এক ভাষণেই একটি স্বাধীন দেশ

এক ভাষণেই একটি স্বাধীন দেশ

তোফায়েল আহমেদ :: ৭ই মার্চ বাঙালি জাতির জীবনে শ্রেষ্ঠ দিন। প্রতি বছর ৭ই মার্চ যখন ফিরে আসে, আমাদের হৃদয় অনেক কথা ভেসে ওঠে। এই দিনটির জন্যই বঙ্গবন্ধু জীবনভর সংগ্রাম করেছেন। দীর্ঘ ১৩টি বছর কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কাটিয়েছেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনি উপলব্ধি করেছেন, ‘এই পাকিস্তান বাঙালিদের জন্য হয় নাই। একদিন বাংলার ভাগ্যনিয়ন্তা বাঙালিদের হতে হবে।’ সেই লক্ষ্যে পৌঁছার জন্যই এত আন্দোলন, এত সংগ্রাম। যার একটি চূড়ান্ত পর্যায় ১৯৭১-এর ৭ই মার্চ। ভাবতে কত ভালো লাগে, ২০১৮-এর ৩০ অক্টোবর ইউনাইটেড নেশন এডুকেশন, সায়েন্টিফিক অ্যান্ড কালচারাল অর্গানাইজেশন (ইউনেসকো) ’৭১-এর ৭ই মার্চে প্রদত্ত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যের (ওয়ার্ল্ড ডকুমেন্টারি হেরিটেজ) অংশ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছে, যা সমগ্র জাতির জন্য গৌরবের এবং আনন্দের।

’৭১-এর পহেলা মার্চ ইয়াহিয়া খান যখন তেসরা মার্চের অধিবেশন একতরফাভাবে অনির্দিষ্ট কালের জন্য মুলতুবি করলেন, সেদিন ঢাকার রাজপথে মানুষ নেমে এসেছিল। হোটেল পূর্বাণীতে আমাদের পার্লামেন্টারি পার্টির বৈঠক চলছিল। জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত সদস্য হিসেবে আমিও সেই বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে উপস্থিত ছিলাম। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ এবং প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের সমন্বয়ে এই পার্লামেন্টারি পার্টির বৈঠক চলছিল। ঠিক ঐ সময়েই আকস্মিকভাবে ইয়াহিয়া খানের বিশ্বাসঘাতকতাপূর্ণ ঘোষণায় হাজার হাজার মানুষ রাজপথে নেমে এসে হোটেল পূর্বাণীর চারপাশে জমায়েত হয়। পার্লামেন্টারি পার্টির বৈঠক থেকে বেরিয়ে জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু ইংরেজিতে বলেছিলেন, ‘দিস টাইম নাথিং উইল গো আন-চ্যালেঞ্জড।’ অর্থাৎ আমি কোনো কিছুই বিনা প্রতিবাদে যেতে দিব না। তখন দেশি-বিদেশি সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিল, ‘আপনি কি স্বাধীনতার কথা বলছেন?’ তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘নট ইয়েট’, অর্থাৎ এখনই নয়। 

বঙ্গবন্ধু আমাদেরকে পল্টন ময়দানে পাঠালেন। বিশেষ করে আমার নাম ধরে বললেন, ‘তোফায়েল যাবে, সেখানে আমার পক্ষ থেকে কথা বলবে।’ ইতিমধ্যে প্রিয় নেতার বক্তৃতা শুনতে পল্টন ময়দানে লক্ষ লক্ষ মানুষ সমবেত হয়েছে। পল্টনে গিয়ে আমরা বক্তৃতা করেছি। পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে দিয়ে আমাদের আজকের এই স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়েছি এবং স্লোগান তুলেছি, ‘জাগো জাগো—বাঙালি জাগো’, ‘তোমার আমার ঠিকানা—পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো—বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘পাঞ্জাব না বাংলা—বাংলা বাংলা’, ‘পিন্ডি না ঢাকা—ঢাকা ঢাকা’, ‘আমার নেতা তোমার নেতা—শেখ মুজিব শেখ মুজিব’। 

সারা বাংলাদেশের মানুষ তখন রাজপথে। বঙ্গবন্ধু সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন। বঙ্গবন্ধু-ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী মার্চের ২ ও ৩ তারিখ দুপুর ২টা পর্যন্ত স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালিত হয়। ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধু ছাত্রনেতৃবৃন্দকে ডেকে ‘স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠনের নির্দেশ দেন। নেতার নির্দেশে ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ-সর্বজনাব নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আ স ম আব্দুর রব, আব্দুল কুদ্দুস মাখন-ছাত্রলীগ ও ডাকসুর সমন্বয়ে ‘স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করেন। মার্চের ৩ তারিখ পল্টন ময়দানে ‘স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’-এর জনসভায় ‘স্বাধীন বাংলার ইশতেহার’ পাঠ করা হয়। ইশতেহারে বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ‘সর্বাধিনায়ক’, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটিকে জাতীয় সংগীত ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলার মানচিত্রখচিত জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়।

তারপর এলো ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ। ৭ই মার্চের সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি। ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগের নেতা গাজী গোলাম মোস্তফা, মনি ভাই, সিরাজ ভাই, রাজ্জাক ভাই, আমি এবং স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ আমরা এই সভা সংগঠিত করার জন্য সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করি। ৭ই মার্চ সকাল থেকেই রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনস্রোত আসতে থাকে। তখন মানুষের মুখে মুখে ‘স্বাধীনতা’। একটি ঘটনা আমার মনে পড়ে। ৭ই মার্চ দুপুর ১টা। আমি এবং আমারই আরেক প্রিয় নেতা-নামোল্লেখ করলাম না-আমরা দুজন বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু আমাদের দুজনের কাঁধে হাত রেখে কথা বলছিলেন। আমাদের সেই নেতা যখন বঙ্গবন্ধুকে বললেন, তিনি তাকে ‘লিডার’ বলে সম্বোধন করতেন—‘লিডার, আজকে কিন্তু পরিপূর্ণ স্বাধীনতার ঘোষণা ছাড়া মানুষ মানবে না।’ আমাদের কাঁধে রাখা হাত নামিয়ে তার নামোচ্চারণ করে বঙ্গবন্ধু ইংরেজিতে বললেন, ‘আই অ্যাম দি লিডার অব দি পিপল। আই উইল লিড দেম। দে উইল নট লিড মি। গো অ্যান্ড ডু ইউর ডিউটি।’ 

রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা আরম্ভ করেন সাড়ে ৩টায়। ১০ লক্ষাধিক লোকের গগনবিদারী স্লোগানে মুখরিত রেসকোর্স ময়দান। সভামঞ্চে জাতীয় চার নেতাসহ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা দেওয়ার জন্য দাঁড়ালেন, চারদিকে তাকালেন। মাউথপিসের সামনে পোডিয়ামের ওপর চশমাটি রাখলেন। হৃদয়ের গভীরতা থেকে—যা তিনি বিশ্বাস করতেন, যার জন্য তিনি সারাটা জীবন সংগ্রাম করেছেন, ফাঁসির মঞ্চে গিয়েছেন, সেই বিশ্বাসী আত্মা দিয়ে, বাংলার মানুষকে তিনি ডাক দিলেন, ‘ভাইয়েরা আমার’। তারপর একটানা ১৮ মিনিট ধরে বলে গেলেন স্বাধীনতার অমর মহাকাব্য। বক্তৃতায় তিনি মূলত স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। বঙ্গবন্ধুর সামনে ছিল দুটি পথ। এক. স্বাধীনতা ঘোষণা করা। দুই. পাকিস্তান ভাঙার দায়িত্ব না নিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে আখ্যায়িত না হয়ে সুচিন্তিত বক্তব্য প্রদান করা। তিনি নিপুণ সচেতনতার সঙ্গে দুটোই করলেন। বঙ্গবন্ধু জানতেন সেদিনের পরিস্থিতি। যেটা তিনি আমাদের বলেছিলেনও। সেনাবাহিনী তখন প্রস্তুত। মাথার ওপর বোমারু বিমান এবং হেলিকপ্টার গানশিপ টহল দিচ্ছে। যখনই বঙ্গবন্ধু এই ভাষায় বলবেন যে, ‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন’, তখনই তারা গোলাবর্ষণ শুরু করবে। সেজন্য বঙ্গবন্ধু বিচক্ষণতার সঙ্গেই বক্তৃতা করেছেন, যার ফলে পাকিস্তানিরা তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যায় আখ্যায়িত করার চেষ্টা করেও সফল হয় নি। সবশেষে তিনি বজ্রকন্ঠে ঘোষণা করেছেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ 

আমি লক্ষ করেছি, বঙ্গবন্ধু জীবনে কখনো স্ববিরোধী বক্তব্য দেননি। একটি বক্তব্য দিয়ে পরে সেই বক্তব্য অস্বীকার করা বা বক্তব্যের মধ্যে পরস্পরবিরোধিতা এটি তার কোনো দিন হয় নি। আর যা একবার বলেছেন, মৃত্যুর কাছে গিয়েও আপসহীনভাবে সেই কথা তিনি বাস্তবায়ন করেছেন। শ্রদ্ধেয়া বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের কাছে শুনেছি, ৬ তারিখ রাতে বঙ্গবন্ধু পায়চারী করেছেন এবং ভেবেছেন কী বলবেন! বঙ্গমাতা বলেছিলেন, ‘তোমার এত চিন্তার কারণ কী? সারা জীবন তুমি একটি লক্ষ্য নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছ, তোমার জীবনের যৌবন তুমি পাকিস্তানের কারাগারে কাটিয়েছ, ফাঁসির মঞ্চে গিয়েছ। তুমি যা বিশ্বাস করো, সেই বিশ্বাস থেকেই আগামীকাল বক্তৃতা করবে।’ বঙ্গবন্ধু তার হৃদয় ধারিত গভীর বিশ্বাস থেকেই সেদিন বক্তৃতা করেছেন।

বিশ্লেষণে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ অলিখিত একটি বক্তৃতা। ভাষণের সময় ১৮ মিনিট। শব্দসংখ্যা ১ হাজার ১০৮টি। আব্রাহাম লিংকনের Gettysburg Address-এর শব্দসংখ্যা ২৭২, সময় তিন মিনিটের কম এবং লিখিত। অন্যদিকে, মার্টিন লুথার কিং-এর ‘‘I have a dream’ ভাষণটির সময় ১৭ মিনিট, শব্দসংখ্যা ১ হাজার ৬৬৭। কিন্তু বিশ্বের কোনো নেতার ভাষণ এমন সংগ্রামমুখর ১০ লক্ষাধিক মুক্তিকামী নিরস্ত্র মানুষের সামনে হয় নি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষণটি প্রদান করে মানুষকে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে, নিরস্ত্র বাঙালিকে সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তরিত করে মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনা দিলেন। কী বিচক্ষণ একজন নেতা! আইএসআই ৭ই মার্চ ঢাকা ক্লাবের সামনে ছিল। তারা অপেক্ষা করেছিল—যে ঘোষণাটি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্য দিয়ে বলেছিলেন, ‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন’—তারা মনে করেছিল সেই কথাটি তিনি ৭ই মার্চ বলবেন। আমি আগেই বলেছি বঙ্গবন্ধু ছিলেন সতর্ক। তিনি সবই বলেছেন, কিন্তু শত্রুর ফাঁদে পা দেননি। উলটো শত্রুকেই ফাঁদে ফেলেছেন। যার জন্য পরদিন আইএসআই রিপোর্ট করল ‘চতুর শেখ মুজিব চতুরতার সঙ্গে বক্তৃতা করে গেল। একদিকে স্বাধীনতা ঘোষণা করল, আরেক দিকে চারটি শর্ত আরোপ করে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যায় আখ্যায়িত হলো না এবং পাকিস্তান ভাঙার দায়িত্ব নিল না। আমাদের নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। আমরা যে প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলাম সেটা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো।’ এই ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। একটি বক্তৃতার মধ্য দিয়ে তিনি একটি জাতি-রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছেন। একটি বক্তৃতার মধ্য দিয়ে তিনি নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে সশস্ত্র বাঙালি জাতিতে রূপান্তরিত করেছেন। এই একটি বক্তৃতার মধ্য দিয়ে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষকে তিনি স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করে একই মোহনায় দাঁড় করিয়েছেন। ৭ই মার্চের বক্তৃতার দিকনির্দেশনা অনুযায়ী ৯ মাস জনযুদ্ধ ও গেরিলাযুদ্ধের পথ অনুসরণ করে ৩০ লক্ষাধিক প্রাণ আর ২ লক্ষাধিক মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা মহত্তর বিজয় অর্জন করেছি। ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ আমাদের জাতীয় চেতনার ভিত্তি হয়ে আজ পবিত্র সংবিধানের অংশ।

লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা; সংসদ সদস্য; সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।