২০২২-এর অর্জন ও ২০২৩-এর চ্যালেঞ্জসমূহ
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া :: নতুন বছরের শুরুতেই অর্থনীতিতে বইতে শুরু করেছে সুবাতাস। বৈশ্বিক সংকট ও মন্দার আশঙ্কার মধ্যেও দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পালে হাওয়া লেগেছে। বৈদেশিক আয়ের প্রধান খাত রপ্তানি আয়ে গড়েছে রেকর্ড। গত নভেম্বর মাসে রপ্তানি খাত প্রথম বারের মতো ৫০০ কোটি ডলার আয়ের মাইলফলক অর্জন করে। প্রথম বারের মতো কোনো এক মাসে রপ্তানি থেকে ৫০৯ কোটি ডলার আয় করে। সেই রেকর্ড ভেঙে গেছে পরের মাসেই। ডিসেম্বর মাসেও রপ্তানি আয়ে রেকর্ড গড়েছে দেশ। এই মাসে রপ্তানি আয় হয়েছে ৫৩৬ কোটি ডলারের বেশি। গেল ২০২২ সালকে দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের বছর বলা যায়। পদ্মা সেতু, ১০০ সেতু ও মেট্রোরেল এ বছর চালু হয়েছে। আর চলতি ২০২৩ সাল হবে উন্নয়নের মাইলফলকের বছর। কেননা, এ বছর আরো কয়েকটি মেগা প্রজেক্ট চালু হতে যাচ্ছে।
গত বছর অনেক ষড়যন্ত্রের জাল আর প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে আমরা পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শেষ করতে পেরেছি। এই সেতু দেশের দক্ষিণাঞ্চলকে সরাসরি রাজধানীসহ অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত করেছে। আশা করা হচ্ছে, এই সেতু জিডিপিতে ১ দশমিক ২ শতাংশ হারে অবদান রাখবে। গত বছরের শেষ নাগাদ উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার অংশে চালু হওয়া মেট্রোরেল রাজধানী ঢাকার পরিবহন খাতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসবে। আগামী অক্টোবর মাসে চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে চালু হবে দেশের প্রথম টানেল। অন্যান্য বৃহত্ প্রকল্পের কাজও পুরোদমে এগিয়ে চলেছে। ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন প্রথম ইউনিট আগামী বছরের এপ্রিল নাগাদ চালু হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। জনগণের সরকার হিসেবে মানুষের জীবনমান উন্নয়ন করা এই সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য বলেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মনে করেন। গত ১৩ বছরে এই সরকার জনগণেরর জন্য কী কী করেছে, তা জনগণই মূল্যায়ন করবে। তবে সরকার যেসব ওয়াদা দিয়েছিল, তার অধিকাংশ সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে পেরেছে।
বিদ্যুৎ বর্তমান সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পণ্য। ২০০৯ সালে এই সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের আগে বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতির কথা সবারই মনে আছে। তখন সাকল্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। বর্তমানে দৈনিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার ২৩৫ মেগাওয়াট। মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে শতভাগ মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। সেই প্রতিশ্রুতি অক্ষরে অক্ষরে পূরণ হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পায়রায় ইতিমধ্যে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। রামপাল, পায়রা, বাঁশখালী, মহেষখালী ও মাতারবাড়ীতে আরো মোট ৭ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট শক্তিসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। ২০০৯ সালে জাতীয় গ্রিডে ১ হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হতো, বর্তমানে যা ২ হাজার ৫২৫ মিলিয়ন ঘনফুটে দাঁড়িয়েছে। গ্যাসের অব্যাহত চাহিদা মেটাতে ২০১৮ থেকে তরলীকৃত গ্যাস আমদানি করা হচ্ছে। নতুন বছরের শুরুতে আমাদের জন্য সুখবর হচ্ছে :বঙ্গোপসাগরে যে গ্যাস হাইড্রেটের সন্ধান পাওয়া গেছে, তার পরিমাণ ১৭ থেকে ১০৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট।
আজ খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। বর্তমানে দানাদার খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ৫৫ লাখ মেট্রিক টন। বাংলাদেশ বিশ্বে ধান, সবজি ও পেঁয়াজ উৎপাদনে চতুর্থ স্থানে উন্নীত হয়েছে। অব্যাহত নীতিসহায়তা ও প্রণোদনার মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে এই বিপ্লব সাধিত হয়েছে। মাছ-মাংস, ডিম, শাকসবজি উৎপাদনেও বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্থানে এবং ইলিশ উৎপাদনকারী ১১ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম। ২০১৮ সালের নির্বাচনি ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত করা হয় ‘আমার গ্রাম, আমার শহর’-এর ভাবনা। এই প্রতিপাদ্য সামনে রেখে প্রতিটি গ্রামে আধুনিক নগরসুবিধা সম্প্রসারণের কাজ চলছে।
আজ দেশের প্রায় সব গ্রামে পাকা সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০২১ পর্যন্ত পল্লি এলাকায় ৬৬ হাজার ৭৫৫ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়ন, ৩ লাখ ৯৪ হাজার ব্রিজ-কালভার্ট, ১ হাজার ৭৬৭টি ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স ভবন, ১ হাজার ২৫টি সাইক্লোন সেল্টার এবং ৩২৬টি উপজেলা কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ ও সম্প্রসারণ করা হয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ৪৫৮ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক চতুর্থ বা তদূর্ধ্ব লেনে উন্নীত করা হয়েছে। আরো ৮৮৭ কিলোমিটার মহাসড়ক চার ও তদূর্ধ্ব লেনে উন্নীত করার কাজ চলছে। ঢাকায় বিমানবন্দর থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত ৪৬ দমমিক ৭৩ কিলোমিটার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ ২০২৩ সাল নাগাদ শেষ হবে। বাংলাদেশ রেলওয়েকে যুগোপযোগী ও আধুনিক গণপরিবহন হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে বর্তমানে ১৩ হাজার ৩৭১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ৩৭টি প্রকল্পের কাজ চলছে। ঢাকার চারদিকে সার্কুলার রেললাইন স্থাপনের সমীক্ষার কাজ চলছে। ২০০৯ থেকে ২০২১ পর্যন্ত ৪৫১ কিলোমিটার নতুন রেলপথ নির্মাণ এবং ১ হাজার ১৮১ কিলোমিটার রেলপথ পুনর্বাসন করা হয়েছে। ৪২৮টি নতুন রেলসেতু নির্মাণ করা হয়েছে। যমুনা নদীর ওপর ৪ দশমিক ৮ কিলোমটির দীর্ঘ বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে সেতুর নির্মাণকাজ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ বিমান এয়ারলাইনসের বিমানবহরে ১২টি নতুন অত্যাধুনিক বোয়িং ও ড্রিমলাইনার উড়োজাহাজ সংযোজিত হয়েছে। সংযোজিত হয়েছে তিনটি ড্যাশ-৮-৪০০ উড়োজাহাজ।
শিক্ষায় উন্নতি, যোগাযোগের অবকাঠামো, নারীর শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে বই বিতরণ, সামাজিকভাবে সুবিধাবঞ্চিত, অসহায়, বয়স্ক, বিধবা, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সুরক্ষার সোশ্যাল সেফটি নেট সাপোর্ট প্রদান, সর্বজনীন পেনশন স্কিম, স্বামী পরিত্যক্তা নারীদের সহযোগিতা, অটিজম, প্রধানমন্ত্রীর সরকারের প্রধান উদ্যোগসমূহ বাংলাদেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান ভূমিকা পালন করছে। মুক্তিযোদ্ধাদের জাতীয় বীর হিসেবে মর্যাদা প্রদান, আশ্রয়ন প্রকল্প, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প, নারীর ক্ষমতায়ন এবং বিভিন্ন সেক্টরের সামগ্রিক উন্নয়ন তার সরকারেরই অবদান। একটি ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আধুনিক বাংলাদেশ গড়ে উঠেছে—আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে এটিই আশার কথা।
জলবায়ু পরিবর্তনের ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবিলা করে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য এর আগে এই সরকার ‘বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০’ শীর্ষক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এই পরিকল্পনার আওতায় ৬৪টি জেলায় প্রায় চার হাজার ৪৩৯ কিলোমিটার নদী, খাল ও জলাশয় খনন করা হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। সারা দেশে সাড়ে ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে গ্রামীণ নারী-শিশুসহ সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে বিনা মূল্যে ৩০ ধরনের ওষুধ দেওয়া হয়। আমাদের স্বাস্থ্যসেবার সম্প্রসারণ ও গুণগত মানোন্নয়নের ফলে মানুষের গড় আয়ু ২০১৯-২০ বছরে ৭২ দশমিক ৮ বছরে উন্নীত হয়েছে। পাঁচ বছর বয়সি শিশু মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ২৮ এবং অনূর্ধ্ব এক বছর বয়সি শিশু মৃত্যুর হার ১৫তে হ্রাস পেয়েছে। মাতৃমৃত্যুর হার কমে দাঁড়িয়েছে প্রতি লাখে ১৬৫ জনে।
প্রধানমন্ত্রী দেশের অর্জনের জন্য চারটি মাইলফলক নির্ধারণ করেছেন। প্রথমটি ২০২১ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকল্প, যা এখন একটা ভালো অবস্থানে রয়েছে; দ্বিতীয়টি ২০৩০ সালে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জন; তৃতীয়টি ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলা এবং চতুর্থটি ২১০০ সালের ডেলটা প্ল্যান। সব নাগরিককে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত (এসডিজি-১ দারিদ্র্য অবসান এবং এসডিজি-২, জিরো হাঙ্গার অর্জন) একটি উন্নত বাংলাদেশের জন্য কাজ করতে হবে এবং বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনা সমুন্নত রাখতে হবে। বাংলাদেশের সম্পদ সীমিত, ভূমির তুলনায় জনসংখ্যা বেশি। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ আজ বিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোল মডেল।
বাংলাদেশ শেখ হাসিনার গত এক যুগের শাসনামলে এগিয়ে গেছে দুর্বার গতিতে। বেশ কিছু সামাজিক সূচকের পাশাপাশি অর্থনীতির সূচকেও উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে। এমডিজি সফলভাবে বাস্তবায়ন করেছে, এসডিজি বাস্তবায়নের পথে। মাত্র এক যুগ আগেও যে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি প্রায় দ্বিগুণ ছিল, তারাও পেছনে পড়ে যাচ্ছে। করোনা মহামারির অভিঘাত এবং গত বছর থেকে শুরু হওয়া ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে পৃথিবীব্যাপী মূল্যস্ফীতি দেখা দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তার নেতিবাচক প্রভাব আমাদের দেশের ওপর পড়ে নি—এ কথা আমরা বলতে চাই না। তবে বাংলাদেশ করোনার মতো এই মানবসৃষ্ট কৃত্রিম দুর্যোগ মোকাবিলা করেও এগিয়ে চলেছে। এর কৃতিত্ব এই সরকারকে না দিলে কি অনায্য হবে না? বলা হচ্ছে, বিশ্বব্যাপী ২০২৩ সাল হবে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য আরো চ্যালেঞ্জস্বরূপ। তবে আমরা এ বছরের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায়ও সফল হব বলে আশা রাখি। এর জন্য পোশাকশিল্পের অগ্রগতি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ ধরে রাখার পাশাপাশি দেশে সামাজিক-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও বজায় রাখতে হবে।
লেখক : ট্রেজারার, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়