কলাম : আশা করছি ‘ব্যাকগ্রাউন্ড ওয়ার্ক’ করেই জেআরসি বৈঠক হচ্ছে।

কলাম : আশা করছি ‘ব্যাকগ্রাউন্ড ওয়ার্ক’ করেই জেআরসি বৈঠক হচ্ছে।

প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক : আগামীকাল ২৫ আগস্ট ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে জেআরসি তথা যৌথ নদী কমিশনের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এর আগে দু দিন ধরে চলেছে সচিব পর্যায়ের বৈঠক। এ বৈঠক ঘিরে ঢাকার সংবাদমাধ্যমে এক ধরনের উৎসাহ-উদ্দীপনা লক্ষ্য করা গেছে। আমার প্রশ্ন, আসলেই এতোটা উৎসাহিত হওয়ার কারণ রয়েছে কি?

এটা ঠিক, দীর্ঘ ১২ বছর পরে যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ফলে একদিক থেকে আনন্দিত হওয়ার কারণ রয়েছে বৈকি। কারণ, আলোচনার টেবিলে বসলে অনেক প্রশ্নের মীমাংসা সহজ হয়। 

এ ছাড়া ২০১০ সালে ৩৭তম বৈঠকটি হওয়ার পর আর বৈঠক অনুষ্ঠানই সম্ভব হচ্ছিলো না; দুই দেশের মধ্যকার অমীমাংসিত ইস্যুগুলোর আলোচনা দূরে থাক। আমাদের মনে আছে, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে একেবারে শেষ মুহূর্তে যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকটি স্থগিত হয়ে গিয়েছিলো।

যৌথ নদী কমিশনের বিধি অনুযায়ী, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বছরে অন্তত চারটি বৈঠক হওয়ার কথা। কিন্তু এক যুগ ধরে একটি বৈঠক করাও সম্ভব হচ্ছিলো না। অবশ্য শুরু থেকেই এ ধরনের বৈঠকের ব্যাপারে ভারতের অনাগ্রহ পরিলক্ষিত হয়েছে। আবার বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও যে খুব জোর দাবি এসেছে, তা-ও সব সময় দেখা যায় নি। শোনা যায়, ২০১৯ সালের বৈঠকটি স্থগিত হয়েছিলো মূলত দুই দেশের দিক থেকে ‘ব্যাকগ্রাউন্ড ওয়ার্ক’ সংক্রান্ত প্রস্তুতিহীনতার কারণে। দেরিতে হলেও জেআরসির বৈঠকটি যেহেতু হচ্ছে, আমি আশা করব- উভয় দেশই অভিন্ন নদী-সংক্রান্ত অমীমাংসিত বিষয়গুলোর দ্রুত ও ন্যায্য মীমাংসায় উদ্যোগী হবে।

অন্য যতো ইস্যুই থাকুক, ভুলে যাওয়া চলবে না, ১৯৭২ সালে যৌথ নদী কমিশন গঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিলো অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে দুই দেশের মধ্যে অভিন্ন নদী নিয়ে আলোচনাও কম হয় নি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশ তাঁর পাওনা ভালোভাবে বুঝে নিতে পারে নি বা ভারত তাঁর বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশীকে পানির ন্যায্য হিস্যা বুঝে দিতে কার্পণ্য করেছে। এর ফলে ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশ দশকের পর দশক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে চলেছে।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৫৪টি অভিন্ন নদী রয়েছে। এর মধ্যে শুধু গঙ্গা ও ফেনী নদী নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। অবশ্য ফেনী চুক্তি এখনও অনুস্বাক্ষরিত হয় নি। আর ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তির মেয়াদ ২০২৬ সালে শেষ হয়ে যাবে। এবারের বৈঠকে বাংলাদেশের দিক থেকে প্রধান এজেন্ডা হওয়া উচিত গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তির নবায়ন প্রক্রিয়া। 

এ ছাড়া তিস্তার পানি বণ্টন-সংক্রান্ত চুক্তির চূড়ান্ত খসড়াও এক দশকের বেশি সময় ধরে ঝুলিয়ে রেখেছে ভারত। এটারও সুরাহা চাওয়া উচিত বাংলাদেশের পক্ষে।

সংবাদমাধ্যমে দেখছি, কুশিয়ারা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা হবে। 

এ ছাড়া আরও ছয়টি নদী- ধরলা, দুধকুমার, মনু, খোয়াই, মুহুরী, গোমতীর পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা হবে। এসব নদী নিয়ে আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ বটে। কিন্তু বাংলাদেশের অগ্রাধিকার এজেন্ডা হওয়া উচিত গঙ্গা ও তিস্তা। আরেকটি বৃহত্তম অভিন্ন নদী ব্রহ্মপুত্র ইস্যুও আলোচনার টেবিলে আনার এটাই সময়।

এতোদিন পর অনুষ্ঠিতব্য জেআরসি বৈঠকে যাঁরা বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই বিষয়গুলো সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। আমরা দুই দেশের পক্ষ থেকে জাতিসংঘ পানি প্রবাহ সনদ স্বাক্ষরের দাবিও তুলতে পারি। তাহলে অভিন্ন নদীর বিরোধ মীমাংসা সহজ হবে। 

এ ছাড়া বাংলাদেশপক্ষ অভিন্ন নদীগুলোর যৌথ পরিদর্শনের প্রস্তাব দিতে পারে। উভয় দেশের প্রতিনিধিরা একসঙ্গে পরিদর্শনে গেলে নদীগুলোর বিদ্যমান করুণ পরিস্থিতি বিষয়ে ভালো সিদ্ধান্ত পাওয়া যেতে পারে।

লেখক : পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ এবং পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক।