ঋণ শোধ করেও চাঁপাইনবাবগঞ্জের সেই কৃষক কারাগারে!
নিজস্ব প্রতিবেদক, বাঙলার কাগজ ও ডন; রাজশাহী : কৃষক আফজাল হোসেন পুরো ঋণ পরিশোধ করে দিয়েছেন। বন্ধকি দায়মুক্তি দলিল সম্পাদনও করে দিয়েছে ব্যাংক। কথা ছিলো, সরাসরি ব্যাংকে টাকা শোধ করলেই ব্যাংক মামলা প্রত্যাহার করে নেবে। কিন্তু ব্যাংক তা করে নি। বৃহস্পতিবার (২২ ডিসেম্বর) বিকেলে কৃষক আফজাল হোসেনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠিয়েছে পুলিশ।
আফজাল হোসেনের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার বালুগ্রামে। তাঁর নামে মামলা করা হয়েছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের রহনপুর শাখার পক্ষ থেকে। কৃষক আফজাল হোসেনের ভোগান্তির বিষয়ে গত ১৫ নভেম্বর একটি দৈনিকে ‘ঋণ শোধ করেও মামলা থেকে মুক্তি মিলছে না’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
বিষয়টি জানার পর চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসক এ কে এম গালিব খান মামলাটি নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু তা সফল হয় নি। এই কৃষক গ্রেপ্তার হওয়ার খবর শুনে আজ শুক্রবার সকালে জেলা প্রশাসক বাঙলার কাগজ ও ডনকে বলেন, এটা ব্যাংকের বেনিয়াসুলভ আচরণ। ওই কৃষক তাঁর কাছে এসেছিলেন। তিনি ওই ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে বুঝিয়ে বলেছিলেন যে তারা (ব্যাংক) টাকা পেয়েছে—এই মর্মে কাগজপত্র আদালতে সাবমিট (জমা) করুক। তারপর মামলাটি নিষ্পত্তির জন্য প্রয়োজনে জেলা প্রশাসক হিসেবে তিনিও আদালতকে অনুরোধ করবেন।
জেলা প্রশাসক এ কে এম গালিব খান বলেন, যে কৃষক একবার টাকা শোধ করে দিয়েছেন, তিনি কেন শুধু মামলা নিষ্পত্তির জন্য আবার টাকা জমা দেবেন? আর এতো টাকা ওই কৃষক পাবেন কোথায়? এই দায়িত্ব ব্যাংককেই নিতে হবে। তিনি আইনের ধারা ব্যাখ্যা করেও ব্যাংক কর্মকর্তাকে বলেছেন। কৃষককে একই ঋণের টাকা দ্বিতীয়বার জমা দিতে তারা বাধ্য করতে পারে না।
সকালে কৃষক আফজাল হোসেনের মেয়ে আফিয়া জাহান বাঙলার কাগজ ও ডনকে বলেন, তাঁর বাবাকে নাচোলের কৃষি খামার থেকে গতকাল বিকেলে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। রাতেই তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তাঁর বাবার কাছে শীতের কোনো পোশাকও ছিল না। পরনে যেই পোশাক ছিল, ওই পোশাকেই পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। সকালে তাঁর মা জান্নাতুন নেসা কারগারে গিয়ে শীতের পোশাক দিয়ে এসেছেন।
গ্রেপ্তারের আগে আফজাল হোসেন বলেছিলেন, ব্যাংক শুধু ঋণের টাকা নয়, তাঁর কাছ থেকে মামলার খরচও আদায় করে নিয়েছে। ঋণ শোধ করার পর ব্যাংক বলেছে, আইনি প্রক্রিয়ায় তাঁকেই মামলা নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য তাঁকে আবার আদালতে ঋণের টাকা জমা দিতে হবে।
আফজাল হোসেন ছয় মাস কারাগারে থাকার পর চারটি মামলার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে আত্মগোপনে ছিলেন। একপর্যায়ে হয়রানি থেকে রেহাই চেয়ে তিনি জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত আবেদন করেছিলেন।
গত ৭ আগস্ট জেলা প্রশাসকের কাছে করা লিখিত আবেদনে আফজাল হোসেন উল্লেখ করেন, ২০১৫ সালের ৭ জানুয়ারি জমি বন্ধক রেখে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের রহনপুর শাখা থেকে তাঁর ‘এবি কৃষি খামার’–এর ওপর ২০ লাখ টাকা ঋণ নেন। জমিতে আম, পেয়ারা ও পুকুরে মাছ চাষ শুরু করেন। কিন্তু বৈরী আবহাওয়ার কারণে ঋণের কিস্তি সঠিকভাবে পরিশোধ করতে ব্যর্থ হন। বিষয়টি ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে জানালেও তাঁর নামে ২০১৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত চারটি মামলা করা হয়। তখন তাদের মোট দাবি ছিল ২২ লাখ টাকা।
মামলার পর আফজাল ব্যাংক ব্যবস্থাপকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আফজাল এর আগে বলেছিলেন, ব্যাংক ব্যবস্থাপক আশ্বাস দিয়েছিলেন, ঋণ শোধ করলে মামলা প্রত্যাহার করে নেবেন। এ জন্য তিনি বন্ধকি সম্পত্তি বেচে ও বিভিন্নভাবে টাকা সংগ্রহ করে সব পাওনা পরিশোধ করেন। ব্যাংক ২২ লাখ টাকার দাবিতে মামলা করেছিল। পরে সুদ, মামলার খরচসহ তাঁর কাছ থেকে ২৯ লাখ ৯১ হাজার টাকা আদায় করা হয়। ব্যাংকের ব্যবস্থাপক ওই টাকা আদালতের মাধ্যমে না নিয়ে সরাসরি ব্যাংকে জমা নেন। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ গত ১৫ ফেব্রুয়ারি রহনপুর সাব–রেজিস্ট্রি কার্যালয়ে তাঁকে বন্ধকি দায়মুক্তি দলিল নিবন্ধন করে দেয়। কিন্তু এখনো মামলা প্রত্যাহার করেনি।
আফজাল হোসেন উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। ২০০৮ সালে ‘এবি কৃষি খামার’ শুরু করেন। ১৮০ বিঘা জমি ইজারা নিয়ে তিনি আম, পেয়ারা ও মাছ চাষ শুরু করেন। লাভের টাকা দিয়ে চার বিঘা জমি কেনেন। ২০১৪ সাল পর্যন্ত তাঁর খামার ভালোই ছিল। ২০১৫ সালে ঋণ নেন। বার্ষিক সুদ ছিল ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এক বছর দেওয়ার পর তিনি আর সুদের কিস্তি দিতে পারেন নি। ব্যাংকের করা চারটি মামলার মধ্যে দুটি হাইকোর্টে চলে গেছে। চারটি মামলাতেই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে।
আফজাল হোসেনকে গ্রেপ্তারের আগে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে ইসলামী ব্যাংকের রহনপুর শাখার ব্যবস্থাপক সোলায়মান আলী বলেছিলেন, ওই কৃষকের সঙ্গে তাদের কথা হয়েছে। জমা দেওয়ার জন্য যত টাকা লাগবে, তার মধ্যে দুই লাখ টাকা আফজাল জোগাড় করতে পারছেন না। ব্যাংক তো টাকা দিতে পারে না। তবে আফজালকে সহযোগিতার জন্য তারা বলেছেন, নতুন করে একটি সম্পত্তি ব্যাংকের কাছে ওই টাকার বিপরীতে বন্ধক রাখতে হবে। তাহলে টাকা জমা হবে। ব্যাংকের অডিট নিষ্পত্তির জন্য এই আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে। এ বিষয়ে তখন আফজাল হোসেন বলেছিলেন, বন্ধক রাখার মতো তাঁর কোনও সম্পত্তি নেই।