মুক্তিযুদ্ধে ফেনীর বিলোনিয়া

মুক্তিযুদ্ধে ফেনীর বিলোনিয়া

নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলার কাগজ : ফেনীর সীমান্তবর্তী বিলোনিয়া যুদ্ধ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায়। ভৌগোলিক বিবেচনায় এই স্থানটি মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদার বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেছিলো।

এ যুদ্ধের কৌশল, ইতিহাস সামরিক মানদণ্ডে আলাদা মর্যাদা পেয়েছে; যাকে আখ্যায়িত করা হয়েছে ‘ব্যাটল অব বিলোনিয়া’ নামে। 

অথচ এ গৌরবগাথা সম্পর্কে জানে না এই প্রজন্মের কিশোর ও তরুণ শিক্ষার্থীরা। তাঁদের জানাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা সরকারিভাবেও কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয় নি বলে অভিযোগ জেলার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। তরুণ প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরতে সরকারের পাশাপাশি শিক্ষকদেরও এগিয়ে আসতে হবে বলে মনে করেন মুক্তিযুদ্ধের গবেষক ও লেখকেরা। 

বিলোনিয়া সীমান্তের একপাশে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য। ওই সীমান্ত দিয়ে মুক্তিকামী মানুষ ভারতে প্রশিক্ষণ নিতে যেতো, ভারত থেকে অস্ত্র ও নানা সহযোগিতাও আসতো এ পথ ধরে। অঞ্চলটি মুক্তিযুদ্ধের সময় ২ নম্বর সেক্টরের অধীন ছিলো; যার সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর খালেদ মোশাররফ। যিনি পরে বীর উত্তম উপাধি পেয়েছিলেন।

২ নম্বর সেক্টরের অধীন এই যুদ্ধের সাব-সেক্টর কমান্ডার ছিলেন দশম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম। অবসর গ্রহণের সময় তাঁর পদবি ছিলো লেফট্যানেন্ট কর্নেল; পরে তিনি বীর বিক্রম উপাধি পেয়েছিলেন।

জাফর ইমাম বীর বিক্রম বলেন, বিলোনিয়া যুদ্ধ হয়েছিলো দুই পর্বে। প্রথমে প্রতিরোধ যুদ্ধ, একাত্তরের ২১ জুন পর্যন্ত। পাকিস্তানের ‘১৫ বেলুচ রেজিমেন্ট’, ‘২৪ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স’ ও ‘ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্স’ বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে প্রথম যুদ্ধটা এককভাবে লড়েছিলো মুক্তিবাহিনী। দ্বিতীয় যুদ্ধে সাহায্য করে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ২৩ মাউন্টেন ডিভিশন। অনুপ্রবেশ (ইনফিলট্রেশন), প্রতিরোধ (ডিফেন্স) ও শেষে সর্বাত্মক আক্রমণ (অ্যাসল্ট) এই ছিলো দ্বিতীয় বিলোনিয়া যুদ্ধের রণপরিকল্পনা।

তিনি বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মিসাইলের ব্যাপক উন্নতি হয়। ১৯৫৩ সালে প্রথম ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য মিসাইল আসে যুদ্ধের বাজারে; সঙ্গে যুদ্ধবিমানের সক্ষমতাও বৃদ্ধি পায় বহুগুণ। শব্দের চেয়েও বেশি গতিতে চলা এসব বিমানকে ভারী মেশিনগান দিয়েও ভূপাতিত করা কষ্টসাধ্য ছিলো। গত শতকের ৬০ থেকে ৭০ দশকের মধ্যে সাধারণ মেশিনগান দিয়ে এসব বিমান ধ্বংস করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মাঝারি মাত্রার মেশিনগান দিয়ে বিমান ভূপাতিত করার কোনও পরিসংখ্যান যদিও নেই। তবুও বলা যায়, এমন দুর্লভ ঘটনা ঘটলেও সেটি একদমই হাতেগোনা দুই-তিনটা হবে। আর সামরিক ইতিহাসের এ রকমই এক দুর্লভ ঘটনা ঘটেছিলো আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়। বাংলাদেশ মিলিটারি অ্যাকাডেমিসহ বিশ্বের বহু সামরিক কলেজে পাঠ্য করা হয়েছে বিলোনিয়ার দ্বিতীয় যুদ্ধ বা ‘সেকেন্ড ব্যাটল অব বিলোনিয়া বালজ’। 

মুক্তিযুদ্ধে ফেনীর এ গৌরবগাথা জেলার কিশোর ও তরুণরা কতটুকু জানে, তা জানতে ছয় উপজেলার মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে।

১৩৮ বছরের পুরোনো বিদ্যাপিঠ ফেনী সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী সাজ্জাদ হোসেন বলেন, মুক্তিযুদ্ধে ফেনীর কোনও উল্লেখ্যযোগ্য অবদান বা আলোচিত ঘটনা আছে, আমার জানা নেই। কেউ কখনও এ বিষয়ে কিছু বলে নি। 

একই কথা বলছেন ১১৪ বছরের পুরোনো বিদ্যাপিঠ ফেনী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী জেবা মায়মুনা ও জান্নাতুল নাঈম। তাঁদের ভাষ্য, ক্লাসের শিক্ষক কিংবা পরিবারের সদস্যরাও মুক্তিযুদ্ধে ফেনীর গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে বলে তাঁদের জানায় নি। 

সদর উপজেলার বিরলী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে চলতি বছর এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে সুমাইয়া সুলতানা। মুক্তিযুদ্ধে ফেনীর কোনও ইতিহাস সে জানে কি-না জিজ্ঞাস করলে উত্তর আসে ‘না’। 

সুমাইয়া বলে, বই পড়ে জেনেছি মুক্তিযুদ্ধে ১১ জন সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। যুদ্ধে ফেনীর কোনও অবদান ছিলো কিনা আমার জানা নেই। 

সীমান্তবর্তী উপজেলা ছাগলনাইয়া সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে চলতি বছর এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে ফাহিম মুনতাসীর নূহাশ। ফেনীর সীমান্তবর্তী বিলোনিয়া যুদ্ধ সম্পর্কে কী জানো? উত্তরে সে বলে, এ যুদ্ধে কী হয়েছে আমার জানা নেই। আমাকে কেউ কিছু জানায়ও নাই কোনোদিন।

একই উপজেলার আলহাজ আবদুল হক চৌধুরী ডিগ্রি কলেজের স্নাতক (সম্মান) অর্থনীতি বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী সাদমান সাকিব বলেন, ৬ ডিসেম্বর ফেনী মুক্ত হয়েছে। প্রতিবছর এ দিনে অনুষ্ঠান হয়। ফেনীর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এর বেশিকিছু তাঁর জানা নেই। 

ফেনী মডেল কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী শাহরিয়ার নাজিমও মুক্তিযুদ্ধের এখানকার কোনও ইতিহাসই জানেন না বলে জানান।

ফেনী সরকারি কলেজ থেকে চলতি বছর এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিতে যাওয়া ফারজানা আহমেদ অহনা এক মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে ফেনীর বিলোনিয়ার যুদ্ধ সম্পর্কে জেনেছেন। তাঁর কাছে এটি ‘গর্বের একটি যুদ্ধ’ হলেও বিস্তারিত জানেন না তিনি।

শিক্ষার্থীদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস না জানা প্রসঙ্গে ফেনী সরকারি কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোশারফ হোসেন বলেন, মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা। যতোদিন বাঙালি জাতি থাকবে, ততোদিন এই মুক্তিযুদ্ধ থাকবে অবিস্মরণীয় এক গৌরবগাথা হয়ে। তবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বর্তমান প্রজন্মের বেশিরভাগই জানে না।

তিনি বলেন, আমি মনে করি, ইতিহাস নিয়ে লিখিত বই, মুক্তিযুদ্ধের ওপর নির্মিত বিভিন্ন ছবি-নাটক এগুলো আরও বেশি প্রচার করা দরকার। ফেনীতে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বইগুলি প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাখা উচিত। বর্তমান প্রজন্ম পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্য বই পড়ে না; শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বইপড়ার বিষয়ে শিক্ষাথীদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

বীর মুক্তিযোদ্ধা সত্তরোর্ধ্ব প্রবীণ সাংবাদিক আবু তাহের বলছেন, মুক্তিযুদ্ধে ফেনীর গৌরব সম্পর্কে না জানা, শিক্ষার্থীদের একার দোষ নয়। তরুণ প্রজন্মকে এমন তথ্য জানাতে সরকারিভাবে জোরালো উদ্যোগ কখনোই নেওয়া হয় নি। এক্ষেত্রে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদেরও ব্যর্থতা রয়েছে। তাঁদের সঙ্গে নবীন প্রজন্মের তেমন সম্পর্ক নেই। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ থেকেও উদ্যোগ নেওয়া হয় নি। সরকারিভাবে উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের এগিয়ে আসতে হবে।

ফেনী জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মোতালেব বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচয় করিয়ে যুদ্ধের গল্প শোনানো হয়েছিলো। তবে সেটি সেই বছর গুটিকয়েক স্কুলেই সীমাবদ্ধ ছিলো। আমি জেলা প্রশাসন কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সভায় একাধিকবার বলেছিলাম, সরকারিভাবে উদ্যোগ নিতে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের পরিচয় করিয়ে গল্প শোনাতে। বিভিন্ন সময় আশ্বাস দিলেও কখনই জোরালো উদ্যোগ নেওয়া হয় নি। এক্ষেত্রে সরকারকে আরও আন্তরিক হতে হবে।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা করছেন গবেষক, লেখক ও বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা-বাসসের ফেনী প্রতিনিধি ও দৈনিক ফেনীর সম্পাদক আরিফ রিজভী। তাঁর বাড়ি ফেনী শহরের মিজান রোডে।

আরিফ ‘ফেনীর ৩১ বীর মুক্তিযোদ্ধা’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। এ ছাড়া তাঁর সম্পাদনায় ‘ফেনী কলেজ বধ্যভূমি’ (প্রকাশিত) ও ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিষদ’ (প্রকাশের অপেক্ষায়) গ্রন্থে ফেনীর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিশাদ তথ্য রয়েছে।

আরিফ বলেন, মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য বীরত্বের জন্য ফেনীর ৩১ জন মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রীয় খেতাবে ভূষিত করা হয়েছিলো। খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে চারজন বীর উত্তম, সাতজন বীর বিক্রম ও ২০ জন বীর প্রতীক রয়েছেন। যুদ্ধে বীরত্বের জন্য এক জেলায় এতজন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ফেনী ছাড়া অন্য কোথাও নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব ধরনের প্রতিযোগিতায় পুরস্কার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের বই নিশ্চিত করা প্রয়োজন। অঞ্চলভেদে মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সম্বলিত বইগুলো এই তালিকায় নিশ্চিত করতে হবে। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক চর্চা আরও বাড়াতে হবে। এসব আয়োজনে সন্তানের অংশগ্রহণ এবং উপস্থিতি অভিভাবকদের নিশ্চিত করতে হবে।

জাফর ইমাম বীর বিক্রম বলেন, আমার লেখা ‘দাম দিয়ে কিনেছি এই বাংলা’ এবং ‘পাইওনিয়ার প্লাটুনের বীর মুক্তিযোদ্ধা’ ও গোলাম মুস্তাফা সম্পাদিত ‘ফেনী-বিলোনিয়া: রণাঙ্গনের এক প্রান্তর’-বইয়ে বিলোনিয়া যুদ্ধের ইতিবৃত্ত তুলে ধরা হয়েছে। এই বইগুলো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। তরুণ প্রজন্মকে এই অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা ইতিহাস জানতে হলে, বইগুলো পড়তে হবে।

মুক্তিবাহিনীর ছক ও বিজয় :
জাফর ইমামের ‘দাম দিয়ে কিনেছি এই বাংলা’ বই থেকে জানা গেছে, একাত্তরে মুক্তিবাহিনী ফেনী থেকে বিলোনিয়া রেলস্টেশন দখলের ছক কাটে। ২ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ দায়িত্ব অর্পণ করেন ক্যাপ্টেন জাফর ইমামকে।

মুক্তিবাহিনীর টাস্কফোর্স কমান্ডার ছিলেন প্রথম যুদ্ধের অধিনায়ক ফেনীর সন্তান ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম ও সহঅধিনায়ক ক্যাপ্টেন গোলাম হেলাল মোর্শেদ খান (পরবর্তীকালে মেজর জেনারেল, বীর বিক্রম)। ৩ নম্বর সেক্টরের অন্যতম সাব-সেক্টর কমান্ডার হেলাল মোর্শেদকে পরে ডেকে আনা হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান এখানে দুটি স্থানে (পরশুরাম ও চিথলীয়া)। ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম দশম এবং দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে বিলোনিয়ায় আঘাত হানার পরিকল্পনা করেন।

দল দুটির ৮০ ভাগ সৈন্যই পুরনো বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য। আধুনিক সমরবিদ্যায় প্রশিক্ষিত তাঁরা; অস্ত্রেও দল দুটি স্বয়ংসম্পূর্ণ। বাড়তি হিসেবে ১ নম্বর সেক্টর থেকে আরেক কোম্পানি সেনা আনা হয়। সবমিলে সেনাদের পাঁচভাগে ভাগ করা হয়। পরিকল্পনা ছিলো মুক্তিবাহিনীর সৈন্যরা পাকিস্তানিদের দুই ঘাঁটির মাঝে অবস্থান নিয়ে তাঁদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে।

১৯৭১ এর ৫ নভেম্বর মধ্যরাতে একদিক থেকে দশম রেজিমেন্ট আরেক দিক থেকে দ্বিতীয় রেজিমেন্ট গোপনে ভারতের অংশ থেকে বাংলাদেশের মাটিতে প্রবেশ শুরু করে। প্রথমে ব্রাভো কোম্পানি, পরে সেকেন্ড চার্লি কোম্পানি এবং একেবারে পেছনে হেলাল মোর্শেদের ডেল্টা কোম্পানি। পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানের মধ্যে যে ফাঁকা জায়গাগুলো ছিলো, সেখান দিয়ে মুহুরী নদী পেরিয়ে মুক্তিবাহিনীর দলগুলো নীরবে এগিয়ে যায় সলিয়ার দিকে। এরপর ১ নম্বর সেক্টরের ক্যাপ্টেন মাহফুজ তাঁর কোম্পানি নিয়ে গুথুমা দিয়ে ঢুকে ব্রাভো কোম্পানির সামনের অংশের সঙ্গে যোগ দেন। মুহুরী নদীর পূর্বপাড়ের ধনিকুণ্ডায় এসে পড়ে আলফা কোম্পানি।

রেললাইনের ধারের বাঙ্কারে ছিলেন সুবেদার এয়ার আহমেদ (পরে বীর বিক্রম)। হঠাৎই একটি শব্দে ভেঙে যায় ৬ নভেম্বর ভোরের নীরবতা। ফেনী-বিলোনিয়া রেলসড়ক ধরে ফুলগাজীর দিক থেকে একটি ট্রলি এগিয়ে আসছিলো। ওই ট্রলিতে চার জওয়ানকে নিয়ে চিথলিয়ার দিকে আসছিলেন এক পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন। পরিখায় থাকা মুক্তিযোদ্ধা সুবেদার এয়ার আহমেদ ও সঙ্গীদের নাগালের মধ্যে ট্রলিটি আসতেই বাঙ্কার থেকে গর্জে ওঠে হালকা মেশিন গান। ভোরের আলো ফুটতেই মুক্তিযোদ্ধারা ধ্বংস করে দেয় রেললাইনে থাকা পাকিস্তানিদের ট্রলি। সঙ্গে সঙ্গে নিহত হয় পাঁচ শত্রু। বিলোনিয়াকে মুক্ত করার যুদ্ধে প্রাথমিক বিজয় পায় মুক্তিবাহিনী।

এয়ার আহমেদ বাঙ্কার থেকে বের হয়ে পাকিস্তানিদের পিস্তলটি নিয়ে ফেরত আসছিলেন। এমন সময় কোথা থেকে একটি বুলেট এসে বিদ্ধ হয় তাঁর মাথায়। গুলির শব্দে পরশুরাম এবং চিতলীয়া দুই ঘাঁটিই সতর্ক হয়ে উঠেছিলো। দুই অবস্থান থেকেই এলোপাতাড়ি পাল্টা গুলি শুরু করেছিলো পাকিস্তানি বাহিনী। সহযোদ্ধা সুবেদার এয়ার আহমেদকে হারিয়ে প্রতিশোধের আগুনে উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে মুক্তিবাহিনী।

৯ নভেম্বর থেমে থেমে যুদ্ধ চলে সারাদিন। পাকিস্তানিদের বিরামহীন আর্টিলারি শেলিংয়ে পুরো এলাকা কেঁপে উঠলেও মুক্তিবাহিনীর তেমন কোনও ক্ষতি করতে পারে নি তারা। এবার পাকিস্তানিরা শুরু করে সর্বাত্মক বিমান হামলা। শত্রুপক্ষের চারটি এফ-৮৬ জঙ্গি বিমান (স্যাবর জেট) সব এলাকা ঘুরে ঘুরে নিচু হয়ে মেশিনগান ও রকেট হামলা চালাচ্ছিলো। শব্দের চেয়েও দ্রুত গতিতে চলতে থাকা বিমান মেশিনগান দিয়ে ধ্বংস করা এক রকম অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। মুক্তিবাহিনীর কাছে কোনও বিমান-বিধ্বংসী অস্ত্র না থাকায় হাতে থাকা মিডিয়াম মেশিনগান দিয়েই স্যাবরকে গুলি করার সিদ্ধান্ত হয়।

তখনই হাবিলদার হাশমতের মেশিনগান থেকে গুলি নির্ভুল আঘাত হানে শত্রুবিমানে। বিমানটি পরে কুমিল্লার লাকসাম এলাকায় বিধ্বস্ত হয়। মিত্রবাহিনীর ২৩ মাউন্টেন ডিভিশনের আর্টিলারি সাপোর্টে শুরু হয় সর্বাত্মক যুদ্ধ। এই যুদ্ধে হতাহত হয় শত্রুদের প্রায় ২ শ সৈনিক। দুই ঘাঁটির পাকিস্তানি সেনারা এককভাবে আত্মসমর্পণ করে। তাদের মধ্যে ৭০ জন সৈনিক ও দুজন কর্মকর্তা ছিলেন।

পাকিস্তানি সেনাদের পরাজয়ে ১০ নভেম্বর মুক্ত হয় বিলোনিয়া। ‘জয় বাংলা’ স্লোগান কণ্ঠে উল্লসিত হয়ে ওঠে মুক্তিবাহিনী। এরই ধারাবাহিকতায় ৬ ডিসেম্বর মুক্ত হয়েছিলো ফেনী।