রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুনে সবাই বুঝেছিলো যুদ্ধ হবেই

রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুনে সবাই বুঝেছিলো যুদ্ধ হবেই

নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলার কাগজ ও ডন : ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া ঐতিহাসিক ভাষণ শুনেই শুরু হয়েছিল সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। তবে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের বিরোধিতার কারণে সেদিন সরাসরি রেডিওতে প্রচার করা সম্ভব হয় নি। সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে পরদিন সকাল সাড়ে ৮টায় রেডিও পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশ বেতার) প্রচার হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ। মুহূর্তেই তা ছড়িয়ে যায় পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে।

বঙ্গবন্ধু ভাষণে স্পষ্ট করে বলেছিলেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো।

তোমাদের যা কিছু আছে তা-ই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।...এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এই ভাষণের পর ঢাকায় একদল দামাল ছেলেমেয়ে কাঠের রাইফেল হাতে মুক্তিকামী বাঙালিকে প্রেরণা দিতে ‘সশস্ত্র মার্চপাস্ট ও মহড়া’ দিতে থাকে। এর রেশ ছড়িয়ে পড়ে প্রতিটি গ্রামে, পাড়া-মহল্লায়। গঠিত হয় সংগ্রাম পরিষদ। মিছিল-সমাবেশ, পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ তীব্রতর হতে থাকে। রাজনৈতিক কর্মী, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কৃষক, ক্ষেতমজুরসহ দামাল ছেলেমেয়েরা এসব মিছিলে যোগ দেন। সবার মধ্যেই ছিল উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা।

কথা হয় বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার চরবানিয়ারি ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শান্তি রঞ্জন মণ্ডলের সঙ্গে। ১৯৭১ সালে তিনি ইস্ট পাকিস্তান ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের মেকানিক পদে মোরেলগঞ্জে কর্মরত ছিলেন। মার্চে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে তিনি চরবানিয়ারি ইউনিয়নের গ্রামের বাড়িতে চলে আসেন। তখন তাঁর বয়স ২৮ বছর। সেদিনের স্মৃতিচারণ করে শান্তি রঞ্জন মণ্ডল বাঙলার কাগজ ও ডনকে বলেন, ‘বাড়িতে আমাদের একটি বড় ট্রানজিস্টর ছিল। রেডিওর খবর শুনতে তখন আশপাশের লোকজন আমাদের বাড়িতে জড়ো হতো। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার হওয়ার কথা আছিল। কিন্তু হয় নাই। বারবার রেডিও চালু করা হয়। শোঁ শোঁ শব্দ হতো। পরদিন ভোরে রেডিও চালু করলেও শোঁ শোঁ শব্দ হয়। পরে ৭টা-৮টার দিকে রেডিওতে সাউন্ড আসে। বলা হয়, সাড়ে ৮টায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার হবি। খবর ছড়িয়ে যায়। মেলা লোক বাড়িতে চইলে আসে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুরু হলে সবাই নীরব হয়ে যায়। ভাষণ শেষেও সবাই চুপ ছিল। সবাই বুজছিল যুদ্ধ হবেই।’

শান্তি রঞ্জন আরও বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে আমার মা-বাবা আমাকে আর দুই ছোট ভাইকে নিয়া চিন্তায় পড়ে যান। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লোকজন চরবানিয়ারি বাজারে জমায়েত হয়। অনেকে বলছিলেন, গ্রামে লুটপাট হতে পারে। তখন ইউনিয়নের মুরব্বি ছিলেন নগেন বড়াল (বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান অশোক বড়ালের বাবা)। তাঁর ছোট ছেলে কালিদাস বড়ালের (পরে চেয়ারম্যান হন এবং দুর্বৃত্তের হামলায় মারা যান) নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এলাকায় টহল বাড়ে। পিরোজপুর, নাজিরপুর থেকে হিন্দুরা আমাদের এলাকায় নিরাপত্তার জন্য আসতে থাকে। মা-বাবা ও ছোট দুই ভাইকে বাড়িতে রেখেই বন্ধুদের সঙ্গে এপ্রিলে ভারতে চলে যাই। যুদ্ধের প্রশিক্ষণ শেষে জুন মাসে দেশে ফিরে ৯ নম্বর সেক্টরে ক্যাপ্টেন তাইজুল ইসলামের নেতৃত্বে যুদ্ধ করতে থাকি।’

১৯৭১ সালে কুষ্টিয়া কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন খোকসা উপজেলার মো. আলাউদ্দিন খান। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে তিনিও যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। আলাউদ্দিন খান বাঙলার কাগজ ও ডনকে বলেন, ‘৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য উদগ্রীব ছিলাম। কিন্তু এদিন ভাষণ প্রচার হয় নি। আমি তখন কুষ্টিয়া শহরে একটি বাসায় মেসে থাকতাম। বাড়ির মালিকের একটি রেডিও ছিল। সকালবেলা বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার হয়। মেসের ৭-৮ জন একসঙ্গে ভাষণ শুনি। তখনই বুঝতে পারি, দেশ স্বাধীন হবেই। দুপুর হতেই শহরে মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। সবার মধ্যে উত্তেজনা। ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি আবদুল জলিল ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল হাদীর (প্রয়াত) নেতৃত্বে আমরা ছাত্ররা মিছিলে যোগ দিই।’ আলাউদ্দিন এপ্রিলের শেষের দিকে ভারতের নদিয়ার শিকারপুর ক্যাম্পে এবং জুন মাসে ভারতের দেরাদুনে প্রশিক্ষণ নেন। জুলাই মাসের শেষের দিকে দেশে ফিরে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

১৯৭১ সালে জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার নেকজাহান বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন এ এফ এম হেফজুল বারী খান। তিনি ২০১৫ সালে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক পদে অবসরে যান। রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুনে আরও অনেকের মতো তিনিও সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন এবং ১১ নম্বর সেক্টরে শেরপুর অঞ্চলে যুদ্ধ করেন। হেফজুল বারী বলেন, ‘১৯৭১ সালে বর্তমান ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খানের ইসলামপুরের বাড়িতে লজিং থাকতাম। তাঁর বাবা হাবিবুর রহমান খানসহ পরিবারের সবাই আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বাড়িতে একটি রেডিওতে সহপাঠীদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে উজ্জীবিত হই। ঢাকার খবর জানতে সকালেই ইসলামপুর রেলস্টেশনে যাই। ঢাকা থেকে যাঁরা আসতেন, তাঁদের কাছ থেকে খবর নিতাম। স্টেশন এলাকায় অনেক ভিড় ছিল।’ তিনি আরও বলেন, ‘চায়ের দোকান, হাটবাজার সব জায়গায় মানুষের কৌতূহল ছিল ঢাকায় কী হচ্ছে জানার জন্য। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে এলাকায় মিছিল-মিটিং শুরু হয়।’

জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ যাঁরা প্রচার করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ঢাকা কেন্দ্রের তৎকালীন অনুষ্ঠান সংগঠক আশফাকুর রহমান খান (৮২) ছাড়া আর কেউ বেঁচে আছেন বলে তথ্য পাওয়া যায় নি। আশফাকুর রহমান বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রেকর্ড ও সম্প্রচার প্রসঙ্গে স্বাধীন বাংলা বেতারকর্মী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মনোয়ার হোসেন খান বাঙলার কাগজ ও ডনকে বলেন, ৭ মার্চ দুপুর ২টায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ দেওয়ার কথা ছিল। এ জন্য আগের দিন রাতে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু যে মঞ্চ থেকে ভাষণ দেবেন, সেখানে টেলিফোনের তার ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি বসানো হয়। রেডিওতে ৭ মার্চ দুপুর থেকে কিছুক্ষণ পর পর বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সম্প্রচারের আগাম ঘোষণা দেওয়া হতে থাকে। এরই মধ্যে সামরিক বাহিনীর গণমাধ্যম কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালেক টেলিফোনে আদেশ দেন– ‘নাথিং অব শেখ মুজিবুর রহমান উইল গো অন দ্য এয়ার আনটিল ফারদার অর্ডার।’ রেডিওর সবাই ওই আদেশের প্রতিবাদে সম্প্রচার কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ করে অফিস ছেড়ে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে চলে যান। শুরু হয় কর্মবিরতি। রেসকোর্স ময়দানে গিয়ে রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রের আঞ্চলিক পরিচালক আশরাফুজ্জামান খানের নেতৃত্বে ৮-১০ কর্মকর্তা অত্যন্ত গোপনে বঙ্গবন্ধুর ২১ মিনিটের সম্পূর্ণ ভাষণ রেকর্ড করেন। রেডিওকর্মীরা কর্মবিরতিতে থাকায় টনক নড়ে পাকিস্তান প্রশাসনের। পরে সেনাবাহিনী রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ প্রচার করতে দিতে রাজি হয়। তবে শর্ত ছিল, রেডিওকর্মীদের কাজে যোগ দিতে হবে। ৮ মার্চ সকাল ৭টায় সবাই কাজে যোগ দেন। সকাল সাড়ে ৮টায় প্রচার হয় বঙ্গবন্ধুর রেকর্ড করা ভাষণ।

তিনি আরও বলেন, ‘পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ গোপনে ভিডিও করতে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম করপোরেশনের চেয়ারম্যান এ এইচ এম সালাহউদ্দিন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অভিনেতা) এম আবুল খায়েরও তৎপরতা চালিয়েছিলেন। ক্যামেরাম্যান ছিলেন প্রয়াত আবুল খায়ের। তবে ১০ মিনিটের বেশি বঙ্গবন্ধুর ভাষণের ভিডিও রেকর্ড করা সম্ভব হয় নি।’