থানচি থানার পর গভীর রাতে আলীকদমে কুকিচিনের হামলা
নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলার কাগজ : বান্দরবানের দুই উপজেলায় ১৭ ঘণ্টার মধ্যে দুটি ব্যাংকের তিনটি শাখায় হামলা, অস্ত্র লুট ও অপহরণের ঘটনার পর বৃহস্পতিবার (৪ এপ্রিল) রাতে থানচি থানা লক্ষ্য করে গুলি করেছে সশস্ত্র গোষ্ঠী কুকিচিন। পরে গভীর রাতে আলীকদম উপজেলায় পুলিশ ও সেনাদের একটি যৌথ তল্লাশি চৌকিতে হামলা চালিয়েছে সন্ত্রাসীরা। এ দুই ঘটনায় নিরাপত্তা বাহিনীর কেউ হতাহত হন নি।
স্থানীয় ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে আটটার দিকে সন্ত্রাসীরা থানচি থানা লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ শুরু করে। পুলিশ পাল্টা গুলি চালায়।
রাত ১০টার দিকে থানচি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জসীম উদ্দিন বলেন, রাত সাড়ে আটটা থেকে সাড়ে নয়টা পর্যন্ত গোলাগুলি হয়। এখন পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা জানতে পেরেছি, সন্ত্রাসীরা থানার আশপাশে রয়েছে। এজন্য আমরা সতর্ক অবস্থায় রয়েছি।’
কতটি গুলিবর্ষণ হয়েছে—এ প্রশ্নের জবাবে ওসি বলেন, এখনো গণনা করা হয় নি। তবে ৪০০ থেকে ৫০০টি হবে।
সর্বশেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী, রাত পৌনে একটার দিকে বান্দরবানের আলীকদম থানার ডিম পাহাড়ের ২৬ মাইল এলাকায় পুলিশ ও সেনাদের যৌথ তল্লাশিচৌকিতে হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা।
আলীকদম থানার ওসি তৌবিদুর রহমান রাতে বলেন, সন্ত্রাসীরা গাড়িতে করে এসে তল্লাশিচৌকি ভেঙে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। বাধা দিলে তারা গুলি চালায়। এ সময় তল্লাশিচৌকিতে থাকা পুলিশ সদস্যরা পাল্টা গুলিবর্ষণ করেন। পরে হামলাকারীরা সেখান থেকে পিছু হটে। এ ঘটনায় পুলিশের কেউ হতাহত হয় নি।
দুই বছর আগে পাহাড়ে আত্মপ্রকাশ করে সশস্ত্র সংগঠন কুকিচিন। সংগঠনটির সন্ত্রাসীরা রুমার ঘটনার ১৭ ঘণ্টার মাথায়, বুধবার বেলা একটার দিকে থানচি বাজারে গুলি ছুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। তারা সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংকের স্থানীয় শাখা থেকে টাকা লুট করে।
এদিকে রুমা থেকে অপহৃত সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপক নিজাম উদ্দিনকে প্রায় ৪৮ ঘণ্টা পর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় উদ্ধার করেছে র্যাব। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে গণমাধ্যমে র্যাবের পাঠানো এক খুদে বার্তায় বলা হয়, ‘র্যাবের মধ্যস্থতায় সোনালী ব্যাংকের বান্দরবানের রুমা শাখার ম্যানেজার নিজাম উদ্দিন উদ্ধার।’ তাঁকে রুমা বাজার এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয় বলে জানিয়েছেন র্যাব-১৫ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এইচ এম সাজ্জাদ হোসেন। এরপর নিজাম উদ্দিনকে বান্দরবান র্যাবের ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়।
এর আগে জানা যায়, ব্যাংকের ব্যবস্থাপকের জন্য মুক্তিপণ দাবি করেছে সন্ত্রাসীরা। বিকেলে ঢাকায় র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন সাংবাদিকদের বলেন, ব্যাংক ম্যানেজারকে ছাড়াতে কুকিচিন বেশ কিছু অর্থ মুক্তিপণ হিসেবে দাবি করেছে। তাঁকে অক্ষত ও নিরাপদে ফিরিয়ে আনার জন্য নানা কৌশলে কাজ করছে র্যাব।
পরপর দুইদিন সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হামলার ঘটনার পর বৃহস্পতিবার বান্দরবানের রুমা, থানচি ও রোয়াংছড়ি উপজেলায় সোনালী ব্যাংকসহ সব ব্যাংকের কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
এসব এলাকায় বৃহস্পতিবার দিনভর থমথমে পরিস্থিতি ছিলো। কুকিচিনের সঙ্গে সব ধরনের আলোচনা স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েছে স্থানীয়ভাবে গঠিত ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি’। লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার ও অপরাধীদের দমনে যৌথ অভিযান শুরুর কথা জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
এরই মধ্যে রাতে থানচিতে নতুন করে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। রাত ১০টায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, ‘থানাকে লক্ষ্য করে দূর থেকে গুলি করা হয়েছে। আমাদের পুলিশও গুলি করেছে।’
এদিকে কুকিচিনের সঙ্গে সব ধরনের আলোচনা স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েছে ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি’। বৃহস্পতিবার সকালে কমিটির সদস্যরা বান্দরবানে সংবাদ সম্মেলন করে এ ঘোষণা দেন। তাঁরা জানান, কুকিচিনের হাতে অপহৃত ব্যাংক কর্মকর্তাকে নিঃশর্ত মুক্তি, লুট করা টাকা ও অস্ত্র ফেরত দেওয়ার পাশাপাশি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার পরিবেশ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হলে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা হতে পারে।
জেলা পরিষদ সভাকক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য দেন শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির আহ্বায়ক ও পরিষদের চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লা মারমা। উপস্থিত ছিলেন কমিটির সদস্যসচিব লালজার লম বম, মুখপাত্র কাঞ্চনজয তঞ্চঙ্গ্যা প্রমুখ।
সংবাদ সম্মেলনে ব্যাংকের টাকা ও অস্ত্র লুট, ব্যাংক কর্মকর্তা অপহরণসহ কুকিচিনের বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানানো হয়।
জানা গেছে, কুকিচিনের সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে ২০২৩ সালে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লা মারমার নেতৃত্বে এই ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি’ করা হয়। কমিটির সঙ্গে কুকিচিনের এ পর্যন্ত কয়েক দফা অনলাইনে এবং দুই দফা সরাসরি বৈঠক হয়েছে। গত বছরের ৫ নভেম্বর ও গত ৫ মার্চ অনুষ্ঠিত সরাসরি দুই দফা বৈঠকে দুটি সমঝোতা স্মারক সই হয়। তাতে কুকিচিন চাঁদাবাজি, অপহরণ, লুটপাটসহ সব ধরনের সন্ত্রাসী তৎপরতা বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো বলেও সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।
তিন উপজেলায় ব্যাংক বন্ধ :
রুমা, থানচি ও রোয়াংছড়ি উপজেলায় সোনালী ব্যাংকসহ সব ব্যাংকের কার্যক্রম বৃহস্পতিবার অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এই তিন উপজেলায় সোনালী ও কৃষি ব্যাংক ছাড়া আর কোনও ব্যাংকের শাখাও নেই।
এই তিন উপজেলার লোকজন জেলা সদরে ব্যাংকের শাখায় সীমিত পরিসরে লেনদেন করতে পারবেন বলে জানিয়েছেন সোনালী ব্যাংকের অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) ওসমান গণি। তিনি বলেন, এটি একটি সাময়িক সমস্যা।
এর মধ্যে বান্দরবান সদর থেকে থানচি ৮১ কিলোমিটার, রুমা ৪৮ কিলোমিটার ও রোয়াংছড়ি ১৮ কিলোমিটার দূরত্বে। ফলে সদরে এসে লেনদেন করা কষ্টকর হবে বলে জানান স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও ব্যবসায়ীরা।
বৃহস্পতিবার বান্দরবান সদর থেকে থানচি উপজেলায় আসা-যাওয়ার সময় পর্যটকবাহী কোনও চলাচল করে নি।
বৃহস্পতিবার ছিলো রুমা সদরের সাপ্তাহিক হাট। লোকজন ছিলো খুব কম।
কুকিচিন ঘিরে যতো ঘটনা :
দুই বছর আগে ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের নতুন সশস্ত্র গোষ্ঠী কুকিচিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেদের নামে পেজ খুলে আত্মপ্রকাশের ঘোষণা দেয়। এরপর তারা রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার বড়থলি ইউনিয়ন, বান্দরবানের রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচিতে সশস্ত্র তৎপরতা শুরু করে।
দুই বছরে অন্তত দশটি বড় ধরনের সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটিয়েছে কুকিচিন। গত বছর কুকিচিনের সন্ত্রাসীদের চারটি হামলার ঘটনায় পাঁচ সেনাসদস্য নিহত হন। আরেক সশস্ত্র গোষ্ঠী ইউপিডিএফের (গণতান্ত্রিক) সঙ্গে সংঘর্ষে গত বছর রোয়াংছড়ি উপজেলার খামতাংপাড়া এলাকায় আটজন এবং রুমা উপজেলার মুয়ালপিপাড়া একজন নিহত হন। আর গত বছরের ৮ মে রোয়াংছড়ি উপজেলা পাইংখিয়ংপাড়া এলাকায় আওয়ামী লীগের একজন নেতাসহ বম জনগোষ্ঠীর তিনজন এবং ২০২৩ সালের ২২ মার্চ একই উপজেলার রামথারপাড়ায় থংচুল বম নামের এক কারবারিকে (পাড়াপ্রধান) গুলি করে হত্যা করা হয়। ২০২২ সালের ২১ জুন রাঙামাটির বিলাইছড়ির বড়থলি ইউনিয়নের সাইজাম পাড়ায় তিন ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।
কুকিচিনের আস্তানায় নতুন জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়ার সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। ২০২২ সালে সেই আস্তানায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালিয়ে বেশ কয়েকজন জঙ্গি ও কুকিচিনের সদস্যদের গ্রেপ্তার করে। তখন কুকিচিন ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে। এরপর লম্বা সময় ধরে পাহাড়ে কুকিচিন বিরোধী অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
তাদের বিভিন্ন আস্তানা ধ্বংস করে দেওয়া হয়। একই সঙ্গে ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি’ গঠন করার পর আলোচনাও শুরু হয়। কিন্তু এরই মধ্যে এই সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আবারও সংগঠিত হয়ে নতুন করে আক্রমণের প্রস্তুতি নিয়েছিলো।
বান্দরবানে সশস্ত্র হামলা ও ব্যাংকে লুটপাটের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ও কঠিন ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেই জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। তিনি বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ব্যাংকে ডাকাতি ছোট ঘটনা হিসেবে দেখা হচ্ছে না। কুকিচিনকে কঠোরভাবে দমনে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।