‘হোলি আর্টিজানে হামলার পর ঘুরে না দাঁড়ালে পদ্মা সেতু হতো না।’
নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলা কাগজ : হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াতে না পারলে পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেলের মতো প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা যেতো না বলেই জানিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শফিকুল ইসলাম।
হোলি আর্টিজানে হামলার সময় জিম্মিদের উদ্ধার করতে গিয়ে নিহত ২ পুলিশ কর্মকর্তার স্মরণে নির্মিত ‘দীপ্ত শপথ’ ভাস্কর্যে শুক্রবার (পহেলা জুলাই) শ্রদ্ধা জানাতে এসে তিনি এ কথা বলেন।
গুলশানে হোলি আর্টিজান বেকারিতে সন্ত্রাসী হামলার ৬ বছরের দিনে নিহত দেশি-বিদেশিদের গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করেন ডিএমপি কমিশনার।
সকাল ১১টায় ডিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে পুরাতন গুলশান থানার ‘দীপ্ত শপথ’ ভাস্কর্যে নিহতদের স্মরণে ফুলেল শ্রদ্ধা জানান তিনি।
এ ছাড়া ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন করেন র্যাবের মহাপরিচালক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটের মহাপরিচালক কামরুল আহসান, বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও এসবির মহাপরিচালক মনিরুল ইসলামসহ পুলিশের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
ডিএমপি কমিশনার বলেন, হোলি আর্টিজানের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পরে যদি আমরা ঘুরে দাঁড়াতে না পারতাম, তাহলে আজকে যে পদ্মা সেতু দেখছি, মেট্রোরেল দেখছি তার কোনও কিছুই বাস্তবায়ন করতে পারতাম না। তখন হয়তো দেশের চিত্রটা অন্যরকম হতো; ঘুরে দাঁড়াতে না পারলে কোনও বিদেশি টেকনিশিয়ান-ইঞ্জিনিয়ার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশে আসতেন না।
তিনি বলেন, নব্য জেএমবির সদস্যদের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা থাকলেও হোলি আর্টিজানের ঘটনার পর ধারাবাহিক অভিযানে জঙ্গিদের রুখে দিতে সক্ষম হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
তবে দেশে এখনো কিছু জঙ্গি তৎপরতা রয়েছে জানিয়ে ডিএমপি কমিশনার বলেন, ‘এখনো কিন্তু তাদের তৎপরতা মাঝে মাঝে চোখে পড়ছে। আমরা তাদের সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শুরু করে সব কিছুতে মনিটর করছি। মাঝে মাঝে কিন্তু আপনারা দেখবেন, আমাদের অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট (এটিইউ), আমাদের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট (সিটিটিসি) বিভিন্ন জেলায় অভিযান চালিয়ে এই জঙ্গিদের গ্রেপ্তার করছে। তাদের যে নেটওয়ার্ক তৈরি করার চেষ্টা, সেটা শুরুতেই আমরা নস্যাৎ করে দিচ্ছি।’
শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের বিস্তার আফগান ফেরত মুজাহিদদের হাত ধরে। এরপর যখন ইরাকে আইএসের তৎপরতা শুরু হলো, তখন তাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বাংলাদেশের কিছু মানুষ কানাডা ফেরত তামিম চৌধুরীর নেতৃত্বে দলবদ্ধ হলো।’
হোলি আর্টিজান পরবর্তী সময়ে পুলিশের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে যুক্তরাষ্ট্রকে পাশে পাওয়ার কথা জানিয়ে ডিএমপি কমিশনার বলেন, ‘হোলি আর্টিজানে হামলার পর বাংলাদেশ পুলিশ জঙ্গি দমনের অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট নামে বিশেষায়িত ইউনিট তৈরি করে। ওই ইউনিটের বেশিরভাগ সদস্য যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ পেয়েছে। সেখান থেকে অস্ত্র ও তাঁদের যে প্রটেকটিভ গিয়ার, সেগুলোও যুক্তরাষ্ট্র সরকার আমাদের সরবরাহ করেছে। এসব সরঞ্জাম পাওয়ার পর চট্টগ্রাম থেকে শুরু করে আমাদের সিলেট, মৌলভীবাজার এমনকি খুলনা বিভাগেরও কয়েকটি জেলাসহ যেখানেই আমরা খবর পেয়েছি... পুরো জঙ্গি নেটওয়ার্কে তখন যারা ছিলো, আমরা তছনছ করে দিয়েছি।’
মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেন, ‘হোলি আর্টিজান বেকারির হামলা পরবর্তী ৬ বছরে সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধে এবং দেশের মানুষকে নিরাপদ করতে বাংলাদেশে যে ব্যবস্থাগুলো নেওয়া হয়েছে, সেজন্য আমি তাঁদের অভিনন্দন জানাতে চাই। এই সফলতার পুরো ভাগীদার বাংলাদেশ। তবে আমার ভালো লাগছে যে, এসবের জন্য সক্ষমতা বৃদ্ধি, প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জাম দিয়ে বাংলাদেশের পাশে থাকতে পেরেছে যুক্তরাষ্ট্র।’
২০১৬ সালের পহেলা জুলাই রাতে ঢাকার গুলশানে হোলি আর্টিজান বেকারিতে নৃশংস হামলা চালায় জঙ্গিরা। তারা অস্ত্রের মুখে দেশি-বিদেশি অতিথিদের জিম্মি করে। এ নৃশংস ঘটনায় নিহত হন ২২ জন। এ ঘটনায় স্তম্ভিত হয়ে পড়ে পুরো দেশ। সেদিন জঙ্গিরা কুপিয়ে ও গুলি করে যাঁদের হত্যা করেছিলো, তাঁদের মধ্যে ছিলেন ৯ জন ইতালীয়, ৭ জন জাপানি, ১ জন ভারতীয় এবং ৩ জন বাংলাদেশি। সেই রাতে অভিযান চালাতে গিয়ে নিহত হন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল করিম এবং বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ সালাউদ্দীন। এই ২ জন কর্মকর্তার স্মরণে দীপ্ত শপথ ভাস্কর্যটি নির্মাণ করা হয়েছে।
ওইদিনের নৃশংস হামলায় নিহত ২২ জনের ৯ জন ছিলেন ইতালির নাগরিক, যাঁদের বেশিরভাগই বাংলাদেশের পোশাক শিল্প খাতে কাজ করতেন। তাঁরা হলেন : নাদিয়া বেনেডেট্টি, ক্লদিও ক্যাপেলি, ভিনসেনজো ডি অ্যালেস্ট্রো, ক্লদিয়া মারিয়া ডি, অ্যান্টোনা, সিমোনা মন্টি, অ্যাডেলে পুগলিসি, ক্রিস্টিয়ান রসি, মারিয়া রিবোলি ও মার্কো টোনডাট। ৭ জন জাপানি নাগরিক, যাঁরা ঢাকায় এসেছিলেন বিশেষজ্ঞ হিসাবে, ঢাকার তীব্র ট্রাফিক জ্যাম নিরসনে সহায়তা করতে মেট্রোরেলের কাজে। তাঁরা হলেন : হিদেকি হাশিমোতো, নোবুহিরো কুরোসাকি, কোয়ো ওসাসাওয়ারা, মাকোতো ওশামুরা, ইয়োকু সাকাই, রুই শিমোদাইরা ও হিরোশি তানাকা। ওইদিন নিহত একজন ছিলেন ভারতীয় নাগরিক। তার নাম ছিলো তারিশি জৈন।
রাতভর এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পর পুলিশ ও সেনাবাহিনীর প্রতিরোধ অভিযানে ৩২ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। যাঁর মধ্যে প্রথমে পুলিশের অভিযানে উদ্ধার হয় ২ জন বিদেশিসহ ১৯ জন, এরপর সেনাবাহিনীর অভিযানে উদ্ধার হয় দেশি-বিদেশি মোট ১৩ জন।