প্রভাবশালীদের চাপে পরাজিত সেই তরুণী

প্রভাবশালীদের চাপে পরাজিত সেই তরুণী

নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলার কাগজ : প্রভাবশালীদের চাপের কাছে ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া তরুণী নতি স্বীকার করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য গাজী এজাজ আহমেদের বিরুদ্ধে তিনি এ অভিযোগ এনেছিলেন। এজন্য খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং জবানবন্দিও দেন। কিন্তু ছাড়পত্র নিয়ে হাসপাতালের বাইরে গেলে তাঁর মাসহ তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পরই পাল্টে গেছে বক্তব্য। পুলিশ বলছে, বিষয়টি তদন্ত করে দেখছে তাঁরা।

ডুমুরিয়ার এক তরুণী ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে গত শনিবার (২৭ জানুয়ারি) রাতে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি হন। পরদিন বিকেলে ছাড়পত্র নিয়ে বাইরে গেলে দুর্বৃত্তরা তাঁকে জোর করে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। অপহরণের অভিযোগে ডুমুরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যানের ভাই রুদাঘরা ইউপি চেয়ারম্যান তৌহিদুজ্জামানকে ঘটনাস্থল থেকে আটক করে সোনাডাঙ্গা থানা পুলিশ। অপহরণের কয়েক ঘণ্টা পর ছেড়ে দেওয়া হয় ওই তরুণী ও তাঁর মাকে।

এর পর সোনাডাঙ্গা থানা পুলিশ তাদের ডাকলে যশোরের কেশবপুর থেকে রোববার রাত ১১টার দিকে থানায় যান তাঁরা। থানায় বসে ধর্ষণ ও অপহরণের অভিযোগ অস্বীকার করেন ওই তরুণী। যদি নির্যাতনের শিকার না হন, তাহলে ওসিসিতে ভর্তি হলেন কেন– এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, কী থেকে কী হয়েছে– তা আমি বলতে পারি না। আমি এখন অসুস্থ, সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত কোনও কথাবার্তা বলতে পারব না।

তিনি বলেন, আমাকে কেউ অপহরণ করে নি। আমি গাড়িতে করে যশোরের কেশবপুরে এক আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়েছিলাম। 

তবে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে ভিন্ন চিত্র। ওসিসির দায়িত্বে থাকা খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. সুমন রায় বলেন, ওই তরুণী শনিবার রাতে ভর্তি হওয়ার পর ওসিসিতে তাঁর অভিযোগ লিপিবদ্ধ করা হয়। বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে তাঁর সঙ্গে বারবার শারীরিক সম্পর্ক করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। এর পর তাঁকে গাইনি ওয়ার্ডে পাঠানো হয়। সেখানে তাঁর শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। তাঁর যে সোয়াব (শ্লেষ্মা) সংগ্রহ করা হয়েছিল, তা পরদিন ওসিসিতে মাইক্রো বায়োলজিক্যাল পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। তাঁর পরিহিত পায়জামাসহ কিছু জিনিস ডিএনএ প্রোফাইলিংয়ের জন্য সংরক্ষণ এবং বয়স নির্ধারণের জন্য এক্স-রে করা হয়। 

ওই কর্মকর্তা জানান, রোববার ডুমুরিয়া থানার ওসি  ওসিসিতে এসে তাঁর জবানবন্দি রেকর্ড করেন। বিকেলে তাঁকে ছাড়পত্র দিয়ে তাঁর মা ও মামার জিম্মায় দেওয়া হয়।

ডা. সুমন জানান, মাইক্রো বায়োলজিক্যাল রিপোর্ট পেতে এক সপ্তাহ থেকে ১০ দিন সময় লাগবে। ডিএনএ নমুনা পরীক্ষার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। ফলাফল পেতে এক মাস বা দুই মাস সময় লাগতে পারে।    

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, মেয়েটি মানসিক ভারসাম্যহীন– এ রকম আমাদের কাছে মনে হয় নি। আমাদের কাছে তাঁকে স্বাভাবিক মনে হয়েছে।
এদিকে, গত রোববার বিকেলে ওসিসি থেকে ওই তরুণী ও তাঁর মাকে যখন জোর করে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন সেখানে বেশ কয়েকজন মানবাধিকবার কর্মী ও সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন। এ সময় সেখানে উপস্থিত থাকা মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার খুলনার সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট মোমিনুল ইসলাম বলেন, মেডিকেলের মধ্যে মানুষের সামনে থেকে ভুক্তভোগী নারীকে অপহরণ করার ঘটনা নজিরবিহীন। তাঁকে ভয়ভীতি দেখিয়ে কিংবা অন্য কোনও প্রলোভন দিয়ে ম্যানেজ করা হয়েছে। মেয়েটিকে ভয় দেখানোর কারণে তিনি এখন মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না।

তিনি আরও বলেন, প্রভাবশালীরা মূল ঘটনাটিকে অন্যদিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। প্রশাসনের উচিত, বিষয়টিকে নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করে দেখা। মেয়েটিকে সেফ কাস্টডিতে রেখে কাউন্সেলিং করে মানসিকভাবে চাঙ্গা করে তাঁর বক্তব্য নেওয়া প্রয়োজন।

তবে এ ব্যাপারে ডুমুরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান গাজী এজাজ আহমেদ বলেন, আমি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার। মেয়েটিকে আমি চিনি না। যতটুকু খোঁজ নিয়ে দেখেছি, মেয়েটি হাবাগোবা টাইপের। উপজেলা পরিষদ নির্বাচন সামনে রেখে আমার প্রতিপক্ষ তাঁকে দিয়ে ধর্ষণের মিথ্যা অভিযোগ করিয়েছে। মেয়েটিকে কেউ অপহরণ করেনি। তারা নিজেরাই গাড়িতে করে চলে যায়। 

সোনাডাঙ্গা থানার ওসি (তদন্ত) আমিরুল ইসলাম জানান, অপহরণ করার অভিযোগে ডুমুরিয়ার রুদাঘরা ইউপি চেয়ারম্যান তোহিদুজ্জামানকে আটক করা হয়েছিলো। ভুক্তভোগীর কোনও অভিযোগ না থাকায় রোববার গভীর রাতে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

এ ব্যাপারে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার সরদার রকিবুল ইসলাম বলেন, মেয়েটি অপহরণ কিংবা নির্যাতিত হয়েছিলেন কিনা, তা পুলিশ গভীরভাবে তদন্ত করে দেখছে। যদি নির্যাতিত হয়ে থাকেন, তাহলে অবশ্যই আমরা তাঁকে আইনগত সহায়তা দেব।

ডুমুরিয়া থানার ওসি সুকান্ত সাহা জানান, ধর্ষণ কিংবা অপহরণের অভিযোগে ওই তরুণী কোনও মামলা করেন নি। কিংবা অন্য কেউও থানায় এ সংক্রান্ত কোনও অভিযোগ দেন নি।