ডন প্রতিবেদক, কুমিল্লা : কুমিল্লা শহরের প্রাণকেন্দ্রে নানুয়া দীঘির পাড়ের পূজামণ্ডপে হামলা হয় বুধবার (১৩ অক্টোবর) সকালে। এরপর বেলা ১১টার দিকে হামলা হয় শহরের চাঁন্দমনি কালী মন্দিরে।
ওই মন্দির কমিটির নেতারা বলছেন, বেলা ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত ৩ দফায় মন্দিরে হামলা হলেও ফোন করে দীর্ঘ সময় পুলিশের সাহায্য পাওয়া যায় নি।
পুলিশের সহায়তা না পাওয়ার অভিযোগ করেছে শহরের আরও দুটি মন্দির কমিটিও।
বৃহস্পতিবার (১৪ অক্টোবর) কুমিল্লার মন্দিরগুলো পরিদর্শনে গিয়েছিলেন জাতীয় হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামানিক। কালীগাছ তলা মন্দির প্রাঙ্গণে তিনি বলেন, ‘সব মন্দিরেই একই অভিযোগ যে পুলিশ আসে নি। মন্দিরের ভক্তরা বলছেন, সকাল থেকে যখন একের পর এক হামলা হচ্ছে, তখন তাঁরা পুলিশেরসঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু পুলিশ আসে নি।’
‘চাঁন্দমনি কালী মন্দিরে মই দিয়ে টপকে ভেতরে ঢুকে আগুন দেওয়া হয়। সেখানে চার ঘণ্টায়ও পুলিশ আসে নি।’
তবে মন্দিরে পুলিশের না যাওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন কুমিল্লা জেলার পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ।
বৃহস্পতিবার (১৪ অক্টোবর) বিকেলে কুমিল্লা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপারকে প্রশ্ন করা হয় পূজা ও মন্দির কমিটিগুলোর অভিযোগের বিষয়ে।
অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘মণ্ডপগুলোতে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিলো। আনসাররাও টহলে ছিলো।’
কোরআনের অবমাননার কথিত অভিযোগে বুধবার (১৩ অক্টোবর) সকালে প্রথমে হামলা হয় কুমিল্লা শহরের মধ্যস্থলের নানুয়া দীঘির পাড়ের পূজামণ্ডপে। এরপর অন্য মণ্ডপগুলোতে হামলা হয়।
কুমিল্লা মহানগর পূজা উদ্যাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক শিবু প্রসাদ দত্ত বলেন, বুধবার (১৩ অক্টোবর) কুমিল্লায় মোট আটটি মন্দিরে হামলা চালানো হয়।
এই ঘটনার জের ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে আরও মন্দিরেও হামলা হয়।
চার ঘণ্টায় ৩ দফা হামলা : নানুয়া দীঘি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে শহরের চকবাজার এলাকায় (কাপুড়িয়াপট্টি) শত বছরের পুরোনো চাঁন্দমনি রক্ষাকালী মন্দির। সেখানে সকাল ১১টার সময় প্রথম হামলা হয়েছিলো।
মন্দির কমিটির সাধারণ সম্পাদক হারাধন চক্রবর্তী জানান, প্রথম দফায় হামলার চেষ্টা হয়। তবে ফটক টপকে ঢুকতে পারে নি। সাড়ে ১২টার দিকে আরেকবার হামলার চেষ্টা হয়। কিছুক্ষণ ঢিলাঢিলি করে চলে যায়। এরপর বেলা ৩টার দিকে হামলাকারীরা মই, হাতুড়ি ও পেট্রোল নিয়ে চুড়ান্ত হামলা চালিয়ে সব ভেঙেচুড়ে, পুড়িয়ে চলে যায়।
হারাধন চক্রবর্তী বলেন, ‘‘আমি সদর থানার পরিদর্শকের (তদন্ত) সঙ্গে কথা বলেছি প্রথম দফা হামলা চেষ্টার পর ১১টার দিকে। তিনি বললেন, ‘ফোর্স পাঠাবেন’। তবে সেই ফোর্স আসে নি।’’
পরে দ্বিতীয় দফায় যোগাযোগ করা হলেও পুলিশ আসে নি জানিয়ে হারাধন চক্রবর্তী বলেন, ‘৩টার পর ফটকে মই লাগিয়ে হামলাকারীরা মন্দিরে ঢুকে তাণ্ডব চালিয়ে নির্বিঘ্নে বের হয়ে যায়। সন্ধ্যার পর জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার মন্দিরে আসেন। পুলিশ সুপার কয়েকজন পুলিশ সদস্য ও আনসার সদস্যকে এখানে পাহারায় রেখে যান।’
কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানা থেকে চাঁন্দমনি মন্দিরের দুরত্ব এক কিলোমিটারেরও কম। আধা কিলোমিটার দূরেই চকবাজার পুলিশ ফাঁড়ি। পুলিশ লাইনও খুব বেশি দূরে নয়।
চাঁন্দমনি মন্দির কমিটির সদস্য বিপ্লব ধর বলেন, হামলার পর মন্দির কমিটির নেতারা পুলিশ ও স্থানীয় রাজনীতিকদেরসঙ্গে দফায় দফায় যোগাযোগ করেও শুধু ‘পুলিশ আসছে’ এই আশার বাণীই শুনেছেন।
‘‘শেষে যখন হামলাকারীরা মই নিয়ে আসলো, তখন আমি নিজে ৯৯৯ এ ফোন করি। একজন মহিলা ফোন ধরলো। আমি কইলাম, ম্যাডাম আমাগো বাঁচান। তিনি বললেন, ‘চিন্তা কইরেন না ব্যবস্থা নিতেছি’। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সব ভাইঙা-চুইড়া হ্যাতেরা চইলা গেলো। কাউরে না পারলাম চিনতে, না পারলাম একজনরে ধইরা-বাইন্দা রাখতে।’’
পাড়ার লোকদের প্রতিরোধ : শহরের সালাহউদ্দীন রোডে কালীগাছতলা মন্দির কমিটির সহ-সভাপতি সজল কুমার চন্দ জানান, বেলা আড়াইটার দিকে তাঁদের মন্দিরে হামলা হয়। এর আগে থেকে তিনি নিজে কয়েক দফা পুলিশের সাহায্য চেয়ে ফোন করেছেন। কিন্তু কেউই আসে নি।
পাড়ার তরুণেরা একত্রিত হয়ে মন্দির রক্ষায় এগিয়ে এসেছিলো জানিয়ে তিনি বলেন, ‘হামলাকারীরা মন্দির প্রাঙ্গণ ও আশপাশের বসতবাড়িতে হামলা চালালেও তালা মেরে রক্ষা পায় মূল মন্দির ও প্রতিমা।’
মাস্টারপাড়া এলাকার বাসিন্দা শিল্পী চক্রবর্তী বলেন, ‘পাড়ার ছেলেরা সবাই মিলে প্রতিরোধ করেছে বলে রক্ষা।’
কালীগাছতলা মন্দির কমিটির তরুণ সদস্য রানা চক্রবর্তী ও বাপ্পী দাস জানান, তাঁরা যখন একত্রিত হয়ে হামলাকারীদের ঠেকানোর চেষ্টা চালাচ্ছিলেন, তখন কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর একরামুল হোসেন বাবুও তাদেরসঙ্গে ছিলেন। তিনিও বারবার পুলিশকে কল করছিলেন। তবে পুলিশ এসেছে হামলাকারীরা চলে যাওয়ার পর।
কাউন্সিলর একরামুল হোসেন জানান, তিনি হামলাকারীদের ঠেকাতে তাঁর কর্মীদের নিয়ে ছিলেন। এ সময় সহায়তা চেয়ে তিনি প্রথমে ৮ নম্বর ওয়ার্ডের বিট পুলিশের ইনচার্জকে ফোন করেন। এরপর ফোন করেন কান্দিরপাড় ফাঁড়ির ইনচার্জকে। তাঁরা দুজনই কোতয়ালি থানার ওসিকে ফোন করতে বলেন। তবে ওসিকে তিনি পান নি।
একরামুল হোসেন বলেন, ‘ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার সময় হামলাকারীদের ইটের আঘাত লাগে তার কোমরে। কোমর ব্যাথায় এখন শয্যাশায়ী তিনি।
এদিকে মন্দিরে হামলার অভিযোগে যে মামলাগুলো হয়েছে, তার একটিতে কাউন্সিলর একরামুলকেও আসামি করা হয়েছে বলে তিনি শুনেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে একরামুল বলেন, ‘একজন ফোন করে মামলার কথা জানিয়ে পালাতে বলেছে। তবে আমি এখন বিছানা থেকেই উঠতে পারছি না।’