৯ মাসেই প্রথমবারের মতো ১ শ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে বাণিজ্য।

৯ মাসেই প্রথমবারের মতো ১ শ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে বাণিজ্য।

নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলা কাগজ : প্রথমবারের মতো আমদানি ও রপ্তানি মিলিয়ে বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যের অর্থমূল্য ১ শ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক ছাড়িয়েছে। চলতি অর্থবছরের নয় মাসেই (জুলাই-মার্চ) এ অর্জনের চিত্র উঠে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যানে। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাণিজ্যের বর্তমান অর্থমূল্যে বিশ্বব্যাপী পণ্যদ্রব্যের দাম ও পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাওয়ার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। তবে শুধু অর্থমূল্যে নয়, বাণিজ্যে পণ্যের পরিমাণও আগামী দিনগুলোয় ক্রমেই বাড়বে। আর সেই ভার বহনের সক্ষমতা গড়ে তুলতে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইপিবির পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশের বাণিজ্যের আকার ছিলো ৭ হাজার ৮১৯ কোটি ৬৭ লাখ ডলার। এর পরের অর্থবছর ২০১৭-১৮-তে বাণিজ্য বেড়ে হয় ৮ হাজার ৯৬০ কোটি ডলারের। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাণিজ্য প্রথমবারের মতো ৯৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। ওই অর্থবছর আমদানি-রপ্তানির মোট পরিমাণ ছিল ৯ হাজার ৬৫৯ কোটি ৫৮ লাখ ডলার।

২০১৮-১৯-এর তুলনায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাণিজ্য কমে যায়। পরিমাণ ছিলো ৮ হাজার ২৩৭ কোটি ৩৯ লাখ ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাণিজ্য আবারো বেড়ে গিয়ে হয় ৯ হাজার ৩১৬ কোটি ৯ লাখ ডলার। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসেই বাণিজ্য ১০ হাজার ৫১০ কোটি ৪৩ লাখ ডলার ছাড়িয়েছে। এরই মধ্যে রপ্তানি হয়েছে ৩ হাজার ৮৬০ কোটি ৫৬ লাখ ডলারের পণ্য। আর আমদানি হয়েছে ৬ হাজার ৬৪৯ কোটি ৮৭ লাখ ডলারের পণ্য।

আমদানি ও রপ্তানি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে বাংলাদেশে রপ্তানি প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি চলে গেছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই আমদানি-রপ্তানি মিলিয়ে মোট বাণিজ্য ১ শ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে, যা দেশের উদ্যোক্তাদের বাণিজ্য সক্ষমতার প্রমাণ। তবে বর্তমানে বাণিজ্য পরিসংখ্যানে বেশকিছু বিষয়ের প্রতিফলন রয়েছে। কোভিড-১৯ থেকে পুনরুদ্ধার পর্ব, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ— এ দুটি বিষয়কে বিবেচনায় নিতে হবে। করোনার কারণে ওই সময়ে আমদানি কম হয়েছে। মানুষের ভোগ-চাহিদা কমে গিয়েছিলো, উৎপাদনও কমে গিয়েছিল। এ সবকিছুই ব্যাপক হারে বেড়ে যায় কোভিডকাল পেরিয়ে।

কোভিড পুনরুদ্ধার পর্বে কাঁচামালের দামও বেড়ে যায়। আবার আমদানি বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি পরিবহন খরচও বেড়েছে ব্যাপক হারে। কোভিডের পর এখন বাণিজ্যসংশ্লিষ্টদের ভোগান্তির বড় কারণ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। বৈশ্বিকভাবে তেলের দাম বেড়েছে। খাদ্যশস্যের সংকট বেড়েছে। দেশে ভোজ্যতেলেও যার অস্থিরতা দেখা গিয়েছে। বিশ্বব্যাপী সব পণ্যের দামই এখন বেশি। যে তুলার দাম ছিল ৭০ সেন্ট, সেটার দাম হয়ে গেল দেড় ডলার। এলএনজির দাম বেড়েছে। পেট্রোকেমিক্যালের দাম বেড়েছে। অনেক পণ্যেই বাংলাদেশের আমদানিনির্ভরতা আছে। সব পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার প্রভাবে আমদানিও বেড়ে গিয়েছে।

বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী (পারভেজ) বাঙলা কাগজ ও ডনকে বলেন, অর্থমূল্য বিবেচনায় আমদানির পরিমাণ বড় দেখা যাচ্ছে। হয়তো ১ শ বিলিয়ন অতিক্রম হতে আরো দুই-তিন বছর লাগত। কিন্তু আমদানি পণ্যের দাম এবং পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় এখন আমদানি অর্থমূল্য অনেক বেশি বেড়েছে। পণ্যের পরিমাণ বিবেচনায় নিলে হয়তো ততটা বাড়েনি। কারণ গ্যাস-বিদ্যুতের ব্যবহার ততটা বাড়েনি। বর্তমান বাণিজ্যভার সেটা যতটাই হোক আমাদের চট্টগ্রাম বন্দর বহন করছে। আবার মোংলা বন্দরের সক্ষমতাও ক্রমেই বাড়ছে। অন্যান্য বন্দরও সক্রিয় হতে শুরু করেছে। ভবিষ্যৎ বাণিজ্য আকারের বিষয় মাথায় রেখেই বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। অর্থনৈতিক অঞ্চলে এরই মধ্যে উৎপাদন কার্যক্রম সক্রিয় হতে শুরু করেছে। আমরা সামনে অগ্রসর হচ্ছি, সঠিক পথেই আছি। আগামী তিন বছর যেগুলো না করলেই নয় এমন পদক্ষেপগুলো চিহ্নিত করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। বিশেষ করে ডলার ব্যয়ের বিষয়ে সাশ্রয়ী হতে হবে। যেকোনো সংকট নতুন সম্ভাবনা উন্মোচনের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। কাজেই ভবিষ্যৎ বাণিজ্য নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই।

সরকারের প্রতিনিধিরা বলছেন, বর্তমানে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বৈদেশিক আমদানি বাণিজ্যের ভূমিকা অতিগুরুত্বপূর্ণ। খাদ্যশস্য, কৃষি উপাদান, শিল্পের মেশিনারি, কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশ, জ্বালানি এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদার একটি বৃহৎ অংশ আমদানির মাধ্যমেই মেটানো হয়। জাতীয় বাজেটের অর্থসংস্থানের ক্ষেত্রে আমদানি উদ্ভূত কর ও শুল্ক দেশের অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণের প্রধানতম আয়ের উৎস। দেশের অর্থনীতিতে আমদানি বাণিজ্যের এ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অদূরভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে বলে ধারণা করা যায়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ভারসাম্য অর্জন অর্থাৎ রপ্তানি আয়ের তুলনায় আমদানি ব্যয় কমানো সরকার ঘোষিত নীতি এবং এ পরিপ্রেক্ষিতে সীমিত সাফল্য অর্জিত হলেও সংগতকারণেই বিগত বছরগুলোয় আমদানি বৈশিষ্ট্যগত পরিবর্তন বিশেষভাবে লক্ষণীয়। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বার্ষিক আমদানির মধ্যে ভোগ্যপণ্য ও প্রস্তুতকৃত পণ্যদ্রব্যের প্রাধান্য ছিল। সাম্প্রতিক কালে এ প্রাধান্য ক্রমান্বয়ে কমেছে এবং তুলনামূলকভাবে শিল্পের কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি এবং যন্ত্রাংশ আমদানির হার ও পরিমাণ বাড়ছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতিতে, বিশেষ করে রপ্তানিমুখী শিল্প এবং আমদানি প্রতিকল্প শিল্পের ওপর প্রদত্ত অগ্রাধিকারের ফলে আমদানির হার ও পরিমাপ যে আরো বাড়বে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নীতিমালা প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধারায় কৌশলগত পরিবর্তন ও বিন্যাস করা হয়েছে। এ সময়ে যে দৃশ্যমান নীতি পরিবর্তন ঘটে তা হলো মুক্তবাজার অর্থনীতিতে ধারাবাহিক ও পদ্ধতিগতভাবে উত্তরণ। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে ব্যক্তি খাতকে প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। বৈদেশিক বাণিজ্যের ওপর ভিত্তি করে ২০৪১ সালে উন্নত রাষ্ট্রের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথে রয়েছে বাংলাদেশ।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ বাঙলা কাগজ ও ডনকে বলেন, কোভিডের আগেও দেশের বাণিজ্য ১ শ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি পৌঁছেছিল। কিন্তু পরে তা আর হয়নি। চলতি অর্থবছরের নয় মাসেই বাণিজ্য ১ শ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। ১০ মাস হিসাব করলে দেখা যাবে আরো বেড়েছে। কারণ আমদানি বৃদ্ধিসহ পণ্যের পাশাপাশি সেবা রপ্তানির পরিমাণ বিবেচনায় নিলে মোট বাণিজ্যের আকার অনেক বেশি। যা-ই হোক, নয় মাসে বাণিজ্যের আকার ১ শ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাওয়া অবশ্যই একটা মাইলফলক। চলতি অর্থবছরে বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকলে পণ্য ও সেবা মিলিয়ে শুধু রপ্তানি ৬০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি পৌঁছে যাবে। বাণিজ্য ক্রমেই আরো বাড়বে। আর বাণিজ্যভার বহনের সক্ষমতাও সমান্তরালভাবে বাড়ছে।

রপ্তানিকারকদের সংগঠন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী, এমপি বাঙলা কাগজ ও ডনকে বলেন, আমরা গভীর সমুদ্রবন্দর উন্নয়নের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছি। খুব বেশি সময় লাগবে না। পদ্মা সেতু নিয়েও অনেকে অনিশ্চয়তার কথা বলেছিল, কিন্তু আগামী ২৫ জুন সেতুটি উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। নিজেদের অর্থায়নেই এটা সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় মনোভাবের কারণে। আমাদের অনেক বড় মেগা প্রকল্প চলছে। আবার রপ্তানিও বাড়ছে। এসব কর্মকাণ্ডে কাঁচামাল আমদানি স্বাভাবিকভাবেই বেড়েছে। কোভিড-১৯ সময়ে বাংলাদেশের পণ্য প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের প্রতি ক্রেতাদের আস্থা অনেক বেড়েছে। কারণ কাঁচামালের দাম, পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাওয়ার পরও আমরা ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ করতে পেরেছি। এখন আমাদের ভোগাচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত। রপ্তানি যেহেতু বাড়ছে, আমদানি বাড়বেই। আবার রেমিট্যান্সও খুব খারাপ অবস্থায় নেই। আগামী দিনে দেশের অর্থনীতির পথচলা মসৃণ হলেও অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। আর সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য আমরা প্রস্তুত। ব্যবসার চর্চায় ক্রেতাদেরও নৈতিক মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ দেখাতে হবে। ভবিষ্যতে আমাদের রপ্তানিও বাড়বে আবার আমদানিও বাড়বে। তবে ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদের ভয়ের কিছু নেই।