শীতার্ত মানুষ কাঁপছে শীতবস্ত্র দরপত্রে

শীতার্ত মানুষ কাঁপছে শীতবস্ত্র দরপত্রে

ডেস্ক রিপোর্ট ও নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলার কাগজ ও ডন : কুয়াশায় ঢাকা সূর্য, শিরশির করে বইছে ঠাণ্ডা হাওয়া। পৌষের শেষার্ধে থার্মোমিটারের পারদ নেমে যাওয়ায় কাঁপছে রাজধানীসহ সারাদেশে। ঘন কুয়াশার কারণে বুধবার (৪ জানুয়ারি) বিকেল পর্যন্ত অধিকাংশ এলাকায় সূর্যের দেখা মেলে নি। আজ বৃহস্পতিবারও (৫ জানুয়ারি) সকাল থেকে একই অবস্থা। এক্ষেত্রে দিন ও রাতের তাপমাত্রার ব্যবধান কমে আসায় মাঝারি থেকে তীব্র শীত পুরো মাস অব্যাহত থাকার আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

তবে শীত মোকাবিলায় সরকারি উদ্যোগ থাকলেও আছে সমন্বয়হীনতা। যে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তাও অপ্রতুল। শীত জেঁকে বসলেও এখনও কেনা হয়নি কম্বল। অন্য বছরের মতো এবার বেসরকারি উদ্যোগও চোখে পড়ার মতো নয়। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, ঝড়-বৃষ্টি কিংবা বন্যা ঘিরে সরকারের বড় প্রস্তুতি থাকলেও শীত ঘিরে তা দেখা যায় না। ফলে আগাম প্রস্তুতির অভাবে শীতের কাঁপন শুরু হলেও অসহায় মানুষ পাচ্ছেন না পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র।

গতকাল মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে দেশের সর্বনিম্ন ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। রাজধানীতে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৪ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সারাদেশে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১০ থেকে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রয়েছে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, তাপমাত্রার চেয়ে শীত বেশি অনুভূত হওয়ার কারণ উত্তরের হিমেল বাতাস। দেশজুড়ে এমন বাতাস বইতে পারে আরও কয়েক দিন। তবে আজ বৃহস্পতিবার থেকে তাপমাত্রা বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এ মৌসুমে তাপমাত্রা ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসেও নামতে পারে বলে আগেই জানিয়েছিল আবহাওয়া অধিদপ্তর। এ অবস্থায় শীত মোকাবিলায় প্রস্তুতির ঘাটতি ছিল বলে মনে করেন সংশ্নিষ্টরা। এ বিষয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক আজিজুর রহমান বলেন, শীত কিংবা শৈত্যপ্রবাহকে দুর্যোগ হিসেবে ধরা না হলেও আমরা নিয়মিত আগাম তথ্য দিয়ে মানুষকে সতর্ক করছি। যখন কুয়াশার কারণে দৃষ্টিসীমা ১ হাজার মিটারের নিচে নেমে আসে, কুয়াশার তীব্রতা বেশি থাকে, তখন সাধারণত আমরা ফগ অ্যালার্ট জারি করে থাকি। এ ধরনের সতর্কবার্তার মাধ্যমে মূলত যানবাহন চলাচলে বিশেষ সতর্কতা নিতে বলা হয়। তিনি বলেন, আমরা বারবার সতর্ক করলেও শীত মোকাবিলার মতো প্রস্তুতি দেশের মানুষের থাকে না। এ কারণেই মানুষকে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

শীত ভোগালেও কেনা হয় নি কম্বল : 
কনকনে শীতে নিদারুণ কষ্টে থাকা গরিব অসহায়দের জন্য প্রতি বছর কম্বল কেনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর। এবার কম্বল কেনার জন্য গত ২৬ অক্টোবর দরপত্র আহ্বান করা হয়। অধিদপ্তরের পরিচালক (ত্রাণ) মো. নুরুল হক চৌধুরী স্বাক্ষরিত ওই দরপত্রে বলা হয়েছে, '২০২২-২৩ অর্থবছরে মন্ত্রণালয়ের বাজেট বরাদ্দের আওতায় কম্বল ক্রয়ের দরপত্র করা হয়েছে।' প্রায় দুই মাস কেটে গেলেও এখনও কম্বল কিনতে পারেনি অধিদপ্তর। এই কম্বল কিনতে দুই দফা রি-টেন্ডারও করা হয়। ঠিক কী কারণে কেনা হলো না এর কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেননি সংশ্নিষ্টরা। অধিদপ্তর কম্বল কিনতে ব্যর্থ হয়ে এখন টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছে জেলা প্রশাসকদের কাছে।

এ ব্যাপারে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের পরিচালক (ত্রাণ) মো. নুরুল হক চৌধুরী বলেন, ‘কম্বল কেনার প্রক্রিয়া চলছে। কত পিস কেনা হবে তা এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। অনেকগুলো প্যাকেজ আছে। ওয়ার্ক অর্ডার হয়ে গেছে।' শীত চলে আসার পরও কম্বল কিনতে এত দেরি কেন এ বিষয়ে এ কর্মকর্তা গতকাল সন্ধ্যায় বলেন, 'টেলিফোনে এত কিছু বলা যাবে না। সরাসরি এলে বুঝিয়ে দেব।’

এ ব্যাপারে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মিজানুর রহমান বিকেলে বলেন, ‘আমি আজই এখানে যোগ দিয়েছি। সব তথ্য এখন বলা যাবে না। আমি যতটুকু জানি বিভিন্ন জায়গায় বরাদ্দ পাঠানো হয়েছে। উত্তরাঞ্চলসহ যেসব এলাকায় শীত বেশি পড়ছে, সেসব এলাকায় ১০ হাজার পিস করে কম্বল চলে যাবে। আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নেবো।’

অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেখা গেছে, গত ২ জানুয়ারি থেকে ছয় জেলা প্রশাসকের কাছে শীতবস্ত্র কেনার জন্য টাকা পাঠানো হয়েছে। গতকাল পর্যন্ত চুয়াডাঙ্গা, পটুয়াখালী, ফেনী, খুলনা, নীলফামারী ও সাতক্ষীরায় ১০ লাখ টাকা করে পাঠানোর তথ্য পাওয়া গেছে।
এ ছাড়া এবার শীতে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণভান্ডার থেকে ৬৪ জেলায় ২৬ লাখ ৩৩ হাজার কম্বল পাঠানো হয়েছে।

সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি শীতার্ত মানুষকে সহায়তায় প্রতিবছর নানা সংগঠন, ব্যক্তি ও গোষ্ঠী এগিয়ে এলেও এবার তেমনটি দেখা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, করোনা, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ ও ডলার সংকটের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে দুর্বিপাক চলছে। মানুষের হাতে টাকা নেই। আগের মতো মানবিক সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসার সামর্থ্যও অনেকের নেই।

এদিকে সরকারি উদ্যোগে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হলেও তা পর্যাপ্ত নয়। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের ১০ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বরাদ্দের কম্বল ফেরত দিয়েছেন। চেয়ারম্যানরা জানান, অসহায় ও দরিদ্রদের জন্য শাহজাদপুরের ১৩ ইউনিয়নে ৩৫০ পিস করে কম্বল বরাদ্দ দেওয়া হয়। কম্বল ফেরতের বিষয়ে গালা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল বাতেন বলেন, সিরাজগঞ্জ-৬ আসনের সংসদ সদস্য মেরিনা জাহান কবিতা প্রতিটি ইউনিয়নে বরাদ্দ থেকে ২০০ পিস করে কম্বল নিজে বিতরণের জন্য চেয়েছেন। একটি ইউনিয়নে বিপুলসংখ্যক দরিদ্র ও অসহায় মানুষ রয়েছে। সেই মানুষদের বিতরণের জন্য আমরা মাত্র ৩৫০ পিস করে কম্বল বরাদ্দ পেয়েছি, যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এর মধ্যে যদি সংসদ সদস্যকে ২০০ পিস করে দেওয়া হয় তাহলে আমরা কীভাবে মানুষের মধ্যে অল্পসংখ্যক কম্বল বিতরণ করব।

রংপুরের তারাগঞ্জের পাঁচ ইউনিয়নে ২ হাজার ৩০০ কম্বল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, দরিদ্র ও ছিন্নমূল শীতার্তদের তুলনায় বরাদ্দ কম্বলের পরিমাণ খুবই সামান্য। প্রতি ২০ জনে একটি কম্বল পাওয়া গেছে। উপজেলা প্রকল্প ও পরিসংখ্যান কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, তারাগঞ্জের মোট জনসংখ্যা দেড় লাখ। এর মধ্যে অতিদরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষ প্রায় ৪৬ হাজার।

রাজশাহী জেলা প্রশাসক আব্দুল জলিল জানান, রাজশাহীতে অন্য বছর সরকারিভাবে ১ লাখের ওপর কম্বলের বরাদ্দ আসে। এ বছর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ৫৩ হাজার ৮৫০ পিস কম্বল প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে বরাদ্দ এসেছে।

কুষ্টিয়ায় ৩৪ হাজার ৩০০ কম্বল বরাদ্দ দেওয়া হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে। ৬৫টি ইউনিয়ন ও পাঁচটি পৌরসভার চেয়ারম্যানরা বরাদ্দ পান ৩৭০ থেকে ৩৮০টি করে। জেলা প্রশাসক মো. সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘জেলায় ২৩ লাখ মানুষের বাস। কম্বল বরাদ্দ অনেক কম। তাই শীতবস্ত্র চেয়ে আবেদন করা হয়েছে।’ মৌলভীবাজারে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে ৬৭ ইউনিয়ন ও পাঁচ পৌরসভায় ৩৫ হাজার ২৮০টি কম্বল পাঠানো হয়েছে। প্রতিটি ইউনিয়ন ও পৌরসভায় ৪৯০টি করে কম্বল দেওয়া হয়েছে। সদর উপজেলার খলিলপুর ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার রাজন আহমেদ বলেন, ‘ইউনিয়নে ৩৫০ কম্বল আসার কথা শুনেছি। আমি পেয়েছি ২০ পিস কম্বল।’

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ডা. মো এনামুর রহমান বলেন, জেলা প্রশাসকদের কাছে অর্থ ও কম্বল পাঠানো হয়েছে। কিছু জেলায় ইতোমধ্যে বিতরণও শুরু হয়েছে। প্রয়োজনের নিরিখে আরও বরাদ্দ দিতে প্রস্তুত রয়েছে মন্ত্রণালয়।

শীতার্তদের দুর্ভোগ :
রাজধানীর রমনা পার্কের ফুটপাতে গতকাল দুপুরে দুই সন্তান নিয়ে পাতলা একটা চাদরে জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আছেন আমেনা বেগম। শীতে কাঁপছিল তাঁর শরীর। আমেনার আক্ষেপ, 'পাশ দিয়ে দামি গাড়িতে বড় লোকরা গেলেও কেউ আমাদের দিকে তাকায় না। একটা কম্বল কেউ দেয় না।'
রাজশাহীর মোহনপুরের ৬৫ বছর বয়সী আক্কাস আলীর জীবন চলে ভিক্ষা করে। নগরের রেলস্টেশনে তাঁর রাত কাটে। তীব্র শীত তাঁর জীবনকে করে তুলেছে অভিশপ্ত। অর্থাভাবে নেই শীতের গরম কাপড়, বিছানা। রাত কাটে বসে, জেগে থেকে।

রাজধানীর আমেনা আর রাজশাহীর আক্কাস আলীর মতো এমন লাখ লাখ দরিদ্র মানুষ চেয়ে আছেন একটি কম্বলের আশায়। বছরের অন্য সময়টা কষ্টেসৃষ্টে কাটিয়ে দিতে পারলেও শীতের প্রতিটি সকাল-রাত কাটে অসহ্য যন্ত্রণায়।

ডিএসসিসির কম্বল বিতরণ হয় নি : 
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) পক্ষ থেকে ৩০ হাজার কম্বল কাউন্সিলরদের দেওয়া হলেও গতকাল পর্যন্ত তা বিতরণ হয়নি। আজ বৃহস্পতিবার থেকে বিতরণ কার্যক্রম শুরু করবেন বলে জানিয়েছেন বেশ কয়েকজন কাউন্সিলর। আর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) গতকাল পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগই নেয়নি। এ অবস্থায় হাড়কাঁপানো শীতে রাজধানীর ছিন্নমূল মানুষের কষ্টের অন্ত নেই।

ডিএসসিসির মুখপাত্র আবু নাছের বাঙলার কাগজ ও ডনকে বলেন, গত মঙ্গলবারের মধ্যে প্রত্যেক কাউন্সিলরের কাছে ৩০০ পিস করে কম্বল পাঠানো হয়েছে। তাঁরা বিতরণ করেছেন কিনা জানি না।

ডিএসসিসির ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডের (কামরাঙ্গীরচর এলাকার একাংশ) কাউন্সিলর মোহাম্মদ হোসেন জানান, ৩০০ কম্বল পাওয়া গেলেও তা যথেষ্ট নয়। কারণ কামরাঙ্গীরচর এলাকায় দরিদ্র মানুষ বেশি। আরও দেড় হাজার কম্বল তিনি নিজে কিনে তা বিতরণ করবেন।

ডিএসসিসির ৫৯ নম্বর ওয়ার্ডের (মেরাজনগর-পূর্ব কদমতলী) কাউন্সিলর আকাশ কুমার ভৌমিক জানান, ঢাকার বাইরে থাকায় কম্বলগুলো তিনি বিতরণ করতে পারেননি। তাঁর এলাকায়ও ৩০০ কম্বলে কিছু হবে না। আরও ২ হাজার কম্বল তিনি নিজে দেবেন। ডিএনসিসির মুখপাত্র মকবুল হোসেন বলেন, দ্রুতই কম্বল বিতরণের উদ্যোগ নেওয়া হবে।