প্রতারকদের ধরিয়ে দিয়ে নিজেই বিপাকে সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তা!
নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলার কাগজ ও ডন : সোনালী ব্যাংকের নামে ওয়েবসাইট খুলে টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন ব্যক্তিকে ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়ে আসছিলো একটি চক্র। এ প্রতারণা চোখে পড়ে ব্যাংকটির এক কর্মকর্তার। নিজের পরিচয় গোপন রেখে বিষয়টি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানান তিনি। এর জেরে ওই চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। তবে যে কর্মকর্তা এ চক্রের খবর দিয়েছিলেন, তিনিই এখন নানা জটিলতার মধ্যে পড়েছেন।
২০১৭ সালে আগস্টে পরিচয় গোপন রেখে ডাকযোগে প্রতারক চক্রটির সন্ধান দিয়েছিলেন মাহমুদ আলী খান নামের এক ব্যক্তি। তিনি ২০১৫ সালে সোনালী ব্যাংকে সিনিয়র অফিসার হিসেবে যোগ দেন। মাহমুদ আলী বাঙলার কাগজ ও ডনকে বলেন, চক্রটিকে ধরিয়ে দেওয়ার পর থেকে ব্যাংকের সহকর্মীরা তাঁকে বাঁকা চোখে দেখছেন। নানাভাবে বিদ্রূপ করছেন। চক্রটিকে ধরিয়ে দেওয়ার পর তাঁকে একাধিক শাখায় বদলি করা হয়েছে। ঘন ঘন বদলির কারণে তিনি বিপাকে পড়ছেন।
সংশ্লিষ্ট নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, প্রতারক চক্রের সন্ধান দিয়ে ২০১৭ সালের ১৭ আগস্ট লিখিতভাবে সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যানকে অবহিত করেন মাহমুদ আলী। সেখানে নিজেকে একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে পরিচয় দেন তিনি। অভিযোগ পেয়ে রাজধানীর মতিঝিল থানায় প্রথমে সাধারণ ডায়েরি এবং পরে ব্যাংকের পক্ষ থেকে চক্রের সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। সোনালী ব্যাংকের তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগ-২-এর তৎকালীন ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার এ এস এম পান্না মিয়া বাদী হয়ে মামলাটি করেন। মামলায় মাহমুদুল হক নামের এক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়।
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, আসামি মাহমুদুল হক সোনালী ব্যাংকের নামে ওয়েবসাইট খুলে এবং সেই ওয়েবসাইটে ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ছবিসহ বিভিন্ন তথ্য আংশিক অবিকল রেখে ও আংশিক বিকৃত করে প্রকাশ করেন। এর মাধ্যমে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন লঙ্ঘন করে ব্যাংকের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছেন তিনি।
ওই ওয়েবসাইটে ব্যাংকের অফিস সহায়ক পদে ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিলো। ওই বিজ্ঞপ্তি দেখিয়ে মো. আল আমিন নামের এক ব্যক্তিকে জামালপুর সদর শাখা কার্যালয়ে ২০১৭ সালের ২৩ আগস্ট যোগদান করার ভুয়া নিয়োগপত্র দেওয়া হয়। তোজাম্মেল হক নামের অপর এক ব্যক্তিকে ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়ে একই তারিখে টঙ্গী সদর শাখায় যোগ দিতে বলা হয়। চক্রটি আগে থেকেই এমন প্রতারণা করে আসছে বলেও এজাহারে উল্লেখ করা হয়।
এরপর তদন্ত শেষে দুই মাসের মধ্যেই তিনজনকে আসামি করে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। একপর্যায়ে তিন আসামিকে আটক করে কারাগারে পাঠানো হয়। বাকি দুই আসামি হলেন মোহাম্মদ রেজাউল হক ও আবদুর রাজ্জাক শেখ রিপন।
মামলার অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, ১ নম্বর আসামি মাহমুদুল হক একজন কম্পিউটার প্রকৌশলী। তিনিই সোনালী ব্যাংকের নামে ভুয়া ওয়েবসাইটটি তৈরি করেছেন। বাকি দুই আসামির মধ্যে রেজাউল হক অপরাধ স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। জালিয়াতির সঙ্গে আবদুর রাজ্জাকেরও জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ।
চক্রটির তথ্য অবহিত করা মাহমুদ আলী খান বাঙলার কাগজ ও ডনকে বলেন, যখন তিনি এ চক্রের সন্ধান পান, তখন নরসিংদীর প্রিন্সিপাল অফিসে কর্মরত ছিলেন। তবে প্রতি সপ্তাহের শুক্র ও শনিবার রাজধানীর উত্তরা ৯ নম্বর সেক্টরের বাসায় থাকতেন। ওই এলাকার একটি চায়ের দোকানে সোনালী ব্যাংকের নিয়োগসংক্রান্ত আলোচনা শুনতে পান। টাকা দিয়ে প্রতারিত হয়েছেন, এমন অনেকের সঙ্গেও কথা বলেন। জানতে পারেন, একটি চক্র টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন ব্যক্তিকে ভুয়া নিয়োগপত্র দিচ্ছে। এরপর চক্রটি চিহ্নিত করে ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত করেন তিনি।
২০১৭ সালে এ তথ্য জানানোর পর এখন পর্যন্ত তাঁকে চারটি শাখায় বদলি করা হয়েছে বলে জানান মাহমুদ আলী। আক্ষেপ করে তিনি বাঙলার কাগজ ও ডনকে বলেন, সাধারণত একটি শাখায় কর্মকর্তাদের অন্তত তিন বছর রাখা হয়। চক্রটিকে ধরিয়ে দেওয়ার পর নরসিংদীর প্রিন্সিপাল অফিস থেকে তাঁকে নরসিংদীর রায়পুরা শাখায় বদলি করা হয়। সেখানে দেড় বছর থাকার পর পুরান ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোড শাখায় বদলি করা হয়। এ শাখায় এক বছর চার মাস রাখার পর মিটফোর্ড রোড শাখায় বদলি করা হয়। মিটফোর্ড শাখায় এক বছর দুই মাস রাখার পর তাঁকে চকবাজার করপোরেট শাখায় বদলি করা হয়। এ শাখায় দুই মাস ধরে কর্মরত আছেন তিনি।
ক্ষোভ প্রকাশ করে মাহমুদ আলী খান বাঙলার কাগজ ও ডনকে বলেন, সাধারণ নাগরিক হিসেবে চক্রটির তথ্য ব্যাংকের কর্মকর্তাদের জানালেও কয়েক দিন পর ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও সহকর্মীরা জানতে পারেন, তিনি ওই চিঠি দেওয়ার সঙ্গে জড়িত। বিষয়টি জানার পর তাঁকে উৎসাহ না দিয়ে বেশিরভাগ কর্মকর্তাই বিরক্তি প্রকাশ করেন। অনেকেই বাঁকা চোখে দেখতে শুরু করেন। অনেকে আবার তিরস্কারও করেন। সহকর্মী ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কেনো তাঁকে সাধুবাদ না জানিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করছেন, বিষয়টি তিনি এখনো বুঝতে পারছেন না।
মাহমুদ আলী খান আরও জানান, জালিয়াত চক্রের তথ্য ব্যাংককে জানানোর পর থেকে উত্তরা ৯ নম্বর সেক্টরে ওই চক্রের সদস্যরা তাঁকে খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। এখনো তাঁকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন তাঁরা। এ নিয়ে তিনি দুশ্চিন্তায় আছেন।
জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আফজাল করিম বাঙলার কাগজ ও ডনকে বলেন, জালিয়াত চক্রকে ধরিয়ে দিয়ে মাহমুদ আলী খান তো ব্যাংকের উপকারই করেছেন। এমনটা হওয়ার কথা নয়। বিষয়টি তিনি খোঁজ নিয়ে দেখবেন।