বাবুর পুকুর গণহত্যা : ভেঙে পড়ছে স্মৃতিস্তম্ভ

বাবুর পুকুর গণহত্যা : ভেঙে পড়ছে স্মৃতিস্তম্ভ

নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলার কাগজ : মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫৩ বছর পেরিয়ে গেলেও বগুড়ার বাবুর পুকুর বধ্যভূমিতে শায়িত ১৪ শহিদের ১২ জনের পরিবার কোনও স্বীকৃতি পায় নি। অথচ ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাক্ষরিত চিঠিতে তাঁদের আত্মদানকে ‘বীর’ হিসেবে আখ্যায়িত করে প্রত্যেকের পরিবারকে দুই হাজার টাকা করে দেন।

বগুড়া শহর থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে শাজাহানপুর উপজেলার বগুড়া নাটোর মহাসড়ক লাগোয়া বাবুর পুকুর বধ্যভূমিটি অবস্থিত।

সরজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বধ্যভূমির ফটক বন্ধ থাকলেও পকেট গেইটটি খোলা। সেখানে গরু, ছাগল ও কুকুরের অবাধ বিচরণ।

বধ্যভূমির প্রাচীর এখন ব্যবহার হচ্ছে স্থানীয়দের কাপড় শুকানোর কাজে। পাশেই বিশাল পুকুর। বধ্যভূমি থেকে একটি সিঁড়িও নেমে গেছে পুকুরে।

পুকুর পাড়ে একটি ছোট্ট খুপরি ঘর। আগে সেখানে কোনও ঘরবাড়ি না থাকলেও এখন তিনটি বাড়ি এবং একটি হিমাগার তৈরি হয়েছে। এলাকাটি নির্জন। সব সময় সুনশান নিরবতা বিরাজ করে। রাতে শুধু সেই খুপরি ঘরটি আলোকিত থাকে। কিন্তু আলো নেই বধ্যভূমিতে। বধ্যভূমির দেওয়ালের কিছু অংশ ভেঙে পড়েছে।

ভেঙে পড়েছে কবরের সানবাঁধা মেঝেও। সেখানে গিয়েও দেখা মেলে নি বধ্যভূমির দেখভালের কোনও লোকজনের। বগুড়া জেলা পরিষদ নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ এবং বধ্যভূমিতে শায়িতদের একটি তালিকা ঝুলানো রয়েছে।

সেখানে ১৩ জনের নাম উল্লেখ এবং একজন অজ্ঞাত লেখা রয়েছে। তাঁরা হলেন : ন্যাপকর্মী ওয়াজেদুর রহমান টুকু, ছাত্র ইউনিয়ন বগুড়া জেলা শাখার তৎকালীন সভাপতি মাহফুজুর রহমান ওরফে মান্নান, তাঁর ছোট ভাই ছাত্র ইউনিয়ন নেতা আব্দুল হান্নান, ছাত্রলীগ নেতা মোফাজ্জল হোসেন আবুল, সাইফুল ইসলাম, আব্দুস সবুর, ফজলুর রহমান, আলতাফ হোসন, বাদশা শেখ, শহীদ নুরজাহান লক্ষ্মী, বাচ্চু শেখ, আব্দুল কুদ্দুস মন্টু, তাঁর ভাই জালাল উদ্দিন।

১৯৭২ সালের ১২ অগাস্ট তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শহিদ প্রত্যেক পরিবারের স্বজনদের দুই হাজার টাকার চেক প্রদান করেন।

সেই চিঠিতে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, আমি গভীর দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, আমার আন্তরিক সমবেদনা। আপনার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতিও রইল আমার প্রাণঢালা সহানুভূতি। এমন নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক পিতা, পুত্র, স্বামী, মা, স্ত্রী হওয়ার গৌরব লাভ করে সত্যি আপনি ধন্য হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে আপনার পরিবারের সাহার্যার্থে ২ হাজার টাকার চেক প্রেরিত হলো চেক নম্বর- মিত্র ০০২৯৯৮। আমার প্রাণভরা ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা নিন।

বাবুর পুকুর গণহত্যা :
একাত্তরের নভেম্বর মাসের প্রথমদিকে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে তুমুল লড়াই শুরু হলে ঠনঠনিয়া এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা এলাকার রাজাকারদের নির্মূলের পরিকল্পনা করেন।

মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত হওয়ার খবর এলাকার শান্তি কমিটির লোকজনের কাছে পৌঁছে যায়। নিজেদের রক্ষায় তারা মুক্তিযোদ্ধা এবং তাঁদের সহায়তাকারীদের নির্মূলের পাল্টা ছক কষে। তারই ধারাবাহিকতায় ১১ নভেম্বর গভীর রাতে রমজান মাসের সেহেরির খাওয়ার মুহূর্তে তাদের দেখিয়ে দেখা পথ অনুসরণ করে কয়েকশ পাকিস্তানি সেনা চারদিক থেকে ঠনঠনিয়ার শহীদ নগর, পশারীপাড়া, শাহ্পাড়া ও তেতুলতলা এলাকা ঘিরে ফেলে। ততক্ষণে সেহরি খাওয়া শেষ। অনেকেই ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ঠিক সেই সময় পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা ওই এলাকার টেলিফোন অপারেটর নূরজাহানসহ একে একে আরও ২০ জনকে বাড়ি থেকে হাত ও চোখ বেঁধে তুলে নিয়ে যায়।

তাঁদেরকে জিপ ও ট্রাকে তুলে বাবুর পুকুরের সড়কে নিয়ে লাইনে দাঁড় করায়। এরপর দুই কিশোর ও পাঁচ বৃদ্ধকে ছেড়ে দিয়ে বাকি ১৪ জনকে পুকুরের পাড়ে নিয়ে একে একে গুলি করে হত্যা করে। শহিদ ১৪ জনের মধ্যে ১৩ জনের নাম জানা গেছে।

বাবুর পুকুর গণহত্যায় শহীদ হন মোফাজ্জল হোসেন আবুল। তাঁর ছোট ভাই আশরাফ আলী সেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী।

তিনি বলছিলেন, আমার ভাই ও আমাকে হাত-চোখ বেঁধে জিপ গাড়িতে উঠানো হয়। তারপর নিয়ে যাওয়া হয় বাবুর পুকুর এলাকায়। সেখানে গিয়ে শিশু ও বৃদ্ধদের পৃথক করা হয়, তারপর ওই ১৪ জনকে লাইনে দাঁড় করে গুলি করে হত্যা করা হয়।

আশরাফ আলী বলেন, গুলি করার আগে আমার চোখে বাঁধা কাপড়টি খুলে গিয়েছিলো। আমি সেই করুণ দৃশ্য দেখেছি।

নিজে কীভাবে বেঁচে ফিরলেন জানতে চাইলে আশরাফ আলী বলেন, পাকিস্তানি সেনারা অনেককেই ধরে নিয়ে এসেছিলো, যাঁদের মধ্যে শিশু ও কিশোর আর বৃদ্ধও ছিলো। যুবকদের এক সারিতে দাঁড় করায় আর শিশু ও বৃদ্ধদের আরেক পাশে।

তিনি বলেন, আমার যেহেতু বয়স কম ছিলো, সে কারণে আমাকে বৃদ্ধদের সঙ্গে রাখে। কিন্তু আমাদেরও চোখ বাঁধা ছিলো। ১৪ জনকে ব্রাশফায়ার করার পর আমাদেরকে ছেড়ে দেয়। আমরা তখন বাড়ি ফিরে আসি। ভাইকে তো গুলি করে মেরেই ফেলছে।

আশরাফ আলী বলেন, শহিদ পরিবারের আমরা মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রীর কাছেও গিয়েছি, কিন্তু এখনও কোনও ফল হয় নি। ওই ১৪ শহিদের মধ্যে শুধু সাইফুল ইসলামকে গেজেটভুক্ত করা হয়েছে। আর কাউকেই গেজেটভুক্ত, স্বীকৃতি প্রদান এবং ভাতাও দেওয়া হয় নি।

২৬ মার্চ এবং ১৬ ডিসেম্বর এলে শহিদ পরিবারের লোকদের নিয়ে কম্বল কিংবা কাপড় দেওয়া হয়। দেশের জন্য জীবন দিলো তাঁরা, কিন্তু তাঁদের আজও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলো না বলেই জানান তিনি।

বাবুর পুকুরের শহিদ ওয়াজেদুর রহমান টুকুর ৭৫ বছর বয়সি স্ত্রী লাইলী বেওয়া বলেন, ‘লেইখ্যা কি হবি। কতদিন হয়া গেলো। একসঙ্গে সাইফুল ভায়েকসহ ১৪ জনেক গুলি কইরা মারলো। সাইফুল ভায়ের পরিবার ভাতা পায়, স্বীকৃতি পায়। আর আমরা পাই না। এখন মরাই যামু, শেখ হাসিনা যদি নিজে দ্যাখে তাই হবি। মন্ত্রী-এমপিরা খালি আশ্বাস দেয়।

৮০ বছর বয়সী রাজেকা বেওয়া শহিদ ফজলুর রহমানের স্ত্রী। তিনি বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান চিঠি দিয়া টাকা পাঠালো একবার। ধইরা নিছিলাম ওডাই স্বীকৃতি। দেখলাম তারপর কতজন ক্ষমতা আইলো, গেলো, আছে কিছুই হলো না। মধ্যে মধ্যে বাবুর পুকুর নিয়া যায় প্রশাসন। কম্বল, কাপড় দিয়া ভালো ভালো কথা কয়। তারপর আর কিছুই হয় না। শ্যাষ বয়সে ভাক্কা করার জন্যে আর বাবুর পুকুরে যেতে চাই না।

১৫ বছর আগে বধ্যভূমির পাশে বাড়ি করেন ছামছুল হক। তিনি বলেন, বধ্যভূমির দেখাশোনার জন্য মাসে তিন হাজার টাকা দিতো। এখন সেটি বন্ধ করে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে একজন গ্রাম পুলিশকে। আগে প্রতিদিন বধ্যভূমি পরিষ্কার করতাম। দেখভাল করতাম। এখন দায়িত্ব না থাকায় আর করি না। এখন গ্রাম পুলিশ অনুষ্ঠানের আগে এসে পরিষ্কার করে।

সেখানকার আরেকজন বাসিন্দা হাসনা বানু জানান, যেদিন ওই ১৪ জনকে হত্যা করা হয়েছে, সেদিন তাঁদের আত্মীয়-স্বজনরা এসে কবর জিয়ারত করেন। সরকার থেকে একবার কিংবা দুবার অনুষ্ঠান করলেও এরপর কাউকে দেখা যায় না। গ্রাম পুলিশকে দায়িত্ব দেওয়া হলেও তাঁকে দেখা যায় না। শুধু অনুষ্ঠানের আগে পরিষ্কার করে চলে যায়।

বগুড়া জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান সৈয়দ সার্জিল টিপু বলেন, জেলা পরিষদ থেকে বধ্যভূমির স্মৃতিস্তম্ভ করা হলেও এখন দেখভাল করে শাহজাহানপুর উপজেলার খরনা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। তবে স্মৃতিস্তম্ভের যতোটুকু নষ্ট হয়েছে, তা সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নেওয়া হবে দ্রুত।

খরনা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাজেদুর রহমান শাহীন বলেন, সরকারি পর্যায়ে দেখভাল করার কোনও লোক নিয়োগ নেই। পরিষদ থেকে নিজে টাকা দিয়ে দেখাশুনা করি। মাঝে মাঝে চৌকিদার দিয়েও খোঁজ নিই।

বগুড়া জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক সভাপতি রুহুল আমিন বাবলু বলেন, কতজন কতভাবে স্বীকৃতি নিলো। কিন্তু বাবুর পুকুরের ঘটনা আলোচিত। সরকারিভাবে সৌধ নির্মাণ হয়েছে। অনুষ্ঠান হয় সেখানে। অথচ তারা কেনো স্বীকৃতি পেলো না এটা আমারও প্রশ্ন।