ডলার সঙ্কটেও বাজেটের আগে বিলাসপণ্য গাড়ি আমদানির হিড়িক!

ডলার সঙ্কটেও বাজেটের আগে বিলাসপণ্য গাড়ি আমদানির হিড়িক!

নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলার কাগজ : ডলার সঙ্কটে যখন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি ব্যয় মিটাতে হিমশিম অবস্থা, এমন সময়েও থেমে নেই বিলাসজাতীয় পণ্য- গাড়ির আমদানি। চলতি মে মাসেই জাপান থেকে দুটি জাহাজে আমদানি হয়েছে ২ হাজার ৬৪১টি গাড়ি; যা চলতি অর্থবছরের মধ্যে মাস হিসেবে সর্বোচ্চ গাড়ি আমদানির রেকর্ড।

কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, এসব গাড়ির মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ১ হাজার ৯টি এবং মোংলা বন্দর দিয়ে ১ হাজার ৬৩২টি আমদানি হয়েছে।

শুধু তাই নয়, অর্থবছরের শেষ মাস জুনের মাঝামাঝি সময়ে আরো আট শতাধিক গাড়ি আমদানি করা হবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিক্যালস ইমপোর্টার্স অ্যান্ড ডিলার অ্যাসোসিয়েশন (বারভিডা)।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডলার সঙ্কটে এখন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি ব্যয় মেটানোও সঙ্কটে রয়েছে। গত বছরের ৪ জুলাই বিলাস পণ্য আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এমন পরিস্থিতিতে বিলাস পণ্যের মধ্যে অন্যতম গাড়ি আমদানির এমন চিত্র অর্থনৈতিক অবস্থাকে আরো শঙ্কায় ফেলবে।

বারভিডার মহাসচিব শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘দেশের সঙ্কটময় মুহূর্তে বিলাসজাতীয় পণ্য আমদানিতে সরকারের সিদ্ধান্তকে আমরাও সমর্থন করি। তবে দেশে গাড়ির চাহিদা আছে। সেই তুলনায় আমরা গাড়ি আমদানি করতে পারছি না।’

তিনি আরও বলেন, অর্থবছরের শুরুর দিকে গাড়ি আমদানি অনেক কমে যায়। গত নভেম্বরে আমদানির অপেক্ষায় থাকা অনেকগুলো গাড়ি একসঙ্গে এসেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে গাড়ি আমদানি বেড়ে যায় ক্যালেন্ডার ইয়ার এবং ফিসক্যাল ইয়ারের শেষের দিকে। ফিসক্যাল ইয়ার বা অর্থবছরের শেষে গাড়ির আমদানি শুল্ক বেড়ে যাবে এমন আশংকা থেকে গাড়ি আমদানি বেশি হয়। 

বারভিডার তথ্যমতে, স্বাভাবিক সময়ে প্রতি মাসে গড়ে ২ হাজার গাড়ি আমদানি হয়। 

বাংলাদেশে আমদানি হওয়া গাড়ির প্রায় ৭৫ শতাংশ রিকন্ডিশনড বা পুরাতন গাড়ি। ১ থেকে ৫ বছরের পুরোনো এসব গাড়ি আমদানি খাতে কাস্টমসের শুল্ক বাবদ আয় হয় প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। আমদানির বাকি ২৫ শতাংশ গাড়িগুলো ‘ব্র্যান্ড নিউ’। 

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে মে পর্যন্ত ১১ মাসে ১৭ হাজার ৫০৯টি গাড়ি আমদানি হয়েছে। এসব গাড়ি আমদানির পেছনে খরচ হয়েছে প্রায় ১৭ কোটি ৫০ লাখ ৯০ হাজার ডলার। গত অর্থবছর গাড়ি আমদানি হয়েছিল প্রায় ২৩ হাজার।

বাড়ছে শঙ্কা :
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ‘বিলাস পণ্য আমদানিকে সরকার নিরুৎসাহিত করছে। এমন সময়ে কিছুদিন গাড়ি আমদানি না করলেও তেমন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। সঙ্কটময় মুহূর্তেও হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে গাড়ি আমদানি করতেই হবে এমন আবশ্যকতা নিশ্চয়ই তৈরী হয়নি। তাছাড়া আমাদের দেশেও এখন গাড়ি এসেম্বলিং হচ্ছে। প্রয়োজন হলে এসব গাড়িও নিতে পারে গ্রাহকরা।’

তিনি আরও বলেন, ডলার সঙ্কট কমাতে বিলাস পণ্য আমদানি না করে ব্যয় সঙ্কোচন করা উচিত। সঙ্কটকালীন সময়ে বিলাসী গাড়ি আমদানি করা কোনভাবেই সমীচীন নয়।

এদিকে একাধিক ভোগ্যপণ্যের আমদানিকারকের সাথে কথা বলে জানা যায়, এলসি সংক্রান্ত জটিলতায় ভোগ্যপণ্য আমদানি করার পরও জাহাজ থেকে পণ্য খালাসে জটিলতায় পড়তে হচ্ছে তাদের। বন্দরে জাহাজ আসার পরও ব্যাংক এলসি মূল্য পরিশোধ করতে না পারায় জাহাজ থেকে পণ্য খালাস শুরু করতে কোন কোন ক্ষেত্রে সময় লাগছে এক মাসেরও বেশি।

দেশের প্রায় সকল ভোগ্যপণ্য আমদানিকারকের ক্ষেত্রেই ঘটেছে এমন ঘটনা। এর ফলে জাহাজের ভাড়া বৃদ্ধি পেয়ে বেড়ে যাচ্ছে পণ্যের মূল্য। বাড়তি এই মূল্যের বোঝা উঠছে ক্রেতার উপর।

বৃহৎ ভোগ্যপণ্যের আমদানিকারক আবদুল মোনেম লিমিটেডের হেড অব কমার্শিয়াল আজিজ চৌধুরী বলেন, ‘ডলার ক্রাইসিসের কারণে ভোগ্যপণ্যের আমদানি ব্যয় পরিশোধে আমাদের নানা সঙ্কট মোকাবিলা করতে হচ্ছে। প্রথমত ডলার সঙ্কটের কারণে আমরা বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো থেকে পণ্যের চাহিদা এবং সময়মতো এলসি খুলতে পারছি না। অন্যদিকে বাংলাদেশের এলসিগুলো বিশ্বের অনেক ব্যাংক ফাইন্যান্স করতে চায় না। এর ফলে পণ্য আমদানি করে জাহাজ থেকে খালাসের ক্ষেত্রে জটিলতায় পড়তে হচ্ছে।’

মোংলা দিয়েই ৬০ শতাংশ গাড়ি আমদানি :
বর্তমানে দেশের ৬০ শতাংশ গাড়ি আমদানি করা হয় মোংলা বন্দর দিয়ে। ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের প্রধান দুটি সমুদ্রবন্দরের মাধ্যমে গাড়ি আমদানি হয়েছে ৩৪ হাজার ৭৮৩টি। এর মধ্যে মোংলা বন্দরের মাধ্যমে এসেছিল ২০ হাজার ৮০৮ এবং চট্টগ্রাম বন্দরে ১৩ হাজার ৯১৩টি।

২০২১-২২ অর্থবছরে মোংলা কাস্টমসের মোট আয়ের শতকরা ৫২ শতাংশ এসেছিল গাড়ি আমদানির শুল্ক থেকে।

মোংলা কাস্টমস হাউসের যুগ্ম কমিশনার মাহফুজ আহমেদ বলেন, ‘গাড়ি আমদানি কমায় এই অর্থবছরের মোংলা কাস্টমসের ৪০০ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় কম হয়েছে।’

তা ছাড়া গাড়ি আমদানিতে এলসি খোলা আগের মতো সহজলভ্য নয় বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিক্যালস ইমপোর্টার্স অ্যান্ড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বারভিডা) মোংলা বন্দরের স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান আহসানুর রহমান আরজু।

তিনি বলেন, ‘ব্যাংক এখনো গাড়ি আমদানির এলসি খোলার জন্য নানা রকমের টালবাহানা করছে। এখনো ডলার রেট বাংলাদেশি ১০৮ টাকা। তবে আমাদের এলসি খুলতে হচ্ছে ১২০ টাকা ডলার রেটে। তাও ব্যাংকের সাথে ভালো সম্পর্ক না থাকলে তা সম্ভব হচ্ছে না।’

গাড়ির ব্যবসা এখনো পুরোপুরি চাঙ্গা হয় নি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর প্রতি মাসে ৩ থেকে ৪টি জাহাজ গাড়ি নিয়ে মোংলা বন্দরে আসতো। তবে এ অর্থবছর মাসে একটি বা দুটির বেশি জাহাজ আসছে না। এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে আমাদের আরও কিছু সময় লাগবে।’

এই অর্থবছরে গাড়ির ব্যবসা ভয়াবহ সময় অতিক্রম করছে বলে মন্তব্য করেছেন বারভিডার সভাপতি হাবিবুল্লাহ ডন। তিনি বলেন, ‘গত বছরের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ডলারের ভয়াবহ সঙ্কট ছিলো। তাই গাড়ির ব্যবসায়ও ভয়াবহ সময় অতিক্রম করেছে। জানুয়ারি মাসের পরে কিছু ডলার ছেড়েছে। এরপরে এলসি দেওয়ার সুবাদে ধারাবাহিকভাবে এই গাড়ি আমদানি করা হচ্ছে। ডলার আরও ছাড়লে গাড়ি আমদানি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।’ হাবিবুল্লাহ ডন আরও বলেন, ‘গাড়ির আমদানির জন্য বছরে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব পেত সরকার। তবে এই বছর আমদানিতে ভাটা পড়ায় ৫০ শতাংশ রাজস্ব কম পেয়েছে কাস্টমস।’