নিষেধাজ্ঞার পর ৩৫ লাখ গ্রাহক হারিয়েছে গ্রামীণফোন

নিষেধাজ্ঞার পর ৩৫ লাখ গ্রাহক হারিয়েছে গ্রামীণফোন

নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলার কাগজ ও ডন : মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটর গ্রামীণফোনের সিম বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা জারির পর ছয় মাস পেরিয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে অপারেটরটি প্রতিদিন গড়ে ৪০ হাজারের মতো সিম বিক্রি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

এ ছাড়া তারা ৩৫ লাখের মতো গ্রাহক হারিয়েছে।

সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিটিআরসি গত ২৯ জুন গ্রামীণফোনের সিম বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। সংস্থাটির হিসাবে, গত অক্টোবর মাস শেষে গ্রামীণফোনের সক্রিয় সিম সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮ কোটি ১৪ লাখের কিছু বেশি, যা গত মে মাসের তুলনায় প্রায় ৩৫ লাখ কম। নতুন সিম বিক্রি করতে না পারলে অপারেটরগুলোর গ্রাহক কমে। কারণ সাধারণত সক্রিয় কিছু সিম নিয়মিত নিষ্ক্রিয় হয়।

এদিকে গ্রামীণফোন বলছে, সেবার মান বাড়াতে যা যা করণীয়, তার সবই তারা করছে। তরঙ্গ কিনে তার একাংশ নেটওয়ার্কে স্থাপন করেছে। বাকিটা স্থাপনে কাজ করছে। নতুন নতুন টাওয়ার বসানো হচ্ছে। টাওয়ারগুলো অপটিক্যাল ফাইবার কেব্‌ল দিয়ে সংযুক্ত করছে তারা। অপারেটরটির দাবি, এসব পদক্ষেপের ফলে তাদের সেবার মান বেড়েছে। আসলেই মান বেড়েছে কি না, তা পরীক্ষা করা ও সিম বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার জন্য বিটিআরসিকে চিঠিও দেওয়া হয়েছে।

ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার রোববার (পহেলা জানুয়ারি) বলেন, ‘আমার কাছে আজ (রোববার) বিটিআরসির কাছ থেকে রিপোর্ট এসেছে। আমি দেখেছি, গত ছয় মাসে গ্রামীণফোন অবকাঠামোগত যে উন্নতি করেছে, সেটা উল্লেখযোগ্য।’ তিনি বলেন, ‘গ্রাহকসেবার মান বাড়াতে আমরা তাদের সিম বিক্রি বন্ধ করেছিলাম, যাতে আরও গ্রাহক তৈরি করে ভোগান্তি না বাড়ে। আমাদের দেখার বিষয় ছিল, তারা কী কী অবকাঠামোগত উন্নয়ন করছে। আজকে যেটা দেখেছি, সেটা মোটামুটি সন্তোষজনক।’

সিম বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণ হিসেবে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিন নেটওয়ার্কের সমস্যার কথা জানানো হয়েছিল। সেদিন কী হয়েছিল, তার একটি ব্যাখ্যা পাওয়া যায় বিটিআরসিকে গত ৩ জুলাই দেওয়া গ্রামীণফোনের একটি চিঠিতে। এতে বলা হয়, উদ্বোধনের আগে পদ্মা সেতুতে নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করতে চেয়েছিল অপারেটরটি। তবে তাদের আবেদন বিবেচনাধীন ছিল। এ অবস্থায় তারা সেতু এলাকায় থাকা টাওয়ার নামে পরিচিত বেজ ট্রান্সসিভার স্টেশনগুলোতে (বিটিএস) সক্ষমতা যতটুকু সম্ভব, ততটা বাড়ায়। এর সঙ্গে তিনটি অস্থায়ী টাওয়ার স্থাপন ও তাতে শক্তিশালী সরঞ্জাম বসানো হয়, যাতে সেতুকে নেটওয়ার্কের আওতায় রাখা যায়।

গ্রামীণফোন বলছে, পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য ছয় কিলোমিটারের বেশি। দুই পাশে যে ব্যবস্থাই নেওয়া হোক, শুধু টাওয়ারের সক্ষমতা বাড়িয়ে পুরো সেতুতে নিরবচ্ছিন্ন নেটওয়ার্ক নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। সেতুতে আরও সরঞ্জাম বসানো দরকার ছিল। তবে সে অনুমোদন পাওয়া যায় নি।

যদিও গত ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধনের চার দিন পর গ্রামীণফোনের সিম বিক্রি বন্ধ করে দেওয়া হয়। নিষেধাজ্ঞার পর গত সেপ্টেম্বরে বিটিআরসি গ্রামীণফোনকে বন্ধ থাকা কিছু পুরোনো সিম বিক্রির অনুমোদন দেয়। এ কারণে বিটিআরসিকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছিল টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়। এরপর গত ৬ নভেম্বর গ্রামীণফোনের পুরোনো সিম বিক্রির সুযোগও প্রত্যাহার করা হয়।

সেবার মান বাড়াতে কী পদক্ষেপ :
গ্রামীণফোনের দাবি, সেবার মান উন্নত করতে তারা আগে থেকে কাজ করছিল। সিম বিক্রি বন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে তারা মানোন্নয়নে কী কী করবে, তার প্রতিশ্রুতি দেয়। সেগুলো হলো:

১. তরঙ্গ বাড়ানো : গ্রামীণফোন জানিয়েছে, ২০২১ ও ২০২২ সালে তারা নিলামে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকার তরঙ্গ কিনেছে। এর মধ্যে ২০২১ সালে কেনা তরঙ্গ পুরোপুরি নেটওয়ার্কে স্থাপন করা হয়েছে। ১ নভেম্বর থেকে গত মার্চে নেওয়া নতুন তরঙ্গ স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে।

২. টাওয়ার বসানো : ২০২২ সালে গ্রামীণফোন ১ হাজার ৯০০টি নতুন টাওয়ার বসানোর লক্ষ্য নিয়েছিল। গত অক্টোবর পর্যন্ত হিসাবে, বসানো হয়েছে ১ হাজার ৬০৪টি। ২০২১ সালে ১ হাজার ৬০০টি টাওয়ার বসিয়েছিল তারা।

৩. নিজেদের মোট ৩৪ শতাংশ টাওয়ার এক বছরের মধ্যে ফাইবার অপটিক কেব্‌ল দিয়ে সংযুক্ত করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল গ্রামীণফোন, যার ২৮ শতাংশ শেষ হয়েছে গত নভেম্বরে।

৪. অপারেটরগুলোর মধ্যে টাওয়ার ভাগাভাগির বিষয়টিও সুরাহা হয়েছে।

গ্রামীণফোনের কর্মকর্তারা দাবি করছেন, এসব পদক্ষেপ নেওয়ায় তাঁদের সেবার মান উন্নত হয়েছে। ফোর-জি ইন্টারনেটের গতি যেখানে প্রতি সেকেন্ডে ৭ মেগাবিটের (এমবিপিএস) কম ছিল, সম্প্রতি নিজস্ব পরীক্ষায় সেটা ১৭ এমবিপিএস পাওয়া গেছে।

সেবার মান নিয়ে ২০২১ সালে পরীক্ষা চালিয়েছিল বিটিআরসি। তাদের মানদণ্ড অনুযায়ী, গ্রামীণফোনের কলড্রপের হার নির্ধারিত সীমার অনেক নিচে এবং অন্য অপারেটরদের চেয়ে ভালো অবস্থানে ছিল। গ্রামীণফোন বলছে, কলড্রপের নিম্ন হারের দিক দিয়ে তারা দক্ষিণ এশিয়ার ১৭টি অপারেটরের মধ্যে ৩ নম্বর।

গ্রাহকসংখ্যা ও রাজস্ব আয়ে গ্রামীণফোন দেশের শীর্ষ মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটর। প্রতিষ্ঠানটি দেশের শীর্ষস্থানীয় করদাতা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) গত ২৮ ডিসেম্বর গ্রামীণফোনকে ২০২১-২২ অর্থবছরে টেলিযোগাযোগ খাতের সর্বোচ্চ করদাতা হিসেবে সম্মাননা দেয়। এ নিয়ে টানা সাতবার তারা এই সম্মাননা পেলো।

গ্রামীণফোনের দেওয়া হিসাব বলছে, প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তারা ১ লাখ ৩ হাজার ৪৯৭ কোটি টাকা সরকারের কোষাগারে দিয়েছে কর ও বিভিন্ন ফি বাবদ। ২০২১ সালে দিয়েছে ১০ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। দেশের সবচেয়ে বড় বিদেশি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোরও একটি গ্রামীণফোন। তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ ৪৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকার বেশি। তরুণদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা ও দক্ষতা বৃদ্ধি, সবার জন্য নিরাপদ ইন্টারনেট গড়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করে গ্রামীণফোন। পাশাপাশি ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা দেয়। গ্রামীণফোন ডিজিটাল বাংলাদেশ পুরস্কার পাওয়া প্রতিষ্ঠান (২০২১)।

জানতে চাইলে গ্রামীণফোন কর্তৃপক্ষ এক লিখিত বিবৃতিতে বলেছে, সিম বিক্রি নিষিদ্ধ হওয়ার বিষয়টি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে তাদের জন্য অত্যন্ত পীড়াদায়ক। দেশব্যাপী হাজারো গ্রাহক প্রতিদিন গ্রামীণফোনের সিম না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন। তাঁরা দাবি করছেন, নিষেধাজ্ঞা দ্রুত প্রত্যাহার করা হবে।