ফিলিস্তিনে গোপনে অস্ত্র দিচ্ছে ইরান!
নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলার কাগজ : অধিকৃত পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের কাছে অস্ত্র সরবরাহ করার জন্য গোয়েন্দা অপারেটিভ এবং ইসরায়েল বিরোধীদের নিয়োগ করেছে ইরান। এজন্য মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে একটি গোপন চোরাচালান রুট পরিচালনা করছে তেহরান। তারা পশ্চিম তীরে অস্ত্রের বন্যা বইয়ে দিতে মরিয়া।
যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল এবং ইরানের কর্মকর্তাদের বরাতে মঙ্গলবার (৯ এপ্রিল) নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
তিনজন ইরানি কর্মকর্তার বর্ণনা অনুযায়ী ইরানের লক্ষ্য হলো, যতটা সম্ভব অস্ত্র দিয়ে ফিলিস্তিনকে ভরিয়ে ফেলে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, পশ্চিম তীরে পাচার হওয়া অনেক অস্ত্র ইরান থেকে ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান হয়ে দুটি পথ ধরে সরবরাহ করা হয়। অস্ত্রগুলো সীমান্ত অতিক্রম করার পর একটি বহুজাতিক ব্যবস্থার মাধ্যমে একাধিক হাত পরিবর্তন হয়ে পশ্চিম তীরে পৌঁছায়।
এতে সৈন্য এবং গোয়েন্দা সংস্থার পাশাপাশি ইসরায়েল বিরোধী এমনকি অপরাধী গোষ্ঠীর সদস্যরাও অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
ইরানের কর্মকর্তা এবং বিশ্লেষকদের মতে, এই অভিযানের একটি মূল দল বেদুইন চোরাকারবারিরা। তারা জর্ডান থেকে অস্ত্র ফিলিস্তিন সীমান্তের ওপারে নিয়ে যায়।
নিউইয়র্ক টাইমস পশ্চিম তীরে অস্ত্র পাচারে ইরানের প্রচেষ্টা সম্পর্কে ইসরায়েলের তিনজন, ইরানের তিনজন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তিনজন সিনিয়র নিরাপত্তা এবং সরকারি কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছে।
গবেষণা সংস্থা ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসির সন্ত্রাসবিরোধী কর্মসূচির পরিচালক এবং চোরাচালানের রুটের ওপর একটি গবেষণাপত্রের লেখক ম্যাথিউ লেভিট বলেছেন, ইরানিরা পশ্চিম তীরকে অস্ত্র দিয়ে প্লাবিত করতে চায়। এজন্য তারা জর্ডান, পশ্চিম তীর এবং ইসরায়েলের অপরাধীদের নেটওয়ার্ককে ব্যবহার করছে। প্রাথমিকভাবে পশ্চিম তীরে চোরাচালানের অস্ত্র সরানো এবং বিক্রি করার কাজ করছে বেদুইনরা।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, ইরানের এই অভিযান প্রায় দুই বছর আগে শুরু হয়। ইরান তখন অন্যান্য নিষিদ্ধ পাচারের জন্য পূর্বে প্রতিষ্ঠিত রুট ব্যবহার করতে শুরু করে। সেই সময় থেকে এই অঞ্চলে ঠিক কতগুলো অস্ত্র এসেছে তা স্পষ্ট নয়।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এগুলোর বেশিরভাগই ছোট অস্ত্র। কয়েক বছর ধরে ইরানের নেতারা অধিকৃত পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের অস্ত্র দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা ঘোষণা করেছেন।
ইরান দীর্ঘকাল ধরে এই অঞ্চলের অন্যত্র সশস্ত্র গোষ্ঠীর কাছে ইসরায়েলে হামলার জন্য অস্ত্র সরবরাহ করেছে। এর মধ্যে গাজায় তার দুটি প্রাথমিক ফিলিস্তিনি মিত্র হলো হামাস এবং ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদ।
ইরানি কর্মকর্তারা বলেছেন, তেহরান তার বন্দুক এবং গোলাবারুদ দিয়ে এলাকাটিকে ব্যাপকভাবে প্লাবিত করার জন্য বেছে নিয়েছে।
ইরানের সামরিক বিশেষজ্ঞ আফশোন অস্তোভার বলেছেন, ইরান পশ্চিম তীরের দিকে মনোনিবেশ করছে। কারণ, তেহরান বুঝতে পেরেছে যে, অদূর ভবিষ্যতে গাজায় প্রবেশাধিকার কঠিন হতে পারে। তাই পশ্চিম তীরকে সত্যিই পরবর্তী সীমান্ত হতে হবে যেখানে ইরান অনুপ্রবেশ করবে এবং অস্ত্র বিস্তার করবে। তারা যদি তা করতে সক্ষম হয়, তবে পশ্চিম তীরও গাজার মতো ইসরায়েলের জন্য বড় সমস্যা হয়ে উঠবে।
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ফাতাহ পশ্চিম তীরের বেশিরভাগ অংশ নিয়ন্ত্রণ করে। গত সপ্তাহে ফাতাহ ইরানকে অভিযুক্ত করেছে যে, এ ভূখণ্ডে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব উপায়ে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে তেহরান। তবে ইরানের জাতিসংঘ মিশন চোরাচালান অভিযানের বিষয়ে মন্তব্য করে নি।
জাতিসংঘের দেশটির রাষ্ট্রদূত আমির সাইদ ইরাভানি বলেছেন, ইরানের মূল্যায়ন হলো- ইহুদিবাদী শাসকদের দখলদারিত্ব প্রতিরোধের একমাত্র কার্যকর উপায় হচ্ছে সশস্ত্র প্রতিরোধ। ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ বাহিনী তাদের উদ্দেশ্যের জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র তৈরি ও সংগ্রহ করার ক্ষমতা রাখে। বিশ্লেষকরা বলেছেন, চোরাচালান হওয়া অস্ত্রের বেশিরভাগই হ্যান্ডগান এবং অ্যাসল্ট রাইফেলের মতো ছোট অস্ত্র।
মার্কিন কর্মকর্তা ও ইসরায়েলের কর্মকর্তাদের মতে, ইরান উন্নত অস্ত্রও পাচার করছে।
ইসরায়েলের কর্মকর্তারা বলেছেন, এই অস্ত্রগুলো মধ্যে ট্যাঙ্ক-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র এবং রকেট চালিত গ্রেনেড রয়েছে, যা ইসরায়েলের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা শিন বেত বিবৃতিতে বলেছে, তাঁরা সম্প্রতি পশ্চিম তীরে পাচার করা উন্নত সামরিক সরঞ্জাম জব্দ করেছে। কর্মকর্তারা বলেছেন, একটি রুট ধরে ইরান সমর্থিত যোদ্ধা এবং ইরানি কর্মীরা সিরিয়া থেকে জর্ডানে অস্ত্র বহন করে। সেখান থেকে ইরানি কর্মকর্তারা সীমান্তে তাদের বেদুইন চোরাকারবারিদের কাছে অস্ত্র স্থানান্তর করে। এরপর যাযাবররা অস্ত্রগুলোকে ইসরায়েলের সীমান্তে নিয়ে যায়, যেখানে তাদের সহযোগীরা পরে তা পশ্চিম তীরে নিয়ে যায়।
ইসরায়েলের সঙ্গে জর্ডানের ৩০০ মাইল দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। গত বছর জর্ডানের একজন আইনপ্রণেতাকে জর্ডানের আম্মানে অভিযুক্ত করা হয় এ কারণে যে, তিনি ২০২২ সালে পশ্চিম তীরে ২০০টিরও বেশি অস্ত্র পাচারের চেষ্টার পর ধরা পড়েন। যদিও সেই অস্ত্রের উৎস স্পষ্ট নয়।
চোরাচালান রুট সমন্বয়ের কাজ বেশিরভাগ করে ইরানের কুদস ফোর্স ও রেভল্যুশনারি গার্ডের গোয়েন্দা সংস্থা।
ইরানের গোপন অভিযান এই উদ্বেগ বাড়িয়ে তুলছে যে, তেহরান পশ্চিম তীরকে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী ছায়া যুদ্ধের পরবর্তী রণক্ষেত্রে পরিণত করতে চাইছে। এই দ্বন্দ্ব মধ্যপ্রাচ্যে একটি বিস্তৃত সংঘাতের ঝুঁকি তৈরি করছে। কারণ, সিরিয়ায় ইরানের দূতাবাস প্রাঙ্গণে ইসরায়েলের হামলার প্রতিশোধ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তেহরান, যাতে ইরানি সশস্ত্র বাহিনীর সাতজন কমান্ডার নিহত হয়।