‘টিপ পরা আমার স্বাধীনতা।’

‘টিপ পরা আমার স্বাধীনতা।’

নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলা কাগজ : কপালে টিপ পরায় ঢাকার রাস্তায় হয়রানির শিকার হওয়ার কথা জানিয়ে রাজধানীর তেজগাঁও কলেজের থিয়েটার অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের প্রভাষক লতা সমাদ্দার গতকাল শনিবার শেরেবাংলা নগর থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন অন্তত প্রতিবাদটা হোক। লতা সমাদ্দারের সেই আন্দোলন গতকাল শনিবার থেকেই ছড়িয়ে গেছে ফেসবুকের দেয়ালে। ফেসবুকে নারীরা টিপ পরা ছবি দিয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। সংখ্যায় খুব বেশি না হলেও পুরুষেরাও প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। শুধু ফেসবুক নয়, নারী অধিকার নিয়ে কর্মরত বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা বিবৃতি এবং প্রতিবাদ সমাবেশ করেও লতা সমাদ্দারের প্রতি সংহতি প্রকাশ করছেন। আন্দোলনকারীরা বলছেন, টিপ পরা আমার স্বাধীনতা। আজ রবিবার (৩ এপ্রিল) বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, স্বাধীনতার ৫২ বছর পরে স্বাধীন সার্বভৌম একটি রাষ্ট্রে এ ঘটনা বিশেষভাবে উদ্বেগজনক। এ ধরনের ঘটনা বাংলার আবহমানকালের জাতি ধর্ম, বর্ণ, গোত্রনির্বিশেষে মানুষের সাংস্কৃতিক অধিকার ও নারীর সাজ এবং পোশাকের অধিকারকে বাধাগ্রস্ত করার অপপ্রয়াস। জননিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ প্রশাসনের কোনো ব্যক্তির মাধ্যমে সংঘটিত এই ন্যক্কারজনক ঘটনা সম্মিলিতভাবে এখনই প্রতিহত করা দরকার। আন্দোলনকারীরা বলছেন, লতা সমাদ্দারের ঘটনাটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটি ধর্মান্ধ ও নারী স্বাধীনতা বিরোধীদের এক গভীর ষড়যন্ত্র এবং নিরবচ্ছিন্ন অপতৎপরতা। তাই যার যার অবস্থান থেকে এ ধরনের ঘটনা ও আচরণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। নারী অধিকারকর্মীরাও লতা সমাদ্দারের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বলেছেন, এ ধরনের ঘটনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে আমাদের রাজনীতি এবং সামাজিক সংস্কৃতিতে সাম্প্রদায়িকতা এবং ভিন্নমত ও ভিন্ন পরিচয়ের প্রতি অসহিষ্ণুতাকে যথেষ্ট প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে। ধর্মীয় অনুভূতিকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এখন যখন রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সদস্যরাও প্রকাশ্যে এ রকম আচরণ করার দুঃসাহস দেখাতে পারছে এ কথা বলা অন্যায় হবে না রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারক ও নির্বাহীদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তি রোধে যথাযথ মনোযোগ দেওয়া হয় নি। এটি দুঃখজনক। আশা করি সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে এই ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ পদক্ষেপ নেবে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বাঙলা কাগজ ও ডনকে বলেন, ‘ম্যাচিং টিপ হাতের কাছে না পেলে অনেক সময় টিপ পরা হয় না। এখন তো মনে হচ্ছে বেশি করে টিপ পরতে হবে।’ রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, ‘স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে, মুক্তিযুদ্ধের ধারকবাহক সরকারের আমলে এ ধরনের ঘটনা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। এ ধরনের পশ্চাৎপদ মনমানসিকতাকে অশনিসংকেত বলেই মনে হচ্ছে। বাঙালি সংস্কৃতির অংশ শাড়ি, টিপ—এগুলোর সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। লতা সমাদ্দারকে অভিবাদন জানাতেই হয়, কেননা তিনি তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করেই থেমে যান নি, থানায় লিখিত অভিযোগ করেছেন। কর্তৃপক্ষ দোষী ব্যক্তির বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে এটাই কাম্য।’ গতকাল দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি অনলাইনে ‘টিপ পরছোস কেন’ বলেই বাজে গালি দেন পুলিশের পোশাক পরা ব্যক্তি-শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনে লতা সমাদ্দার বলেছেন- ‘আমি হেঁটে কলেজের দিকে যাচ্ছিলাম, হুট করে পাশ থেকে মধ্যবয়সী, লম্বা দাড়িওয়ালা একজন ‘টিপ পরছোস কেন’ বলেই বাজে গালি দিলেন। তাকিয়ে দেখলাম তাঁর গায়ে পুলিশের পোশাক। একটি মোটরবাইকের ওপর বসে আছেন। প্রথম থেকে শুরু করে তিনি যে গালি দিয়েছেন, তা মুখে আনা এমনকি স্বামীর সঙ্গে বলতে গেলেও লজ্জা লাগবে। ঘুরে ওই ব্যক্তির মোটরবাইকের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। তখনো তিনি গালি দিচ্ছেন। লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। একসময় আমার পায়ের পাতার ওপর দিয়েই বাইক চালিয়ে চলে যান।’ গতকাল সকাল ৮টা ২০ মিনিট থেকে সাড়ে ৮টার মধ্যে ফার্মগেট মোড় পার হয়ে তেজগাঁও কলেজের দিকে যাওয়ার সময় লতা সমাদ্দারের সঙ্গে এ ঘটনা ঘটে। সেজান পয়েন্টের সামনে বন্ধ করে রাখা মোটরবাইকের ওপর বসে কথাগুলো বলেন ওই পুলিশ সদস্য। লতা সমাদ্দার গতকাল বলেছিলেন, তিনি তাঁর কপালে টিপ পরবেন কি না, তা পুলিশ সদস্য বলার কে? লতা সমাদ্দারের মনে হয়েছিল, ঘটনাটার প্রতিবাদ হওয়া দরকার। আজ মুঠোফোনে লতা বলেন, ‘আমি আসলে একার জন্য ভাবি নাই। প্রতিবাদ করার সময় আমার মাথায় ছিল নারীরা যাতে সাবলীলভাবে চলাফেরা করতে পারেন। তাই প্রতিবাদটাকে আমার বলছি না, বলছি আমাদের প্রতিবাদ। নারীদের প্রায় বেশির ভাগই এ ধরনের হয়রানির শিকার হন। ফেসবুকে মানুষ বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদ করছেন। আমার পরিবার, সহকর্মী সবাই আমার পাশে আছেন, এটাই আমার জন্য অনেক বড় শক্তি।’ লতা সমাদ্দারের অভিযোগের বিষয়ে কত দূর অগ্রগতি হলো জানতে চাইলে শেরেবাংলা নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) উৎপল বড়ুয়া আজ বাঙলা কাগজ ও ডনকে বলেন, ‘লতা সমাদ্দার যে মোটরবাইকের নম্বর দিয়েছেন তা সঠিক না। আর ওই এলাকায় মেট্রোরেলের কাজের জন্য সিসিটিভি ক্যামেরাও এখন আর নেই। লতা সমাদ্দার এক ট্রাফিক সার্জেন্টের নাম উল্লেখ করে জানিয়েছিলেন, ঘটনার পর তিনি ওই সার্জেন্টের সঙ্গে কথা বলেছেন। আমরা ওই সার্জেন্টের সঙ্গে কথা বলেছি। সব দিক থেকে তদন্ত চলছে।’ গতকাল লতা সমাদ্দার মোটরবাইকের নম্বর প্রসঙ্গে বলেছিলেন, বাইকটি তাঁকে প্রায় চাপা দিয়ে যখন চলে যাচ্ছিল তখন তিনি পেছন থেকে দেখে যতটুকু নম্বর মনে রাখতে পেরেছিলেন তাই থানায় লিখিত অভিযোগে উল্লেখ করেছেন। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বাঙলা কাগজ ও ডনকে বলেন, ‘লতা সমাদ্দার যে অভিযোগটি করেছেন তা গুরুতর। যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন অর্থাৎ পুলিশের পোশাক পরা ব্যক্তি, তাও উদ্বেগজনক। এটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এ ঘটনার প্রতিবাদ তো করতেই হবে।’ টিপ নিয়ে ঘটনার প্রতিবাদে আজ নারীপক্ষের কর্মীরা প্রতিবাদ অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। এতে ব্যানারে লেখা ছিল-‘টিপ পরা আমার স্বাধীনতা’। এ ঘটনায় আজ রবিবার বিকেল চারটায় শাহবাগে প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ আগামীকাল সোমবার বেলা ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধনের আয়োজন করেছে। ফেসবুকে টিপ নিয়ে প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে নারীরা শুধু নিজেদের ছবি দিচ্ছেন তাই না, মা, মেয়ে, নাতনির সঙ্গেও ছবি দিচ্ছেন। ভাস্কর আইভি জামান নিজে ও নাতনি অধরার টিপ পরা ছবি দিয়ে লিখেছেন, ‘আমার সাজে হস্তক্ষেপ করার দায়িত্ব কাউকে দেই নাই।’ পাকিস্তান আমলে কপালে টিপ দেওয়া মায়ের ছবি পোস্ট করেছেন মোশরেফা মিলি। দেশের বাইরে পড়াশোনা করতে যাওয়া এই নারী লিখেছেন, ‘টিপ পরা ছবি দিয়ে প্রতিবাদী হওয়ার চেয়ে কেন জানি আতঙ্কিত হচ্ছি বেশি। কারণ আমরা একটু একটু করে জেনে গেছি দেশের অধিকাংশ মানুষই এখন এই পুলিশ অফিসারের মানসিকতা সম্পন্ন।’ টিপ পরাকে কেন্দ্র করে ঘটনায় অনেকের মধ্যে অজানা আশঙ্কারও জন্ম নিয়েছে। রাকিব হাসান নামের এক বাবা তাঁর ছোট্ট মেয়ে রূপকথার কথা উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘আমার রূপকথাকেও দেখলাম ছোট্ট করে টিপ দেয়। ওর ভবিষ্যৎ কী এ দেশে?’ আফরিন শাহনাজ তাঁর মেয়ের যখন ১০–১১ বছর সে সময়কার ঘটনা উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘মেয়ের বয়সী আরেক মেয়ে জানতে চেয়েছিল-তোমার আম্মু টিপ পরে কেন? এই মা আক্ষেপ করে লিখেছেন-এই হচ্ছে আমাদের পারিবারিক শিক্ষা। আমার কপাল, আমি টিপ পরব, কার কী?’ লাবণ্য লিপি নামে একজন নিজের কপালে লাল টিপ ও ছোট ছেলের কপালে কালো টিপ দেওয়া ছবি দিয়ে লিখেছেন, ‘চাঁদকে ডেকেছিলাম খোকার কপালে টিপ পরিয়ে দিতে। চাঁদ প্রথমে মায়ের কপালে এঁকে দিল লাল টিপ। তারপর খোকার কপালে দিল কাজলের টিপ। যেন পুলিশের নজর না লাগে।’ বাংলাদেশ যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সংরক্ষিত আসনের সাবেক এমপি অপু উকিল লিখেছেন, ‘টিপের সঙ্গে এই উপমহাদেশের অনেক প্রাচীন সম্পর্ক রয়েছে। আমি কপালে টিপ পরতে খুব ভালোবাসি। শুধু ভালোবাসাই নয়, আমি বিশ্বাস করি, টিপের সঙ্গে আমার সংস্কৃতি এবং আস্থা জড়িয়ে রয়েছে।’ অভিনেত্রী কাজী নওশাবা আহমেদ লিখেছেন, ‘আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা, মানুষের ঘুমন্ত বোধকে আলো দিয়ে যা, জাগিয়ে দিয়ে যা।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাদেকা হালিম টিপ নিয়ে যে ঘটনা ঘটেছে তার প্রতিবাদ জানিয়ে লিখেছেন লিখেছেন, ‘সব সময় টিপ পরি, ছোট টিপ, বড় টিপ, ডিজাইনার টিপ, ম্যাচিং টিপ। সারা জীবন পরব টিপ।’ টিপও পরতে দেবে না—এ কেমন বিচার? এ কেমন সংস্কৃতি? এভাবেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাংবাদিক সঞ্চিতা সিতু। ট্রান্সজেন্ডার নারী তাসনুভা আনান লিখেছেন, ‘কপাল আমার। টাকা আমার। টিপ ও আমার।’ উন্নয়নকর্মী অ্যাসিডদগ্ধ নুরুন নাহার বেগম লিখেছেন, ‘অবিলম্বে লতা সমাদ্দারের ওপর হামলাকারী পুলিশকে শাস্তির আওতায় দেখতে চাই।’ আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া লিখেছেন, ‘রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার সবকিছুকেই আক্রান্ত করবে এটাই স্বাভাবিক। মনস্তাত্ত্বিক এই পরিবর্তন পরিকল্পিত, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। পঞ্চাশ বছরে এ রকম অর্জন কম হয়নি আমাদের।’ তবে ফেসবুকে টিপ নিয়ে যে প্রতিবাদী আন্দোলন হচ্ছে তাকে অনেকে হাস্যকরও বলেছেন। নারী উদ্যোক্তা ও লেখক ফাতেমা আবেদীন নাজলা লতা সমাদ্দারের প্রতি সংহতি জানিয়ে লিখেছেন, লতা সমাদ্দারের প্রতি যে অন্যায় হয়েছে সে অন্যায়ের ফেসবুকীয় বিচার না আইনি সমাধান জরুরি, সেই চেষ্টাই সবাইকে করতে হবে। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে শাস্তির আওতায় আনার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে হবে। তবে কেউ কেউ আবার বলেছেন, হয়তো ফেসবুকের আন্দোলন তেমন কিছু হবে না, তবে কিছুই না করার চেয়ে ফেসবুকে আন্দোলন করাও ভালো।