অধ্যক্ষ স্বপন বিশ্বাস : মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছি।

অধ্যক্ষ স্বপন বিশ্বাস : মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছি।

নিজস্ব সংবাদদাতা, বাঙলা কাগজ; নড়াইল : ধর্ম অবমাননার কথিত অভিযোগে হেনস্তার শিকার হওয়া নড়াইল সদরের মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস বলেছেন, ‘মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছি, সবই আপনারা জানেন। আমার নিজের কোনও নিরাপত্তা নেই, পরিবারের কোনও নিরাপত্তা নেই।’

অধ্যক্ষ স্বপন কুমারের বাড়ি নড়াইল সদর উপজেলার বড়কুলা গ্রামে। ঘটনার পর তিনি গ্রামে ফেরেন নি। বাড়িতে তাঁর মা এবং অনার্স পড়ুয়া মেয়ে রয়েছেন। ঘটনার পর থেকে অধ্যক্ষ স্বপন কুমার কারও সঙ্গে দেখা করছেন না, কথাও বলছেন কম। 

বাঙলা কাগজ ও ডনকে তিনি বলেন, ‘কোনও নিরাপরাধ ছাত্র ও ব্যক্তি যেনো হেনস্তার শিকার না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখবেন।’ 

গত ১৮ জুন ভারতের বিজেপি নেত্রী নূপুর শর্মার সমর্থনে মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র রাহুল দেব রায় ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন বলে জানা যায়। পরে এই স্ট্যাটাস মুছে ফেললেও এলাকায় উত্তেজনা দেখা দেয়। বিক্ষুব্ধ ছাত্র ও স্থানীয়রা মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের শিক্ষকদের ৩টি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেয়। তারা অভিযুক্ত ছাত্র রাহুল ও অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বের করে দেয়। এ সময় রাহুলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ এবং তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়।

২০২১ সালে নড়াইল সদরের মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজে অধ্যক্ষের পদ শূন্য হওয়ার পর জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছেন স্বপন কুমার বিশ্বাস। কলেজের প্রশাসনিক কার্যক্রম চালাতে গিয়ে হেয় প্রতিপন্ন হয়ে ৩ বার পদত্যাগপত্র জমা দিলেও তা গ্রহণ হয় নি বলে জানিয়েছেন তিনি। শেষ পর্যন্ত ধর্ম অবমাননার অভিযোগে তার গলায় জুতার মালা পরানো হলো।

অধ্যক্ষ স্বপন সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বাঙলা কাগজ ও ডনকে বলেন, ‘সকাল ১০টা ১৫ মিনিটের দিকে কলেজের দ্বিতীয় তলার কক্ষে ছিলাম। তখন অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক শেখ আকিদুল ইসলাম এসে অভিযুক্ত রাহুলের ঘটনাটি আমাকে জানান। তিনি জানান, রাহুলকে শিক্ষকদের কক্ষে আটকে রাখা হয়েছে। তখন কলেজের শিক্ষক প্রতিনিধি ও উপস্থিত অন্য শিক্ষকদের জানিয়ে স্থানীয় মির্জাপুর পুলিশ ফাঁড়ির ক্যাম্প ইনচার্জকে জানালে তিনি একদল পুলিশ নিয়ে কলেজে আসেন। ক্যাম্প ইনচার্জ রাহুলকে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে ছাত্রদের বাধার সম্মুখীন হন। ছাত্ররা দাবি করেন, রাহুলকে তাদের হাতে তুলে দিতে হবে। অবস্থা বেগতিক দেখে তখন কলেজ পরিচালনা পরিষদের সভাপতি অ্যাডভোকেট অচিন চক্রবর্ত্তীকে ফোন করি। পরে সদর থানার ওসি, নড়াইলের পুলিশ সুপার ও সর্বশেষ জেলা প্রশাসক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে ঘটনাস্থলে আসেন।’

স্বপন কুমার বলেন, ‘একপর্যায়ে আমাকে নিচে নামানো হলো। দেখলাম কে বা কারা আমার গলায় জুতার মালা পরিয়ে দিলো। এখানে আমার কোনও দোষ ছিলো না।’ এ ঘটনার পেছনে কার দায় রয়েছে, তা সুনির্দিষ্ট করে না বললেও স্বপন কুমার বলেন, ‘অধ্যক্ষের পদে আসতে অনেকের ইচ্ছা রয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমার ধারণা, এই পদে অন্য কারও ইচ্ছা থাকতে পারে। কারণ গত ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের ব্যানার কলেজে টানানো হলেও পরদিন সে ব্যানার চুরি হয়ে যায়। আমার মনে হয়, আমাকে হেয় করতে এটা করা হয়েছে। এ ঘটনায় থানায় জিডি করলেও কোনও সুরাহা হয় নি। এটাই একটি বড় প্রমাণ।’

স্বপন কুমার বলেন, ‘আমি প্রথম থেকেই এ পদে আসতে চাই নি। ২০২১ সালের ২৭ এপ্রিল কলেজে সবার সিনিয়র হবার কারণে আমাকে জোরপূর্বক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। আমি এ পর্যন্ত ৩ বার কলেজ পরিচালনা পরিষদের সভাপতির কাছে রিজাইন লেটার দিতে গেলেও তিনি তা গ্রহণ করেন নি। সর্বশেষ একমাস আগেও সভাপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছি; কিন্তু তা গ্রহণ করা হয় নি।’ 

অধ্যক্ষকে হেনস্তা, মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেওয়া এবং পুলিশের কাজে বাধা দেওয়ার ঘটনায় গত ২৭ জুন রাতে পুলিশ বাদি হয়ে নড়াইল সদর থানায় একটি মামলা দায়ের করেছে। ওই রাতেই স্থানীয় ৩ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গ্রেপ্তার ৩ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৫ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়েছে বলে বাঙলা কাগজ ও ডনকে জানিয়েছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও নড়াইল সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মাহমুদুর রহমান। তবে এ ব্যাপারে এখনও শুনানির তারিখ হয় নি। 

মাহমুদুর রহমান আরও জানান, ঘটনাটি তদন্তে গত ২৬ জুন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জুবায়ের হোসেন চৌধুরীর নেতৃত্বে এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রিয়াজুল ইসলামের নেতৃত্বে দুটি তদন্ত কমিটি হয়েছে। নড়াইলের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জুবায়ের হোসেন চৌধুরী জানান, তদন্তের কাজ চলছে।