ধনাঢ্য পরিবারের নারীদের ‘টার্গেট’ করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়েছেন তিনি

ধনাঢ্য পরিবারের নারীদের ‘টার্গেট’ করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়েছেন তিনি

নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলার কাগজ : ফেসবুকে নওরিন আক্তারের (ছদ্মনাম) সঙ্গে পরিচয় হয় এক যুবকের। তিনি তাঁর নাম ‘মাসুম বিল্লাহ ফারদিন’ বলেন। নিজেকে গাজীপুরের এক সাবেক সংসদ সদস্যের ছেলে বলে পরিচয় দেন। ফেসবুকে কয়েক মাস কথা বলার পর যুবকের সঙ্গে দেখা করেন নওরিন।

নওরিনের সঙ্গে বাইরে ঘোরাঘুরির সময় অসহায় ব্যক্তিদের অনেক টাকা দান করতেন যুবক। একদিন তিনি নিজেকে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক পরিচয় দিয়ে নওরিনকে একটি অনুষ্ঠানে নিয়ে যান। অনুষ্ঠানে ভালো কাজের স্বীকৃতি হিসেবে যুবককে পুরস্কৃত করা হয়। এসব দেখে যুবকের প্রতি আকৃষ্ট হন নওরিন। তাঁদের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক শুরু হয়।

গত বুধবার (১১ জানুয়ারি) রাজধানীর গুলশান এলাকা থেকে যুবককে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ (উত্তর) তাঁকে গ্রেপ্তারের পর তাঁর প্রতারণার নানান তথ্য সামনে আসে।

ডিবি বলছে, ভুয়া নাম-পরিচয় দিয়ে এই যুবক প্রায় অর্ধশতাধিক নারীর সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। তাঁর আসল নাম রাজুউল্যা রাজু (৩৭)। তিনি প্রতারণার মাধ্যমে প্রায় অর্ধশত নারীর কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন।

গ্রেপ্তারের খবর পেয়ে রাজধানীর মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে যান নওরিন। তিনি বলেন, ‘ডিবির হাতে গ্রেপ্তারের পর আমি জানতে পারি, ভুয়া পরিচয় দিয়ে তিনি (রাজু) নারীদের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিলেন। প্রতারণা করতে তিনি কখনো নিজেকে কখনো সংসদ সদস্যের পুত্র, আবার কখনো মন্ত্রী ও পুলিশের পদস্থ কর্মকর্তার ভাই হিসেবে পরিচয় দিতেন।’

ডিবি বলছে, সম্প্রতি ফেসবুকে ঢাকার কলাবাগান এলাকার এক নারীর সঙ্গে পরিচয় হয় রাজুর। তিনি একপর্যায়ে ওই নারীর স্বামীকে জাপানে পাঠানোর প্রস্তাব দেন। এ জন্য ১৯ লাখ টাকা নেন রাজু। পরে ওই নারী প্রতারিত হওয়ার বিষয়টি বুঝতে পারেন। পরে নারীর স্বামী বাদী হয়ে রাজধানীর কলাবাগান থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কলাবাগান এলাকার ভুক্তভোগী নারী বলেন, ‘ফেসবুকে পরিচয় হওয়ার পর তিনি (রাজু) আমাকে বোন বানান। একপর্যায়ে আমার স্বামীকে জাইকার একটি প্রকল্পের আওতায় জাপানে পাঠানোর কথা বলে আমাদের কাছ থেকে ১৯ লাখ টাকা নেন তিনি।’

অভিযোগের বিষয়ে ডিবির সাইবার বিভাগ অনুসন্ধান শুরু করে। অনুসন্ধানে রাজুর প্রতারণার প্রমাণ মেলে। ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার আশরাফউল্লাহের নেতৃত্বে গত বুধবার গুলশান এলাকায় অভিযান চালিয়ে রাজুকে গ্রেপ্তার করা হয়।

ডিবি বলছে, রাজু ২০ বছরের বেশি সময় ধরে প্রতারণা করে আসছিলেন। তিনি বিভিন্ন পরিচয় ব্যবহার করতেন। টাকাপয়সা আছে—এমন নারীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতেন। তিনি সরকারি চাকরি দেওয়া, বদলি ও বিদেশে পাঠানোর কথা বলে লোকজনের কাছ থেকে বিপুল টাকা হাতিয়েছেন। গ্রেপ্তারের পর তাঁকে প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, তিনি প্রতারণার মাধ্যমে প্রায় অর্ধশত নারীর কাছ থেকে ৫০ কোটি টাকা হাতিয়েছেন।

ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ সূত্র বলেছে, প্রতারণার জন্য রাজু সমাজের ধনাঢ্য পরিবারের নারীদের টার্গেট করতেন। ফেসবুকে তাঁর চার লাখের মতো অনুসারী। তিনি ফেসবুকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে তোলা ছবি দিতেন। এসব ছবি দেখে তাঁর নিশানায় থাকা নারীরা তাঁকে বিশ্বাস করতেন। এভাবেই তিনি সম্পর্ক গড়ে প্রতারণা করতেন। রাজু দাবি করতেন, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে পড়েছেন। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন। তিনি আমেরিকার গ্রিন কার্ডধারী। তিনি নীলক্ষেত থেকে গ্রিন কার্ডসহ ২১টি প্রতিষ্ঠানের পরিচয়পত্র বানিয়েছিলেন।

ডিএমপির ডিবির প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর-রশীদ বলেন, ‘রাজুউল্যা ভুয়া পরিচয় দিতেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়ে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তুলতেন। পরে এসব ছবি দেখিয়ে প্রতারণা করতেন।’

কৈশোর থেকেই প্রতারণা :
রাজুর বয়স যখন আড়াই বছর, তখন তাকে দত্তক নেন রাজধানীর হাজারীবাগ এলাকার এক নিঃসন্তান দম্পতি। এই দম্পতির কাছে থেকে এসএসসি পাস করেন তিনি। রাজু গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাঁর দত্তক মাকে ডিবি কার্যালয়ে ডাকা হয়। তাঁর সঙ্গে রাজুর বিষয়ে কথা বলেন ডিবির কর্মকর্তারা।

ডিবি জানতে পারে, নানা অপরাধে জড়িয়ে কৈশোরে এই নিঃসন্তান দম্পতির ঘর ছাড়েন রাজু। বাড়ি ছাড়ার পর তিনি কিছুদিন গান শেখেন। পাশাপাশি ভুয়া পরিচয়ে শুরু করেন প্রতারণা।

ডিবির পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সরকারি চাকরিজীবী পরিচয়ে প্রতারণার সময় ২০১৩ সালে নওগাঁ সদর থানা-পুলিশ রাজুকে গ্রেপ্তার করে। আরেকটি প্রতারণার মামলায় সিরাজগঞ্জেও গ্রেপ্তার হয়েছিলেন রাজু।

প্রতারণা করতে তিনি নিজের নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘মাসুম বিল্লাহ ফারদিন’। এই নামে ভুয়া পরিচয়পত্রও সংগ্রহ করেন তিনি। একই নামে তিনি কোনও কোনও বেসরকারি টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন। এমনকি টেলিভিশনে ইংরেজিতে গানও গেয়েছেন।

রাজুকে দত্তক নেওয়া নারীর সঙ্গে ডিবি কার্যালয়ে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই নারী বলেন, ‘আমাদের সন্তান হয় নি। বড় আশা করে রাজুকে দত্তক নিয়েছিলাম। নিজেদের সন্তান হিসেবে লালন-পালন করছিলাম। এসএসসির পর তাকে একটি কলেজে ভর্তি করেছিলাম। কিন্তু রাজু বাসা থেকে চলে যায়। সে যে পরবর্তী সময় এত বড় প্রতারক হয়ে উঠেছে, তা আমাদের জানা ছিলো না।’