে হয় ২৭ হাজার ৫১৬ কোটি টাকা। ২০২২ সালে আমদানি বেড়ে হয় ৪৮ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা। জনতা ব্যাংকের ২০১৭ সালে রপ্তানি হয়েছিলো ১৩ হাজার ৯৯২ কোটি, ২০২১ সালে যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭ হাজার ১১৪ কোটি টাকায়। ২০২২ সালে রপ্তানি বেড়ে হয় ২১ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকা।

এক সময় ভালো মুনাফা করার ব্যাংক হিসেবেও পরিচিতি ছিলো জনতা ব্যাংকের। ২০১৩ সালে ব্যাংকটি ৯৫৫ কোটি টাকা নিট মুনাফা করেছিলো। ২০১৭ সালে নিট মুনাফা হয় ২৬৮ কোটি টাকা। এরপর ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সালে মুনাফার পরিমাণ কমে ৩০ কোটি টাকার নিচে চলে আসে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি ছাড়ের ফলে ২০২১ সালে ৩শ কোটি টাকা মুনাফা করার সুযোগ পায় জনতা ব্যাংক।

খেলাপিদের নিয়ে বেশ বিপদে জনতা ব্যাংক :
শীর্ষ খেলাপি গ্রাহক অ্যাননটেক্স ও ক্রিসেন্ট গ্রুপের কাছে জনতা ব্যাংকের পাওনা প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে অ্যাননটেক্স গ্রুপের ঋণ ব্যাংক খাতে আলোচিত একটি বিষয়। ২০২০ সালে জাতীয় সংসদে পেশ করা শীর্ষ ঋণখেলাপিদের তালিকায় প্রথম স্থানে ছিলো গ্রুপটি। বিভিন্ন ব্যক্তির নামে ১৮টি প্রতিষ্ঠান খুলে জনতা ব্যাংক থেকে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা বের করে নেন এগুলোর প্রকৃত মালিক মো. ইউনুছ ওরফে বাদল একাই।

পরে সুদসহ এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। সদ্য সাবেক হওয়া এমডি আব্দুছ ছালাম আজাদ যখন জনতা ব্যাংক ভবন শাখার ব্যবস্থাপক, তখন এসব ঋণ দেওয়া হয়। হলমার্ক ও বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির পর অ্যাননটেক্সকে দেওয়া জনতা ব্যাংকের ঋণই ছিলো ব্যাংক খাতে আলোচিত ঋণ কেলেঙ্কারি। তবে অ্যাননটেক্স গ্রুপের ঋণ জনতা ব্যাংক থেকে মুছে ফেলার জন্য পাওনা সুদের পুরোটা মওকুফের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। এরপর এই ঋণ কিনে নেওয়ার কথা চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপের।

ব্যাংকটি জানিয়েছে, গ্রাহকদের মধ্যে বিআর স্পিনিংয়ের ৬ শ কোটি টাকা ঋণ পুনঃ তফসিল করা হয়েছে। এ ছাড়া হাবিব হোটেল (হলিডে ইন), ইব্রাহীম টেক্সটাইল, লিতুন ফেব্রিকসের ঋণ নিয়মিত করার চেষ্টা চলছে।

প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ২০২২ সাল শেষে জনতা ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের ১৮ শতাংশ ছিলো খেলাপি।

বাংলাদেশ ব্যাংক, দুদক এবং জনতা ব্যাংক সূত্র আরও জানিয়েছে, আব্দুছ ছালাম আজাদের বিরুদ্ধে এসব জাল-জালিয়াতির কিছু অভিযোগ করেছেন খোদ ব্যাংকটির গ্রাহকই। অথচ তিনিই এমডি থাকাকালীন তাঁদেরকে সুবিধা দিয়েছিলেন। আর এখন তিনি এমডি পদ থেকে চলে যাওয়ার পর তাঁর প্রকৃত বন্ধুর সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। পাশাপাশি নিজেরা বাঁচতে আব্দুছ ছালাম আজাদের ওপরই সম্পূর্ণ দোষ এবং দায় চাপাতে চাইছেন তাঁরা।