মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতি নিয়ে উৎসবমুখর চারুকলা

মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতি নিয়ে উৎসবমুখর চারুকলা

নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলার কাগজ : চৈত্রের ঝিম দুপুর। রোদের তীব্রতায় চার দিক যেনো গলে যাচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা প্রাঙ্গণে ঢুকেই দেখা গেলো গাছের পাতারা নুয়ে পড়েছে। এর ছায়ায় অনেকটা নীরবে কর্মযজ্ঞ চলছে ঐতিহ্যবাহী মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বর্ণিল করে তুলতে। অথচ বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই, নিভৃতে এতো কোলাহল!

কেউ-বা রংতুলি হাতে নিয়ে পাখি, সরা, টেপা পুতুলে, নানা মুখোশ বর্ণিল রঙে রাঙিয়ে তুলছেন। এক প্রান্তে চলছে শোভাযাত্রার শিল্পকাঠামো নির্মাণের কাজ, অন্যপ্রান্তে চলছে শোভাযাত্রার ব্যয়নির্বাহের জন্য জলরঙ, সরাচিত্র, মুখোশ, পুতুল তৈরি ও বিক্রি। যার আয় থেকে তৈরি হবে মঙ্গল শোভাযাত্রার বড় বড় শিল্পকর্ম। এ লক্ষ্যে দিন-রাত বিরামহীন চলছে এ প্রস্তুতি। আবার শিক্ষক-শিক্ষার্থীর তৈরি এসব জিনিসপত্র বিক্রির জন্য পসরা সাজিয়ে বসেছেন শিক্ষার্থীরা।

সোমবার (পহেলা এপ্রিল) দুপুরে রাজধানীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা প্রাঙ্গণে গিয়ে এমন দৃশ্যের দেখা মিলেছে।

ছবি এঁকে এবারের শোভাযাত্রার প্রস্তুতি কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন ইমেরিটাস অধ্যাপক শিল্পী হাশেম খান। এর মধ্য দিয়ে বাঙালির সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হওয়া পহেলা বৈশাখের প্রধান আকর্ষণ মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতির কর্মযজ্ঞ, যা চলবে চৈত্রসংক্রান্তি পর্যন্ত। প্রথমবারের মতো এবারের প্রতিপাদ্য কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতার পঙক্তি ‘আমরা তো তিমির বিনাশী’।

এ বছর অনুষদের ২৫তম ব্যাচ দায়িত্ব পেয়েছে। বিভিন্ন মোটিফে সজ্জিত থাকছে এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রা। টেপা পুতুল, হাতি, গন্ধগোকুল, চাকার একটি ডেকোরেটিভ ডিজাইন— এই চার স্ট্রাকচার এবারের শোভাযাত্রায় স্থান পেতে যাচ্ছে।

কথা হলো প্রাচ্যকলার শিক্ষার্থী রাশেদ রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন,  রোজা ও ঈদের ছুটিতে ইতিমধ্যে অনেকে ক্যাম্পাস ছেড়েছেন। ফলে শোভাযাত্রার প্রস্তুতির কর্মযজ্ঞে উপস্থিতি তুলনামূলক কম। এরপরও আমরা সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়ে কাজ করে চলছি। বিগত বছরগুলোর মতো আয়োজনে কোনও কমতি থাকবে না। আশা করছি, এ বছরও জাঁকজমকপূর্ণভাবে মঙ্গল শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হবে।

পুরো আয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাপ্ত বরাদ্দ এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের তৈরি সরা, মুখোশ ও পেইটিং বিক্রি করে শোভাযাত্রার খরচ বহন করা হয়। এ বছর আনুমানিক ১২ লাখ টাকা বাজেট ধরা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে রাশেদ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক ধরনের বাজেট দেওয়া হয়, যা অনেকটাই অপ্রতুল। তবে সবমিলিয়ে যে বাজেট নির্ধারণ করা হয়েছে, এর মধ্যেই সবকিছু সম্পন্ন করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে। বাকিটা শিক্ষার্থীদের শিল্পকর্ম বিক্রয়কৃত অর্থেই সামাল দেওয়া হবে।

শোভাযাত্রার প্রস্তুতির কারণে অনেক শিক্ষার্থীই ঈদের ছুটিতে বাড়িমুখো হচ্ছেন না। প্রিন্টমেকিং বিভাগের শিক্ষার্থী অথৈ রাহা তাঁদেরই একজন। তিনি বললেন, ‘আমরা গত বছর থেকে এ ব্যাপারে অবগত। এবারের মঙ্গলশোভাযাত্রার কাজ আমাদের করতে হবে, তাই আমাদের অনেকেই ছুটিতে বাড়ি যাচ্ছি না।’ আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে মঙ্গল শোভাযাত্রার একটি বড় অংশের প্রস্তুতি শেষ হবে বলেও জানান তিনি।

মঙ্গল শোভাযাত্রার সার্বিক বিষয়ে কথা হলো উপ-কমিটির আহ্বায়ক চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, শোভাযাত্রার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত শোভাযাত্রার প্রস্তুতি চলবে। রোজা আমাদের আয়োজনে বড় কোনও প্রভাব ফেলে নি। কেননা, এর আগেও ছেলেমেয়েরা রোজা রেখে কাজ করে গেছে। কিন্তু ঈদের ছুটি হওয়াতে অনেকেই চলে যাবে। তবে ঢাকায় যেসব শিক্ষার্থী রয়েছে, তাঁদের নিয়েই আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো, যেন এবারের শোভাযাত্রাও বড় পরিসরে করা যায়।

এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে কবি জীবনানন্দ দাশের ‘তিমির হননের গান’ কবিতা থেকে ‘আমরা তো তিমিরবিনাশী’ বাক্যটি।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেন, মঙ্গল শোভাযাত্রা থেকে বরাবরই তরুণরা একটি বার্তা দেয়। সেই বার্তাটি হলো আমরা তিমির বিনাশী, আমরা অন্ধকারের বিপক্ষে, আলোর পক্ষে। আর কুসংস্কার, পশ্চাৎপদতা, উগ্রতা থেকে মুক্তির আহ্বান থাকে।