বিজয়ের ৫১ বছরে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা

বিজয়ের ৫১ বছরে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা

ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ :: বিশ্বের অনেক দেশ এখনো পর্যন্ত করোনার সংক্রমণ রোধে টিকাদান কার্যক্রম শুরু করতে না পারলেও বাংলাদেশে ইতিমধ্যে বিনামূল্যে প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষের টিকাদান সম্পন্ন হয়েছে।

দেখতে দেখতে হাঁটিহাঁটি পা পা করে, অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে ইতিমধ্যে আমরা অতিক্রম করেছি সুদীর্ঘ ৫১টি বছর। বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটেছে। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন নীতিসংক্রান্ত কমিটি বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে আজকের এই উত্তরণ, যেখানে রয়েছে এক বন্ধুর পথ পাড়ি দেওয়ার ইতিহাস। এটি সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী ও দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে। তাঁর সাহসী ও গতিশীল উন্নয়ন কৌশল গ্রহণের ফলে সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কাঠামোগত রূপান্তর এবং উল্লেখযোগ্য সামাজিক অগ্রগতির মাধ্যমে বাংলাদেশকে দ্রুত উন্নয়নের পথে নিয়ে এসেছে।

শেখ হাসিনার সরকার উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছে। পদ্মা সেতু, সমুদ্র বিজয় এবং মহাকাশ বিজয় তো পুরো জাতির সামনে দৃশ্যমান। কিন্তু এমন অনেক কাজ আছে, যা মানুষের চোখের আড়ালে রয়ে গেছে, যার সুযোগ-সুবিধা মানুষ পাচ্ছে। এই সুযোগ-সুবিধার কারণটা মানুষ সঠিকভাবে জানেও না, জানতে চেষ্টাও করে না। তেমনি একটা ক্ষেত্র হলো স্বাস্থ্য খাত।

বিশাল এই জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ মোটেও সহজ কথা নয়। অনেকেই বিদেশের চিকিৎসাব্যবস্থার সঙ্গে আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থার তুলনা করেন। আমাদের দেশের জনসংখ্যা এবং আমাদের আর্থিক সক্ষমতা তাঁরা মাথায় রাখেন না। ডাক্তার-রোগী, ডাক্তার-নার্সের আনুপাতিক হারের বিষয়টি মাথায় রাখেন না। বর্তমান সরকারের স্বাস্থ্য খাতে অন্যতম পদক্ষেপ হলো কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন। ১৯৯৬ সালে প্রথমবার ক্ষমতায় এসে এই কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্প শেখ হাসিনার সরকার গ্রহণ করে এবং প্রায় ১০ হাজার ক্লিনিক স্থাপন করেছিল। ২০০১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এসে কমিউনিটি ক্লিনিকের মতো জনবান্ধব মানবিক উদ্যোগকে শুধু রাজনৈতিক রোষে বন্ধ করে দিয়েছিল। বর্তমানে দেশে প্রায় ১৮ হাজার ৫০০ কমিউনিটি ক্লিনিক চালু আছে। কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে দেশব্যাপী বিস্তৃত স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

বিভিন্ন অনলাইন জরিপ ও বিবিএসের তথ্য অনুসারে কমিউনিটি ক্লিনিকের ৯০ শতাংশের বেশি গ্রাহক তাদের পরিষেবা ও সুবিধার ক্ষেত্রে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে শয্যাসংখ্যার পাশাপাশি বাড়ানো হয়েছে সুযোগ-সুবিধা। ১১৩টি মেডিক্যাল কলেজসহ স্থাপন করা হয়েছে পাঁচটি মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।

এ ছাড়া হৃদরোগ, কিডনি, লিভার, ক্যানসার, নিউরো, চক্ষু, বার্ন, নাক-কান-গলাসহ বিভিন্ন বিশেষায়িত ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, অব্যাহত নার্সের চাহিদা মেটাতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে নার্সিং ইনস্টিটিউট। প্রতিটি জেলায় কমপক্ষে একটি করে মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপন করার কাজ চলছে। এ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৭ হাজার ৪২৭ জন এমডি, এমফিল, ডিপ্লোমা কোর্স সম্পন্ন করেছেন। সব মেডিক্যাল শিক্ষক উক্ত ডিগ্রিধারী। বিভাগীয় পদোন্নতি কমিটি (ডিপিসি) একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ, যার মাধ্যমে চিকিৎসকদের পদোন্নয়ন প্রক্রিয়া অনেক গতিশীল হয়েছে। ২০০৯ সালে আমি বিএমএর মহাসচিব থাকাকালীন এই ডিপিসি তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলাম, যার সুফল এখন সব চিকিৎসক পাচ্ছেন।

শিশুদের টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়ন সদস্যের জন্য বাংলাদেশ বিশ্বে অন্যতম আদর্শ দেশ হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। উপজেলা হাসপাতালকে উন্নীত করা হয়েছে ৫০ শয্যায়। মেডিক্যাল কলেজ ও জেলা হাসপাতালগুলোতেও শয্যাসংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের ডিজিটালাইজেশনের উন্নয়ন স্বাস্থ্য খাতকে উন্নত করছে। সব হাসপাতালে ইন্টারনেটের সংযোগ দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ই-গভর্ন্যান্স ও ই-টেন্ডারিং চালু করা হয়েছে। সরকারি হাসপাতালগুলোকে অটোমেশনের আওতায় আনা হচ্ছে। গোপালগঞ্জের শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব চক্ষু হাসপাতালকে কেন্দ্র করে অনলাইন সেবা কার্যক্রম চালু করতে ‘ভিশন সেন্টার’ স্থাপন করা হয়েছে।

বিশ্ব মহামারি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে ও মৃত্যু রোধে এখন পর্যন্ত সফলতার পরিচয় দিয়ে বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্বের অনেক দেশ এখন পর্যন্ত করোনার সংক্রমণ রোধে টিকাদান কার্যক্রম শুরু করতে না পারলেও বাংলাদেশে ইতিমধ্যে বিনা মূল্যে প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষের টিকাদান সম্পন্ন হয়েছে।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকনির্দেশনায় দেশে করোনা ভ্যাকসিন উৎপাদনের কাজ শুরু হয়েছে, যা দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা হবে। ২০১০ সালে প্রকাশিত ‘গুড হেলথ অ্যাট লো কস্ট : টোয়েন্টি ফাইভ ইয়ারস অন’ শীর্ষক বইয়ে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে অগ্রগতির যে কারণগুলো উল্লেখ করা হয়, তার মধ্যে ছিল বাংলাদেশের টিকাদান কর্মসূচি।

বিজয়ের ৫১ বছরে দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাত বিশ্বব্যাপী প্রশংসনীয় সফলতা অর্জন করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম খরচে মৌলিক চিকিৎসাচাহিদা পূরণ, সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল, অসংক্রামক রোগসমূহের ব্যবস্থাপনা ও প্রতিরোধে ব্যাপক উদ্যোগ, পুষ্টি উন্নয়ন, স্বাস্থ্য সূচকসমূহের ব্যাপক অগ্রগতিতে স্বাস্থ্য অবকাঠামো খাতে অভূতপূর্ব অর্জন বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়েছে বহু দূর।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে ১২ জানুয়ারি থেকে তাঁরই নেতৃত্বে ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে শুরু হয় যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনের নবযাত্রা। তখন আমাদের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ১০০-১৫০ মার্কিন ডলার। জিডিপি ছিল শূন্যের চেয়েও কম, অর্থাৎ ঋণাত্মক। উন্নয়নের প্রয়োজনীয় অবকাঠামো বলতে কিছুই ছিল না। সবকিছুই ছিল ভাঙা ও বিধ্বস্ত। শূন্যের ওপর দাঁড়িয়ে শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের পথচলা। বর্তমানে আমাদের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৮২৪ ডলার। বলার অপেক্ষা রাখে না, সব কটি খাতেই সর্বনিম্ন সূচক থেকে অনেক ওপরে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমাকে সরকারের  স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন দিক আর তার কিছু  উল্লেখযোগ্য উন্নতির চিত্র না বললেই  নয়। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ স্বাস্থ্যসেবার ওপর প্রভূত কাজ করেছে। সরকার সব জনগণ, বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মৌলিক স্বাস্থ্যসুবিধাসমূহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়নে কাজ করে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও প্রজনন স্বাস্থ্যসহ পরিবার পরিকল্পনার বর্তমান অবস্থা, বিশেষ করে নারী, শিশু ও প্রবীণদের অর্থনৈতিক মুক্তি এবং শারীরিক, সামাজিক, মানসিক ও আত্মিক সুস্থতার ক্ষেত্রে টেকসই উৎকর্ষ সাধনের লক্ষ্যে স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা খাত (এইচএনপি) সেক্টরের মূল লক্ষ্য। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি, জাতীয় খাদ্য ও পুষ্টিনীতি এবং জাতীয় জনসংখ্যানীতি বাস্তবায়িত হচ্ছে। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহ (এমডিজি) অর্জনের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে কিছু সূচক যেমন: শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস, শিশু ও মায়েদের টিকা দেওয়া, ভিটামিন ‘এ’র ঘাটতি দূরীকরণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে অসাধারণ অর্জন সাধিত হয়েছে। অন্যান্য সূচকে বাংলাদেশ পিছিয়ে থাকায় টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জনের জন্য সমন্বিত প্রয়াস গ্রহণ করতে হবে।

লেখক : ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ, উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়