মাল্টিন্যাশনালে দেশের প্রথম নারী এমডি রূপালী চৌধুরী
নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলার কাগজ : বার্জারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে আছেন রূপালী চৌধুরী। তিনিই প্রথম বাংলাদেশি নারী, যিনি কোনও বহুজাতিক কোম্পানির এতো বড় পদে নিয়োগ পান। ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির মতো বড় বড় সংগঠনে নেতৃত্বও দিয়েছেন। বর্তমানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব পাবলিকলি লিস্টেড কোম্পানিজের। বাণিজ্যিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির (সিআইপি) স্বীকৃতিও পেয়েছেন তিনি।
রসায়নে স্নাতক করলেও স্নাতকোত্তর আর করেন নি। ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটে (আইবিএ)। বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হওয়ায় শুরুতে ব্যবসায় প্রশাসনের অনেক কিছুই ছিলো দুর্বোধ্য। তবে পরবর্তী সময়ে সব প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ওঠেন। এমবিএ সম্পন্ন করে যোগ দেন একটি একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে। এরপর মেধা ও চেষ্টা দিয়ে পার হন একেকটা ধাপ। সর্বশেষ বহুজাতিক (মাল্টিন্যাশনাল) কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে বসে ইতিহাসের অংশ হয়ে যান রূপালী চৌধুরী।
রূপালী চৌধুরীর বাবা প্রিয় দর্শন চৌধুরী ছিলেন একজন চিকিৎসক। কলকাতায় পড়াশোনা করে সেখানেই চিকিৎসা পেশায় যুক্ত ছিলেন। কিন্তু রূপালী চৌধুরীর দাদী চেয়েছিলেন ছেলে দেশের মানুষের সেবা করুক। মায়ের এ ইচ্ছায় দেশে ফেরেন প্রিয় দর্শন চৌধুরী।
রূপালী চৌধুরীর উচ্চশিক্ষা শুরু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। রসায়নে স্নাতক করেন তিনি। এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএর এমবিএতে। এমবিএ করার পর ১৯৮৪ সালে বহুজাতিক কোম্পানি সিবা গাইগিতে সাধারণ কর্মী হিসেবে যোগ দেন তিনি। শুরুর দিকে তার কাজ ছিল কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে বিক্রয় ও ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত তথ্য দিয়ে সহায়তা করা। কিন্তু মেধা ও দক্ষতার কারণে এ প্রতিষ্ঠানে অল্প সময়েই বেশ সফলতা পান তিনি।
১৯৮৯ সালে এক সময়কার সহপাঠী আব্দুল হকের সঙ্গে বিয়ে হয় রূপালী চৌধুরীর। বিয়ের এক বছর পরেই চট্টগ্রামে বদলি হন আব্দুল হক। তখন রূপালী চৌধুরীও সিদ্ধান্ত নেন চট্টগ্রাম চলে যাওয়ার। এ কারণে সিবা গাইগির চাকরি ছেড়ে দেন তিনি। ওই সময় চট্টগ্রামে জনবল নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেয় বার্জার। ওই বিজ্ঞপ্তি দেখে আবেদন করেন রূপালী চৌধুরী। এরপর কয়েক ধাপের সাক্ষাৎকারে উত্তীর্ণ হয়ে প্রথম বাংলাদেশী নারী হিসেবে যোগ দেন বার্জারে।
বার্জারে যোগদান প্রসঙ্গে রূপালী চৌধুরী বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটা সংশয় ছিল যে এত পুরুষ কর্মীর মাঝে একা একজন নারী কাজ করতে পারবেন কিনা। আমি তখন বলেছিলাম, পরিবারে তো আমরা পুরুষ সদস্যদের সঙ্গে বাস করি, শিক্ষাজীবনেও পুরুষদের সঙ্গে লেখাপড়া করেছি। তাহলে কর্মক্ষেত্রে কেন সমস্যা হবে?’
এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি রূপালী চৌধুরীকে। এ প্রতিষ্ঠানেই আছেন ৩৪ বছর ধরে। মার্কেটিং, সেলস, সাপ্লাই চেইন, সিস্টেমসহ বিভিন্ন বিভাগে সাফল্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। এর মধ্যে ২০০৪ সালে ডিরেক্টর (অপারেশনস) হিসেবে পদোন্নতি পান। ২০০৮ সালে হন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এখন পর্যন্ত এ পদে তিনবার তার মেয়াদ বাড়িয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
কর্মক্ষেত্রে সফলতার বিষয়ে রূপালী চৌধুরী বলেন, ‘আমি কখনো হতাশ হইনি, হাল ছাড়িনি। সবসময় পরিশ্রম করেছি। সবসময় সব কাজ সময় অনুযায়ী করেছি, কাজ ফেলে রাখিনি। নিজেকে আর পাঁচজন কর্মীর মতো সাধারণ ভেবেছি। ফলে সবাই খুব সহজে গ্রহণ করেছে। এসব কিছুই আমাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে।’
একজন নারীকে এগিয়ে যেতে হলে সবচেয়ে বড় ভূমিকা নিজেকেই পালন করতে হবে বলে মনে করেন রূপালী চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘নারীর সমঅধিকার নিশ্চিতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আর্থিক স্বাবলম্বিতা। এজন্য নারীর নিজেকেই চেষ্টা করতে হবে। কেউ তাকে জায়গা ছেড়ে দেবে না, নিজেকেই যোগ্যতা অর্জন করে এবং দক্ষতা বাড়িয়ে জায়গা করে নিতে হবে। আমি নারী, তাই আমি এটি পারব না—এ ধরনের চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আত্মবিশ্বাস রাখতে হবে এবং হাল ছেড়ে না দিয়ে প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।’
শ্রমবাজারের উপযোগী হিসেবে গড়ে উঠতে প্রযুক্তিজ্ঞানের পাশাপাশি যোগাযোগ ও গাণিতিক দক্ষতা অর্জনের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেকে আপডেটেড রাখতে হবে। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। মাতৃভাষা অবশ্যই আমরা ভালোভাবে আয়ত্ত করব। কিন্তু আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যোগাযোগের জন্য আমাদের সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ হিসেবে ইংরেজিকেও গুরুত্ব দিতে হবে।’
এক সময় দেশের কোনও নারীই কর্মহীন থাকবে না। সবাই নিজ নিজ মেধা ও দক্ষতা ব্যবহার করে সামনে এগিয়ে যেতে পারবে—এমন স্বপ্ন রূপালী চৌধুরীর। তিনি বলেন, ‘এখন আমাদের দেশে অর্ধেকের বেশি নারী কর্মহীন। এটি কাম্য নয়। প্রতিটি মানুষই মেধাবী, প্রত্যেকের মাঝেই কোনও না কোনও দক্ষতা রয়েছে।’
নারী উদ্যোক্তা বাড়াতে দেশের আইনে কিছু পরিবর্তন আনা প্রয়োজন বলে মনে করেন রূপালী চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘একজন নারী যখন উদ্যোক্তা হতে চায়, তখন প্রথমেই প্রয়োজন হয় মূলধন। এ মূলধন সে কোথায় পাবে? সে যদি ঋণ নিতে যায় তখন আইনি কিছু জটিলতা আসে। মুসলিম শরিয়াহ আইন অনুযায়ী, নারীরা পুরুষের অর্ধেক সম্পদ পায়। আবার অনেক ধর্মীয় আইনে নারীর অধিকারের বিষয়টি আরো অস্পষ্ট। কিন্তু সম্পত্তি বণ্টনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় একটা আইনও থাকা প্রয়োজন।’
তরুণ প্রজন্মকে পরিশ্রমী হওয়ার পরামর্শ দিয়ে রূপালী চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের তরুণ প্রজন্ম অত্যন্ত মেধাবী। আমরা এ বয়সে বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে যতটা জানতাম, তারা সে তুলনায় অনেক বেশি জানে। তবে তাদের মধ্যে অস্থিরতা বেশি। সবকিছু সহজে পেয়ে যেতে চায়, অল্পতে হাল ছেড়ে দেয়। এসব বিষয় পরিহার করতে হবে। পরিশ্রমী হতে হবে, স্থিরতা আনতে হবে। জীবনে উত্থান-পতন আসবেই, কিন্তু হাল ছাড়া যাবে না। সফল হতে হলে অবশ্যই মেধা ও পরিশ্রমের সমন্বয় করতে হবে।’