১৮ মিনিটে ১১০৮ শব্দের অমর কাব্য

১৮ মিনিটে ১১০৮ শব্দের অমর কাব্য

মোস্তফা কামাল :: বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে নতুন দেশ তৈরিসহ বেশ কয়েকটি ঘটনা বিস্ময়ভরা। সাধারণ বিবেচনায় নির্ণয় করা কঠিন ঘটনাগুলো ইতিহাস হয়েছে, নাকি  ইতিহাসই এসব ঘটনায় সমৃদ্ধ হয়েছে? যেনতেন বিশ্লেষণে এই প্রশ্নের জবাব মিলবে না। ছয় দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন এবং স্বাধীনতাযুদ্ধসহ ঘটনাবলির যোগসূত্র বিস্তর। একটি ছাড়া আরেকটি হয় নি।

বঙ্গবন্ধুর একাত্তরের ৭ই মার্চের ভাষণকে ইউনেসকো বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দিয়েছে এই তো সেদিন (২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর)। কেবল তাদের সেই স্বীকৃতির কারণেই ভাষণটির শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করা অনুচিত। ভাষণটির শ্রেষ্ঠত্ব ইতিহাসে নির্ধারণ হয়ে গেছে এর বহুমাত্রিকতায়। পৃথিবীর কোনো রাজনীতিকের ভাষণের সঙ্গে তুলনা হয় না। আব্রাহাম লিংকন, মার্টিন লুথার কিংসহ জগদ্বিখ্যাতদের ঐতিহাসিক ভাষণ ছিল লিখিত। বহু হাতের ছোঁয়ায় সম্পাদিত। আর বঙ্গবন্ধুরটি তাৎক্ষণিক। ব্যাপ্তি ১৮ মিনিট (বিকাল ২.৪৫ থেকে ৩.০৩)। শব্দ ১১০৮টি। কোনো নোটও ছিল না বঙ্গবন্ধুর হাতে। এর মধ্যে আবার আঞ্চলিক শব্দ-উচ্চারণও প্রচুর। নির্দেশনামূলক হলেও ভাষণটিকে স্বাধীনতার ঘোষণা দাবি করা হয় এ কারণেই। ঘোষণা, নির্দেশনা, তখনকার বর্তমান-ভবিষ্যতের সঙ্গে অতীতের সংযোগসহ এমন কোনো বিষয় নেই, যা ঐ ১১০৮ শব্দের মধ্যে নেই। জানা, বোঝা এবং শেখার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দেশে অনুবাদ করে পঠন-শ্রবণ হয় ভাষণটি।  

যুগে যুগে, দেশে দেশে বহমান ঘটনা ত্রাণকর্তার আসনে বসিয়েছে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেওয়া ক্ষণজন্মাদের। তাদের মুখের কথাই হয়ে গেছে ইতিহাসের অংশ। ভাষণটি বিশ্লেষণ করে মার্কিন ম্যাগাজিন নিউজ উইক শেখ মুজিবুর রহমানকে উপাধি দিয়েছিল ‘রাজনৈতিক কবি’ নামে। এই উপাধিতে রাজনীতি এবং কাব্য বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। অর্থনীতি, ইতিহাস, চেতনার শিখাসহ সবই ছিল সেখানে। বিস্ময়, ভাবনা এবং জিজ্ঞাসার প্রচুর উপাদান সেখানে।  ভাষণটির মুখ এবং শেষাংশের কয়েকটি লাইন এখানে উল্লেখ না করলেই নয়।  

‘...আজ দুঃখ-ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর ও যশোরের রাজপথ আমার ভাইয়ের রক্তে রঞ্জিত।...আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়—বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়। কিন্তু ২৩ বছরের ইতিহাস বাংলার মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ২৩ বছরের ইতিহাস বাংলার মুমূর্ষু নরনারীর আর্তনাদের ইতিহাস।...ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা হলো—আমরা তাকে ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকার অনুরোধ করলাম। আমি শুধু বাংলার নয়, সমগ্র পাকিস্তানের মেজোরিটি পার্টির নেতা হিসেবে তাকে এ অনুরোধ করেছিলাম। তিনি আমার কথা রাখলেন না, রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা।...আমি তো অনেক আগেই বলেছি, কিসের রাউন্ড টেবিল, কার সঙ্গে বসব?...২৫ তারিখে অ্যাসেম্বলি কল করছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। আমি ১০ তারিখে বলে দিয়েছি ঐ শহিদদের রক্তের ওপর পাড়া দিয়ে আরটিসিতে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না।...আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই। তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

আজকের বাস্তবতায় ভাবনায় কুলায় না, কীভাবে সম্ভব হলো বাতকে বাত কথার মতো ১৮ মিনিটে এত কথা তুলে আনা? কৃষ্ণাঙ্গ বা নিগ্রোদের অধিকার আদায়ে আপসহীন লড়াই করেছেন আফ্রিকান-মার্কিন মানবাধিকারকর্মী মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র। আমেরিকায় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় অহিংস আন্দোলনের জন্য ১৯৬৪ সালে শান্তিতে নোবেল দেওয়া হয় তাকে। তার বিখ্যাত ভাষণ ‘আই হ্যাভ আ ড্রিম’। 

ঐতিহাসিক ভাষণের তালিকায় আরেক মহানায়ক আব্রাহাম লিংকন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম প্রেসিডেন্ট তিনি। ১৮৬১ সালে গৃহযুদ্ধকালে লিংকনের অবদানের কারণে দ্বিখণ্ডিত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেয়ে যায় আমেরিকা। ১৮৬৩ সালের ১৮ নভেম্বর গেটিসবার্গে ভাষণ দিয়েছিলেন লিংকন। যা আমেরিকানদের জন্য মূল্যবান দলিল। সামরিক ও রাজনৈতিক জীবনে ১৯৪০ সালের ১৩ মে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথম ভাষণটি অমরত্ব দিয়েছে উইনস্টন চার্চিলকে। যেই ভাষণ পালটে দেয় ইংল্যান্ডের রাজনীতি। সেখানে তিনি বলেছিলেন...যারা এই সরকারে মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন. তাদের আমি বলেছি আর এই মহান সংসদকেও বলছি, দেওয়ার মতো কিছুই নেই আমার, আছে শুধু রক্ত, কষ্ট, অশ্রু আর ঘাম। আমাদের সামনে অগ্নিপরীক্ষা, আমাদের মাসের পর মাস যুদ্ধ করতে হবে আর কষ্ট সহ্য করতে হবে।

...তোমরা যদি জিজ্ঞাসা করো আমাদের নীতিমালা কী, তবে জেনে রাখো আমাদের একটাই নীতি; জল, স্থল ও আকশপথে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া, আমাদের সবটুকু সামর্থ্য আর ঈশ্বর প্রদত্ত শক্তি নিয়ে আমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে এক নিষ্ঠুর দানবের বিরুদ্ধে। এটাই আমাদের নীতি।...যদি প্রশ্ন করো আমাদের লক্ষ্য কী, তবে শুনে রাখ একমাত্র বিজয় ছাড়া আমাদের আর কোনো লক্ষ্য নেই। পথ যতই দীর্ঘ কিংবা কঠিন হোক, বিজয় ছাড়া আমরা অন্য কিছু ভাবছি না। বিজয় ছাড়া আমাদের কোনো পথ খোলা নেই।’

উপরিউক্তদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর উত্থান, ভাষণ-শাসনের প্রেক্ষিত ভিন্ন। তিনি ভাষণে মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করার মহারাজ-মহানায়ক জাতির জনক বা বঙ্গবন্ধু হওয়ার আগে থেকেই। সেটা একাত্তরের ৭ই মার্চের ভাষণকে বাদ দিলেও। তা পাকিস্তান জমানায় তিনি যখন কারো কাছে শুধু মুজিব, কারো কাছে কেবলই শেখ সাহেব তখনও। তাই বঙ্গবন্ধুর শুধু একাত্তরের উত্তাল ৭ই মার্চের ভাষণকেই যত গুরুত্ব-কৃতিত্ব দিয়ে বাকিগুলো ভুলে যাওয়া কাঙ্ক্ষিত নয়। এর আগে-পরে তার আরো অনেক ভাষণ রয়েছে। সেগুলোতেও রয়েছে প্রচুর তথ্য, স্বীকারোক্তি, আশা-হতাশা, ক্ষোভভরা বক্তব্য। সেই সব ভাষণে কেউ প্রীত, কেউ ভীত। প্রকারান্তরে যা সবার জন্য শিক্ষণীয়। সরকারি দল, বিরোধী দল নয়; সবার জন্যই শিক্ষার রসদে পরিপূর্ণ বঙ্গবন্ধুর ভাষণগুলো। সেগুলোও ইতিহাসের দলিল।

সাদামাটা শব্দ-বাক্য, গণজমায়েত বা ঐ জমায়েতে উপস্থিতিদের ‘তুমি’ বলে সম্বোধন (ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো; তোমাদের যার যা কিছু আছে, তাই নিয়েই প্রস্তুত থাকবা) জাতির প্রতি কোনো নেতার অগাধ বিশ্বাস-আস্থার প্রতিফলন। ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের সেই ধারাবাহিকতায়ই এসেছিল ২৬শে মার্চ। যার মর্মবাণী দেওয়া ছিল ৭ই মার্চেই ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ভাষণে। এর ছাপ দেখা গেছে ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর খসড়া সংবিধান প্রসঙ্গে জাতীয় সংসদে দেওয়া ভাষণেও। ঐ ভাষণের কয়েক লাইনও এখানে উল্লেখ করতে হয়। নইলে লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যায়।...আর হবে ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে; মুসলমান তার ধর্ম পালন করবে; খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ—যে যার ধর্ম পালন করবে। কেউ কারো ধর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না, বাংলার মানুষ ধর্মের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ চায় না। রাজনৈতিক কারণে ধর্মকে ব্যবহার করা যাবে না। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ধর্মকে বাংলার বুকে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। যদি কেউ ব্যবহার করে, তাহলে বাংলার মানুষ যে তাকে প্রত্যাঘাত করবে, এ আমি বিশ্বাস করি।’

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট