প্রতারক শামস্‌-উলের জালিয়াতি সারাদেশে!

প্রতারক শামস্‌-উলের জালিয়াতি সারাদেশে!

নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলার কাগজ ও ডন : রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক খাতের অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেডের সদ্য বিদায়ী ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ শামস্‌-উল ইসলামের জালিয়াতি সারাদেশেই বিস্তৃত। এক্ষেত্রে তিনি দেশের বিভিন্ন অগ্রণী ব্যাংকের শাখায় নিজের ইচ্ছেমতো লোক পদোন্নতি দিয়ে ব্যবস্থাপক (ম্যানেজার) পদে বসিয়েছেন। আর সেসব ব্যবস্থাপকের মাধ্যমে শাখা পর্যায়েও জালিয়াতিগুলো হচ্ছে। যার ভাগ সরাসরি চলে গেছে এবং ‘যাবে’ শামস্‌-উল ইসলামের কাছে। এক্ষেত্রে গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থেকে অর্থ উধাওয়ের বেশকিছু ঘটনাও ঘটেছে।

দেশজুড়ে জালিয়াতির ব্যাপারে জানার জন্য অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ শামস্‌-উল ইসলামের মুঠোফোনে বৃহস্পতিবার (৬ অক্টোবর) ফোন দিলেও তিনি ফোন রিসিভ করেন নি। এরপর তাঁকে খুদে বার্তা পাঠানো হয়। তারপর আবার ফোন দেওয়া হলেও ফোন ধরেন নি মোহাম্মদ শামস্‌-উল ইসলাম।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও অগ্রণী ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক খাতের অগ্রণী ব্যাংকের এ ধরনের বেশকিছু জালিয়াতি ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ব্যাংকটির নিরীক্ষা, পরিদর্শন এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অফসাইট সুপারভিশন বিভাগের মাধ্যমে শনাক্ত করা হয়েছে। আর এসব জালিয়াতি শনাক্ত করার পর কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়েছে। তবে স্বল্প কিছু ক্ষেত্রে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জালিয়াতদের বিরুদ্ধে এখনও কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করাই হয় নি। আবার এমনও দেখা গেছে, অগ্রণী ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদক অভিযোগ আনার পর, সেসব কর্মকর্তাদের দায়মুক্তি দেওয়ার জন্য অগ্রণী ব্যাংক থেকে দুদকে চিঠিও দেওয়া হয়েছে।

জানতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ বাঙলার কাগজ ও ডনকে বলেন, ব্যাংক থেকে যদি কোনও অভিযুক্তের বিরুদ্ধে দায়মুক্তির আবেদন করা হয়, অথচ অভিযোগ সত্যতা প্রমাণিত হয়; তাহলে যিনি দায়মুক্তির আবেদন করেছিলেন, তাঁকেও অভিযোগের আওতায় আনা হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বাঙলার কাগজ ও ডনকে বলেন, এ ধরনের অভাবনীয় জালিয়াতি ব্যাংকে হয়ে থাকলে, তার বিরুদ্ধে অবশ্যই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

জানা গেছে, সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জে অগ্রণী ব্যাংক নিমগাছী শাখার কর্মী জাকারিয়া হোসেনের বিরুদ্ধে চেক জালিয়াতির অভিযোগ উঠে। অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার ধামাইনগর ইউনিয়নের বাঁকাই গ্রামের সোনা উল্লাহ প্রামাণিকের ছেলে সিরাজুল ইসলাম প্রামাণিক অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড নিমগাছী শাখার অনুকূলে একটি সঞ্চয়ী হিসাব খোলেন। সেই হিসাবে তাঁর নামের চেক বই অন্য কেউ নিয়ে বিপুল পরিমাণে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন।

সূত্র আরও জানায়, গাজীপুরে অগ্রণী ব্যাংকের শ্রীপুর শাখায় জালিয়াতির মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা আত্মসাতের অভিযোগে তিন কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। একইসঙ্গে ব্যাংকটির শাখা ব্যবস্থাপককে অপসারণ করে ঢাকার একটি শাখায় স্থানান্তর করা হয়। এক্ষেত্রে শামস্‌-উল শাখা ব্যবস্থাপককে নিজের কাছে নিয়ে যান বলেই জানা গেছে।

সূত্র জানায়, অগ্রণী ব্যাংকের শ্রীপুর শাখার গ্রাহক বদরুন নাহার ২০২০ সালের ২৭ আগস্ট ব্যাংক ম্যানেজারের কাছে লিখিত অভিযোগে বলেন, ‘আমার সঞ্চয়ী হিসাব নম্বর ৭৪২৯, সম্প্রতি আমি আমার অ্যাকাউন্টে এক লাখ টাকা জমা করি। বদরুল হাসান সনি প্রতারণা করে আমার কাছ থেকে চেক বইয়ের একটি পাতা (নং-৩৪৩৮৭৯) আত্মসাৎ করেন। পরবর্তীতে ওই চেকের মাধ্যমে তিনি আমার হিসাব থেকে এক লাখ টাকা তুলে নেন। বিষয়টি ধরা পড়লে ব্যাংক ম্যানেজারের মাধ্যমে আমার অ্যাকাউন্টে ওই টাকা জমা দেন সনি।’

ওই শাখার গ্রাহক জুয়েনা বেগম একই অভিযোগ তোলেন। অভিযোগে তিনি জানান, তাঁর হিসাব নম্বর ১৭৪৮০। তাঁর স্বামী ও ছেলে সৌদি আরব চাকরি করেন। সেখান থেকে তাঁর অ্যাকাউন্টে তাঁরা টাকা পাঠান। ১৩ জুলাই তিনি ওই অ্যাকাউন্টের তথ্য জানতে গিয়ে দেখেন তাঁর অ্যাকাউন্টে ৮ লাখ ২০ হাজার টাকা কম। পরে বিষয়টি ম্যানেজারকে অভিযোগ করলে ১৪ জুলাই ৫ লাখ এবং ১৫ জুলাই ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা তাঁর অ্যাকাউন্টে জমা করা হয়। বদরুল হাসান সনির বিরুদ্ধে ওই টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠলে দুই ধাপে ওই টাকা তাঁর হিসাবে জমা করা হয়।

অপর গ্রাহক আফতাব উদ্দিন অভিযোগে জানান, তাঁর হিসাব নম্বর ১৯৭২৫। ৪ জুন তিন লাখ টাকা তাঁর হিসাবে জমা করেন। ২২ আগস্ট বিকেলে ফোন মারফত ম্যানেজার জমা ও চেক বইসহ কাগজপত্র নিয়ে তাঁকে ব্যাংকে যেতে বলেন। পরদিন ব্যাংকে গেলে ম্যানেজার তাঁর অ্যাকাউন্টে তিন লাখ টাকা কম আছে বলে জানান। পরে ব্যবস্থাপকের কাছে তিন লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ করার পর সনি ২৩ জুলাই ওই টাকা তাঁর অ্যাকাউন্টে জমা করেন।

এ ব্যাপারে অগ্রণী ব্যাংকের সাময়িক বরখাস্তকৃত প্রিন্সিপাল কর্মকর্তা মো. নজরুল ইসলাম জানিয়েছেন, ক্যাশ কর্মকর্তা বদরুল ইসলাম সনি নিজেই গ্রাহকের স্বাক্ষর নকল করে চেক বই উত্তোলন করেছে। পরে গ্রাহকের স্বাক্ষর জাল করে চেকে নিজেই সই করে টাকা তুলে আত্মসাৎ করেছে। ওইসব চেক এন্ট্রি করার সময় চেকের নম্বর এন্ট্রি না করেই টাকা তুলে নিয়ে গেছে সনি। এ ঘটনা ধরা পড়ার পর ম্যানেজার তাকে শাসিয়েছেনও একবার। 

‘অনেক সময় গ্রাহক ব্যাংকে টাকা জমা দিয়ে গেলে গ্রাহকের টাকা তাঁর অ্যাকাউন্টে জমা না করেও, তা আত্মসাৎ করেছেন তিনি। অর্থাৎ সনি গ্রাহকের টাকা ডেবিট করেও আত্মসাৎ করেছেন আবার ক্রেডিট করেও আত্মসাৎ করেছেন।’

ডিজিটাল জালিয়াতি : দেশে পরিবার-পরিজনের কাছে টাকা পাঠান প্রবাসীরা। টাকা জমা হওয়ার পরপরই সেই টাকা ট্রান্সফার হয়ে যায় কোনও নারীর অ্যাকাউন্টে। সেখান থেকে টাকা তুলে নিয়ে যায় তৃতীয় কোনও পক্ষ। নিজের স্বাক্ষরিত চেকে টাকা ট্রান্সফার হলেও কিছুই জানে না প্রবাসীরা। যখন জানতে পারেন, তখন তাঁদের মাথায় হাত। অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা হাওয়া। অগ্রণী ব্যাংকের একটি জালিয়াত চক্র এভাবেই অন্যের অ্যাকাউন্টের টাকা কৌশলে নিজের অ্যাকাউন্টে জমা করেছে। মোটা অঙ্কের টাকা তোলার পর ওই অ্যাকাউন্ট হোল্ডারও গায়েব। ডাক বিভাগ ও ব্যাংক কর্মচারীদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এভাবেই জালিয়াত চক্র কৌশলে হাতিয়ে নিয়েছে কয়েক শ কোটি টাকা। 

সূত্র আরও জানায়, মাত্র ১ বছরেই প্রতারক চক্র তুলে নিয়ে গেছে প্রায় ২ শ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে ঢাকা, সিলেট, মুন্সীগঞ্জ ও চট্টগ্রামের ব্যাংকগুলোতে এ ধরনের জালিয়াতি হয়েছে। এ ধরনের জালিয়াতিতে অগ্রণী ব্যাংকের বেশকিছু শ্রেণীর কর্মকর্তার সঙ্গে ব্যাংকটির সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তাও জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

সূত্র আরও জানায়, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ অগ্রণী ব্যাংকে জালিয়াতির ঘটনায় ব্যাংকটির সাময়িক বরখাস্তকৃত দুই ব্যাংক কর্মকর্তা ও এক কর্মচারীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করা হয়। গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর কালীগঞ্জ উপজেলার পুকুরিয়া গ্রামের কৃষক আইনুল ইসলাম, বদর উদ্দীন ও মনোহরপুর গ্রামের ইন্তাজ আলী বাদি হয়ে কালীগঞ্জের বিজ্ঞ জ্যেষ্ঠ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আমলি আদালতে ঋণ জালিয়াতির মামলা করেন। 

এরপর তাঁদের বিরুদ্ধে আরও একটি মামলা হয়। 

জানা গেছে, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশের মাধ্যমে ঋণ গ্রহীতাদের টাকা আদায় করে ব্যাংকে জমা না দিয়ে প্রায় দুই কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এ ধরনের জালিয়াতির মাধ্যমেও টাকা এসেছে মোহাম্মদ শামস্‌-উল ইসলামের পকেটে।