বিসর্জনের সময় অনেককে বাঁচিয়ে ভারতে নায়ক মোহাম্মদ মানিক
নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলার কাগজ ও ডন : রাতারাতি নায়কে পরিণত হয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ির গ্রিল কারখানার দরিদ্র শ্রমিক মোহাম্মদ মানিক। ভারতের অসংখ্য টেলিভিশন চ্যানেল ও সংবাদপত্রে মানিকের ছবি ও সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে গত কয়েক ঘণ্টায়। একটি সর্বভারতীয় চ্যানেলকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার ফাঁকে, ২৮ বছরের মোহাম্মদ মানিক জলপাইগুড়ি থেকে টেলিফোনে বাঙলার কাগজ ও ডনকে বলেন, ‘ভাবি নি, আমার জীবনে কখনো এই রকম দিন আসবে, যখন সব মিডিয়া সারাক্ষণ আমাকে দেখাবে।’ সামাজিক মাধ্যমেও ৪৮ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে চর্চা হচ্ছে উত্তর বাংলার মানিককে নিয়ে।
এর কারণ, গত বুধবার (৫ অক্টোবর) রাতে উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার মাল নদে দুর্গাপ্রতিমা বিসর্জনের সময় হঠাৎ আসা পাহাড়ি জলপ্রবাহে ভেসে যান ৫০ থেকে ৬০ জন। তাঁদের মধ্যে আটজনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে স্থানীয় প্রশাসন। কিন্তু যে ৪০ বা তার বেশি বিসর্জনকারী বেঁচে গিয়েছেন, তাঁদের অন্তত ৮ জনকে সাঁতরে এবং টেনে পাড়ে তুলেছেন সাড়ে তিন বছরের শিশুর পিতা মোহাম্মদ মানিক।
জলপাইগুড়ির মালবাজারের কাছে মাল নদে যখন বিসর্জনকারীদের একাংশ ভেসে যাচ্ছিলো, তখন পাড়ে দাঁড়িয়ে অন্য অনেকের মতোই ছবি তুলছিলেন মানিক। কিন্তু যখন তাঁদের কেউ কেউ ভেসে যেতে শুরু করলেন, তখন আর মাথা ঠিক রাখতে পারেন নি তিনি।
মানিক বলেন, ‘“আল্লাহু আকবর” বলে জলে ঝাঁপ দিয়ে দিলাম। কারোর পা, কারোর হাত, এমনকি মাথা ধরেও টেনে তুললাম। একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। কী হচ্ছিল বুঝতে পারছিলাম না, মাথা কাজ করছিল না। শুধু মনে হচ্ছিল, এক অবিশ্বাস্য শক্তি আমার দেহে ভর করেছে।’ মানিক যাঁদের উদ্ধার করেন, তাঁদের মধ্যে দুটি শিশু ও একজন তরুণীও ছিলেন।
বর্তমানে মোট ছয় সদস্যের পরিবারের প্রধান উপার্জনকারী মানিক জানালেন, ভেসে যাওয়া মানুষের চিৎকার শুনে তাঁর পরিবারের কথা মাথায় আসে নি। মাথায় আসেনি তাঁর সাড়ে তিন বছরের সন্তানের কথাও।
মানিক বলছিলেন, ‘পাশে আমার এক বন্ধু ছিল, তাঁর হাতে মুঠোফোনটা দিয়ে ঝাঁপ দিলাম। পানিতে নেমে অবশ্য বুঝতে পারলাম, উল্টো দিক থেকে প্রবল জোরে আমার দিকে ভেসে আসছে কিছু পাথর ও বোল্ডার। আঘাত লাগল, কিন্তু এত উত্তেজিত ছিলাম, ব্যথা অনুভব করিনি।’
মানিকের ডান পায়ে চোট লেগেছে বলেও জানালেন। পরিবারের লোক অবশ্য তাঁর এই কাজে খুশি। সবাই তাঁকে দেখতে আসছেন, বাবা-মা-ভাই বলছেন, তিনি ঠিক কাজই করেছেন।
হাসতে হাসতেই বলেন মানিক, ‘শুধু আমার স্ত্রী একটু চুপচাপ রয়েছেন। এখনো ভালো করে কথা বলা হয় নি। বোধ হয় কিছুটা আতঙ্কের মধ্যেই রয়েছেন, অনেকের মতোই হয়তো ওর চিন্তা যে আমি যদি ভেসে যেতাম, তাহলে পরিবারের কী হতো।’
এই মুহূর্তে যখন ভারতে মুসলমান সম্প্রদায়ের ওপরে নিয়মিত নানা ধরনের চাপ আসছে এবং তা আন্তর্জাতিক পরিসরেও একটা আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে, তখন সেই সম্প্রদায়ের মানুষ হিসেবে তিনি বিষয়টাকে কীভাবে দেখছেন, এই প্রশ্ন এড়িয়ে গেলেন। বোঝা গেল, তিনি প্রচারমাধ্যমকে এড়িয়ে যেতে শিখে গেছেন ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই। নির্দিষ্টভাবে এটাও জানালেন না যে যাঁদের তিনি উদ্ধার করলেন, তাঁরা বা তাঁদের পরিবারের সদস্যরা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন কি না।
মানিক বললেন, ‘হয়তো ওনারা কিছুটা আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। পরে হয়তো আসবেন।’
এখন পর্যন্ত কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের তরফে মোহাম্মদ মানিকের সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করেনি। সংবর্ধনা দেওয়ার কথা অনেকেই ঘোষণা করেছেন হয়তো, কিন্তু এই দরিদ্র শ্রমিকের হাতে কিছু তুলে দেওয়ার কথা কেউ ভাবেননি। অথবা ভাবলেও এখন পর্যন্ত তা মানিক জানেন না। মানিকের সংক্ষিপ্ত উত্তর, ‘আমি এখন ওসব নিয়ে ভাবছি না।’ বরং আরও বেশি লোককে কেন বাঁচাতে পারলেন না, সেটা নিয়েই নিজের ওপরে অসন্তুষ্ট এই শ্রমিক।
জলপাইগুড়িতে বৃষ্টির কারণে পাহাড়ি ঢলের পানি নদে নেমে আসে। এই প্রবাহ আটকানোর জন্য যে মাটির বাঁধ দেওয়া হয় এবং বিসর্জনের আগেও যা দেওয়া হয়েছিল, তা কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ভেসে চলে যায়। শান্ত নদ কয়েক সেকেন্ডেই উত্তাল হয়ে ওঠে। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন রাজ্যজুড়ে বিসর্জনকে একটা বিশাল উৎসবে পরিণত করা হয়েছে, যখন হাজার হাজার মানুষ কোনো এক জায়গায় জড়ো হচ্ছেন উৎসবে অংশ নিতে। এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই একটা ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে, যা সামাল দেওয়ার মতো পরিকাঠামো সরকারের হাতে এখনো নেই। এমনটাই হচ্ছে কলকাতা ও রাজ্যজুড়ে, জলপাইগুড়িও তার বাইরে নয়। রাজনৈতিক বিরোধীদের একাংশের বক্তব্য, এর জন্য প্রধানত দায়ী মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কারণ, তিনি সাধারণ বিসর্জনকে একটা বিরাট উৎসবে পরিণত করেছেন।
প্রশাসনিক তরফে জানানো হয়েছে, এই অভিযোগের একেবারেই কোনো ভিত্তি নেই। আকস্মিক বন্যার সময় যে তৎপরতা জলপাইগুড়িতে স্থানীয় প্রশাসন দেখিয়েছে, তা অভাবনীয় বলে সরকার জানিয়েছে। সরকারের সাফল্য ও দুর্গাপূজাকে একটা আন্তর্জাতিক উৎসবে পরিণত করার সাফল্যকে কলুষিত করতেই, বিরোধীদের এই কুৎসা বলে মনে করছে তৃণমূল কংগ্রেস। যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের পরিবারের জন্য সরকার ২ লাখ ও আহত ব্যক্তিদের জন্য ৫০ হাজার ভারতীয় টাকা ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেছে।