বাংলাদেশের আলোক-অভিসারী অভ্যুদয় : মফিদুল হক

বাংলাদেশের আলোক-অভিসারী অভ্যুদয় : মফিদুল হক

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষকের কলাম :: তথাকথিত ধর্মরাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের পীড়নমূলক আধিপত্যবাদী শাসন-শোষণের শৃঙ্খল ভেঙে জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় অশেষ তাৎপর্য বহন করে, যা আমরা পঞ্চাশ বছরেরও পরের বিশ্বের বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে আরও ভালোভাবে বুঝতে পারি। ১৯৪৭ সালে হিন্দু-মুসলিম বিরোধ নিরসনের চেষ্টা পরিহার করে, বরং বিরোধকে স্থায়ী রাষ্ট্ররূপ দিতে প্রতিষ্ঠা পায় ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তান। ভারতের মুসলমানরা এক জাতি– এই কল্পিত জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে মুসলমানদের পৃথক আবাসভূমি হিসেবে চিহ্নিত হয় পাকিস্তান, সীমানাও নির্ধারিত হয় মুসলমানের সংখ্যা গুনে এবং হাজার মাইল ফারাকের দুই অংশকে একক রাষ্ট্র হিসেবে মান্যতা দেওয়া হয়। তথাকথিত মুসলমানের এই রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী ২৪ বছরের মাথায় বিশ শতকের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মুসলিমনিধন ঘটাল বাংলার মাটিতে, মুসলিম সেনাবাহিনী দ্বারাই। এই নৃশংসতা চিহ্নিত হয়েছে জেনোসাইড হিসেবে।

দ্বিজাতিতত্ত্বের সাম্প্রদায়িক বিভাজন পেরিয়ে বাঙালি জাতিসত্তার সম্প্রীতির আদর্শে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা। ভাষাভিত্তিক জাতিসত্তা তো জন্মগতভাবেই মিলনপিয়াসী, একই জাতিসত্তার মধ্যে নানা ধর্মের মানুষ মিলিত হয় পারস্পরিক ধর্ম আচার উৎসবের বিভিন্নতা নিয়ে। এই বৈচিত্র্য ধর্মসত্তাকে ক্ষুণ্ন করে না, বরং জাতিসত্তাকে সমৃদ্ধ করে। সমন্বয়বাদী এই উদার আবহ বাঙালি জাতি বহন করে চলেছে হাজার বছর ধরে। নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে চলে অবশেষে বাঙালির জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পায় ১৯৭১ সালে, বিপুল আত্মদানের বিনিময়ে।

বিগত পঞ্চাশাধিক বছরে দুনিয়াজুড়ে কতক বড় ধরনের পরিবর্তন আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় রাতারাতি ধসে গেলো সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা, তার স্থলে পুঁজিবাদী বাজার ব্যবস্থা বিশ্বজনীন আধিপত্য বিস্তার করেছে। মুক্তবাজার অর্থনীতি ও ডিজিটাল নেটওয়ার্কভিত্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থা পুঁজি ও তথ্যের প্রবাহ করে তুলেছে সীমানাহীনভাবে অবাধ ও নিরঙ্কুশ। 

বিশ্বায়নের দাপটে মুছে যাচ্ছে রাষ্ট্রসীমার সার্বভৌমত্ব, বাজার-অর্থনীতি একই ছাঁচে ঢেলে তুলছে বহু-বর্ণিল ও বহু-ভিন্ন সমাজ। এর বিপরীতে স্বকীয়তা নিয়ে দাঁড়ানোর জন্য জাতীয়তাবাদ ও জাতিরাষ্ট্রের নিজস্ব অবস্থান হয়ে উঠছে গুরুত্ববহ।

বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী উত্থান তাই আরও বেশি করে আমাদের মনোযোগ দাবি করে। এই উত্থানের পেছনে লোকাচার, লোকায়ত জীবন লোকজ্ঞানের ভূমিকা বিষয়ে বিচ্ছিন্ন আলোচনা বা বিশ্লেষণ ঘটলেও সামগ্রিকভাবে ইতিহাসের ধারায় তার ভূমিকা ও অবস্থান এখনও যথাযথভাবে স্বীকৃত হয় নি। যদি তা হতো তাহলে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে আমরা চিহ্নিত করতে পারতাম লৌকিক জাতীয়তাবাদ হিসেবে এবং অনুধাবন করতে সক্ষম হতাম অন্ধকারাচ্ছন্ন এক সময়ে এমন জাতীয় চেতনায় লোকসমাজকে সংহত ও ঐক্যবদ্ধ করে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন সফল করে তুলে কোন্‌ যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করেছিলেন লোকনেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জাতীয়তাবাদী চেতনার শিকড়সন্ধান ও তার উত্থানের ইতিহাস পর্যালোচনা আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য বহন করে সবিশেষ গুরুত্ব। 

বিশেষভাবে যখন আমরা জীবন থেকে নানাভাবে মুছে ফেলছি অর্জনের স্মারকসমূহ, সম্প্রীতির আদর্শবহ ধর্মচেতনাকে করে তুলছি সংখ্যাগুরুর ধর্মীয় আধিপত্যের বাহক, প্রাচ্যের ঐতিহ্যবাদী সমাজশক্তি হীনবল করে পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রকাঠামো জোরদার করে চলছি। 

আর জঙ্গি ও হিংসাশ্রয়ী ইসলামের প্রসার ও পাশ্চাত্যের শক্তিমদমত্ত প্রতিক্রিয়ায় সভ্যতার পরিকীর্ণ ধ্বংসস্তূপের মধ্যে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী জাগরণের কাহিনি আমাদের অনেক কথা বলছে। ইতিহাসের সেই মর্মবাণী যারা উদ্ধার করবেন, কান পেতে রইব অনাগতকালের ওই সব বিশ্লেষকের জন্য। 

বাংলাদেশের অভ্যুদয় অতীত ইতিহাসের অধ্যায় বটে, তবে সেই আলোক-অভিসারী অভ্যুদয়ের মূল্যবোধ আমাদের বর্তমানের জন্য প্রাসঙ্গিক ও ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্ববহ।

লেখক : মফিদুল হক, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক

(লেখাটি সম্পাদিত)