ইত্তেফাক, বাংলাদেশ ও সাংবাদিকতার দাবি

ইত্তেফাক, বাংলাদেশ ও সাংবাদিকতার দাবি

আসিফুর রহমান সাগর :: গণমানুষের মুখপত্র দৈনিক ইত্তেফাক ৭১ বছরে পা দিল আজ। এ এক দীর্ঘ পথচলা। গত সাত দশক ধরে ইত্তেফাক প্রকাশিত হচ্ছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে দৈনিক ইত্তেফাক বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ করে চলেছে। তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া যে আপসহীন যাত্রা শুরু করেছিলেন, পরবর্তী প্রজন্মের হাত ধরে তা আজও এগিয়ে চলেছে। এই পথচলা খুব মসৃণ ছিল না। আমাদের প্রাণের এই বাংলাদেশের জন্মেরও আগে ছয় দফা আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান, মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং রক্তের দামে কেনা সেই দেশের উন্নয়নের পথযাত্রা— প্রতিটি পদক্ষেপ ইত্তেফাক গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে। সময়ের দাবি মিটিয়ে সংবাদ পরিবেশন করেছে। ইত্তেফাক সবসময় সত্য ও দেশের স্বার্থের প্রতি অবিচল থেকেছে। মুক্তিযুদ্ধ দৈনিক ইত্তেফাকের নিরন্তর প্রেরণার উৎস।

আমরা দাবি না করলেও, সাধারণ্যে এমন কথা চালু রয়েছে, দৈনিক ইত্তেফাক ও পূর্ব পাকিস্তান থেকে বর্তমানের বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সামাজিক যে পথযাত্রা—সেই পথে সমান্তরালভাবে ইত্তেফাকও নিজেদের যাত্রা অব্যাহত রেখেছে। যে কোনো ক্রান্তিকালে দেশের মানুষের জন্য দিকনির্দেশনামূলক সংবাদ পরিবেশন করে চলেছে। সেই কঠিন পথচলায় দৈনিক ইত্তেফাকের পাশে সবসময় যারা সঙ্গে ছিলেন এবং এখনো আছেন, তারা আমাদের অগণিত পাঠক। দেশবাসীর অকুণ্ঠ সমর্থন, সীমাহীন ভালোবাসাই ছিল দৈনিক ইত্তেফাকের সুদীর্ঘ পথচলার একমাত্র শক্তি ও সাহস। আজকের শুভ মুহূর্তে বাংলাদেশের জনগণের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা, শুভেচ্ছা।

আজকের শুভক্ষণে তাই দৈনিক ইত্তেফাক গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনে নিহত শহিদদের। মহান মুক্তিযুদ্ধে শহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের— যাদের ত্যাগ, পরামর্শ ও ভালোবাসায় দৈনিক ইত্তেফাক কয়েক প্রজন্ম পেরিয়ে এসেছে, তাদের আজ আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। দৈনিক ইত্তেফাক তাই আজ গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছে গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও নির্ভীক সাংবাদিক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে। এদের সীমাহীন প্রেরণা, ভালোবাসা ও ত্যাগের বিনিময়ে দৈনিক ইত্তেফাক এই দীর্ঘ পথ পেরিয়ে আসার শক্তি পেয়েছে।

মূলত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মানিক মিয়া ও দৈনিক ইত্তেফাক এই তিন জনের মিলিত শক্তি এক হয়ে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। তারই পথ ধরে মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।

সাংবাদিকতার মূল লক্ষ্যই হচ্ছে সময়ের দাবি মেটানো। সেই দিক থেকে দৈনিক ইত্তেফাক তার প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই সময়ের দাবি মিটিয়ে এসেছে। সহজ করে বললে, মানুষের অধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলে এসেছে। আজ ৫২ বছর পর মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার স্বপ্ন-লালিত যে বাংলাদেশ—দৈনিক ইত্তেফাক সেই জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছিল। সেই পথ ছিল অত্যন্ত কঠিন। কিন্তু সৎ সাংবাদিকতা ছিল সেই কঠিন পথ পাড়ি দেওয়ার মন্ত্র। সৎ সাংবাদিকতার সেই মন্ত্র ইত্তেফাক আজও হৃদয়ে ধারণ করে চলেছে।

১৯৭১ সালের পয়লা মার্চের সামরিক আইনের বিধান অগ্রাহ্য করেই ইত্তেফাক পত্রিকা সে সময়কার অসহযোগ আন্দোলনের খবর নিয়মিতভাবে গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করে। অথচ সরকার আপত্তিকর সংবাদ পরিবেশনের দায়ে ১০ বছরের কারাদণ্ডের বিধান করেছিল। কিন্তু দৈনিক ইত্তেফাক তার কোনো তোয়াক্কা করেনি। মানুষের মুক্তির প্রশ্নে, স্বাধীনতার প্রশ্নে অস্তিত্ব বিলীনের ঝুঁকি অগ্রাহ্য করে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের প্রতি নিরবচ্ছিন্নভাবে সমর্থন জুগিয়ে যায়। ইত্তেফাকের এই ভূমিকা উপমহাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসের একটি উজ্জ্বল অধ্যায়।

মুক্তিযুদ্ধের পর নতুন বাস্তবতায় দৈনিক ইত্তেফাক নতুন আঙ্গিকে প্রকাশিত হচ্ছে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ইত্তেফাক জনগণের চাওয়া-পাওয়াকে গুরুত্ব দিয়ে সংবাদ পরিবেশন করেছে। মানুষের সুখ-দুঃখের ভাগিদার হয়েছে। দেশ গড়ার নতুন সংগ্রামে নেমেছে। রাজনৈতিক মুখপত্রের বলয় থেকে বেরিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে  তাদের সাংবাদিকতা অগ্রসর হচ্ছে এখন। সময়ের দাবি মেটাতে ইত্তেফাক এর বিন্যাসে অনেক পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু সত্য, ন্যায়, গণতন্ত্র এবং বাংলাদেশের মানুষের অধিকারের প্রশ্নে ইত্তেফাকের অবস্থান প্রতিষ্ঠার পর থেকে কখনো বদলায়নি। দৈনিক ইত্তেফাক কখনোই বাণিজ্যের জন্য, যে কোনো রকম ফায়দার জন্য কিংবা কাউকে সমাজে হেয় করবার জন্য সংবাদ পরিবেশন করে নি। ইত্তেফাক কখনোই রাগ-বিদ্বেষ চরিতার্থ করতে সংবাদ পরিবেশন করেনি। তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার সময়কাল থেকে যা শুরু হয়েছে তা প্রজন্মের পর প্রজন্ম পেরিয়ে আসার পর উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সেই দায়ভার বহন করে চলেছে, ভবিষ্যতেও যাবে।

১৯৪৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের বিরোধী সংগঠন হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। সে বছরই নবগঠিত সংগঠনের মুখপত্ররূপে ‘সাপ্তাহিক ইত্তেফাক’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। কলকাতা প্রত্যাগত তফাজ্জল হোসেন সাপ্তাহিক ইত্তেফাক পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন এবং ১৯৫১ সালের ১৪ আগস্ট থেকে এই পত্রিকার পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মুসলিম লীগের ক্ষমতায় থাকাকালে দেশের বিরাজমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে এবং প্রথম সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে তফাজ্জল হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর উৎসাহ, অনুপ্রেরণা, সহযোগিতায় ও মওলানা ভাসানীর পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৫৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর ইত্তেফাককে দৈনিক পত্রিকা হিসেবে প্রকাশ করেন। তফাজ্জল হোসেন এই পত্রিকার সম্পাদক। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে তৎকালীন ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের যে ভরাডুবি হয়—এর পেছনে ছিল দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার শক্তিশালী রিপোর্ট ও মানিক মিয়ার ক্ষুরধার লেখনি।

মানিক মিয়ার মানস দর্পণ ছিল যেন ইত্তেফাকের প্রতিটি পৃষ্ঠা। নীতির প্রশ্নে, বাংলার মানুষের অধিকারের বিষয়ে তিনি কখনো আপস করেননি। দৈনিক ইত্তেফাক ছিল তার সেই সংগ্রামী জীবনের প্রধান হাতিয়ার। ‘রাজনৈতিক ধোঁকাবজি’, ‘রাজনৈতিক মঞ্চ’ আর ‘রঙ্গমঞ্চ’ শিরোনামে কলাম লিখে বাংলাদেশের মানুষকে স্বাধীনতাকামী করে তোলেন মানিক মিয়া। ‘মোসাফির’ ছদ্মনামে তার ‘রাজনৈতিক মঞ্চ’ কলামে নির্ভীক সত্য ভাষণ, অনন্য রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা এবং গণমানুষের প্রতি ভালোবাসার কারণেই বাংলার মানুষের হৃদয়ে তিনি অবিনশ্বর হয়ে রয়েছেন। মানিক মিয়া প্রচলিত অর্থে শুধুমাত্র একজন সাংবাদিক ছিলেন না। বরং সাংবাদিকতার মাধ্যমে মানুষের মুক্তির পথ রচনার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তার আপসহীন মনোভাবের কারণে প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তানি শাসকরা বারবার তার কণ্ঠকে স্তব্ধ করতে চেয়েছে। দৈনিক ইত্তেফাকের ওপর বারবার নেমে এসেছে চরম বিপর্যয়।

১৯৬৬ সালের ৬ নভেম্বর আওয়ামী লীগ ৬ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দাবি করে। দৈনিক মর্নিং নিউজ, দৈনিক পাকিস্তান ও দৈনিক আজাদ ৬ দফার বিরোধিতা করে। দৈনিক ইত্তেফাক ৬ দফার পক্ষে অবস্থান শুধু নয়, অন্যতম প্রচারকের ভূমিকা পালন করে। ১৬ জুন ১৯৬৬ ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন গ্রেফতার হন ও পরদিন পত্রিকাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এমনকি নিউ নেশন প্রেসও বন্ধ করে দেয়। প্রায় ১০ মাস পর ১৯৬৭ সালের ২৯ মার্চ মানিক মিয়া মুক্তি পান। এ সময় দৈনিক ইত্তেফাক প্রকাশ করার জন্য সম্পাদকের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু সম্পাদক সাফ জানিয়ে দেন, ‘ইত্তেফাক যদি তার ঐতিহ্য অনুসরণ করে প্রকাশিত হতে না পারে তবে তিনি সে ইত্তেফাক প্রকাশে আগ্রহী নন।’ সরকার সে দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। অবশেষে প্রেস মুক্ত হয়। ইত্তেফাক পুনর্জন্ম লাভ করে। ১৯৬৯ সালে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া আকস্মিকভাবে ইন্তেকাল করেন। তার মৃত্যুর পর ইত্তেফাক প্রকাশনা অব্যাহত থাকে এবং বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ও স্বাধীনতা আন্দোলনে সরাসরি সমর্থন দেয় ও সম্পাদকীয় সচিত্র প্রতিবেদন, ফিচার প্রকাশপূর্বক নানাভাবে সমর্থন দেয়, গড়ে ওঠে জনমত। বিশেষ করে ১৯৭০ সালের নির্বাচন, আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানিদের অনীহা ও ষড়যন্ত্র এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ ও সর্বাত্মক অসহযোগের আহ্বান থেকে ২৫ মার্চ রাতে আক্রান্ত হবার পূর্ব পর্যন্ত দৈনিক ইত্তেফাক অনন্য সাধারণ ও গৌরবময় ভূমিকা পালন করে।

মহান মুক্তিযুদ্ধে ২৫ মার্চ রাতে দৈনিক ইত্তেফাক ভবন পুড়িয়ে দেওয়া হয়। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা অন্যান্য স্থাপনার সঙ্গে দৈনিক ইত্তেফাককেও নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল কিন্তু মানুষের ভালোবাসায় বারবার ধ্বংসস্তূপ থেকে মাথা উঁচু করে উঠে দাঁড়িয়েছে দৈনিক ইত্তেফাক।