জঙ্গিদের নাটের গুরু চিকিৎসক দুই ‘বড় ভাই’ : হিজরতের জন্য ঘরছাড়া ৭ তরুণ।

জঙ্গিদের নাটের গুরু চিকিৎসক দুই ‘বড় ভাই’ : হিজরতের জন্য ঘরছাড়া ৭ তরুণ।

নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলা কাগজ : হিজরত করতে কুমিল্লার সাত তরুণ ঘর ছাড়ার পরই প্রশ্ন ওঠে- কাদের অঙ্গুলি হেলনে ঘর ছেড়েছেন তারা। উগ্রপন্থি সংগঠনের ছায়াতলে তাঁদের সমবেত করেছে কোন কোন ‘বড় ভাই’। কত দিন ধরে চলেছে মগজ ধোলাই? পুলিশি তদন্তে মিলেছে এসব অঙ্কের যোগফল।

ওই সাত তরুণের আরেক সহযোগী আবরারুল ইসলাম ধরা পড়ার পর নতুনভাবে সক্রিয় জঙ্গি নেটওয়ার্ক সম্পর্কে তথ্য পেয়েছে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। আবরারুল কুমিল্লা ইস্পাহানি স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র। তার ব্যবহৃত একটি মোবাইল ফোনও জব্দ করেছে পুলিশ। জঙ্গিদের ব্যবহৃত দুটি অ্যাপস নিয়মিত ব্যবহার করত সে। আবরারুল পুলিশকে প্রথম তথ্য দেয়- জিহাদের ডাক পেয়ে কুমিল্লা থেকে তার বন্ধুরা যাদের কথায় ঘর ছেড়েছে, তাদের দুজন চিকিৎসক। প্রায় এক বছর থেকে ওই দুই বড় ভাইকে তারা চেনে। দুজনই কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজে (কুমেক) পড়েছে। আবরারুলের সঙ্গে তার গুরু হিসেবে পরিচিত চিকিৎসক শাকির বিন ওয়ালীকে মঙ্গলবার (১৩ সেপ্টেম্বর) রাতে গ্রেপ্তারের কথা স্বীকার করেছে পুলিশ। কুমেকের আরেক চিকিৎসককেও খোঁজা হচ্ছে। এমনকি উগ্রবাদী আদর্শে বিশ্বাসী শাকিরের স্ত্রী আয়েশা বিনতে মুস্তাফিজকে রাখা হয়েছে নজরদারিতে। সে বরিশাল মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থী। স্বামীর সঙ্গে জঙ্গি নেটওয়ার্কে তার যোগসূত্র পাওয়ার পর আয়েশার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনসেট পুলিশ জব্দ করেছে। ওই ফোনে জঙ্গি মতবাদবিষয়ক বিভিন্ন লেখা পাওয়া গেছে। আয়েশা ছাড়াও তার স্বামীর দুটি ও আবরারুলের একটি ফোনসেট জব্দ করে প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। এতে তাদের সঙ্গে আনসার আল ইসলামের (সাবেক এবিটি-আনসারুল্লাহ বাংলা টিম) যোগসূত্র পাওয়া গেছে। আদালতের অনুমতি নিয়ে এসব ফোনের ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য সিআইডির ল্যাবে পাঠানো হবে। একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র থেকে এসব তথ্য মিলেছে।

এ ব্যাপারে সিটিটিসির প্রধান ডিআইজি আসাদুজ্জামান বাঙলা কাগজ ও ডনকে বলেন, কুমিল্লা থেকে যারা নিখোঁজ হয়েছিলো, তাদের ইমান, তাওহিদ ও জিহাদ সম্পর্কে দীক্ষা দেয় শাকিরসহ আরও একজন। তাদের ওপরে অন্য কেউ থাকতে পারে। বড় প্রস্তুতি নিয়ে তরুণদের ভুল পথে নিয়েছিলো চক্রটি। মূলত এরা রিক্রুটকারী। সর্বশেষ যে সাত তরুণ নিখোঁজ হয়েছে, তাদের খোঁজে বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছে।

জঙ্গিদের কর্মকাণ্ডের ওপর এক দশকের বেশি খোঁজ রাখেন এমন এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, কুমিল্লা থেকে যে তরুণরা হিজরতের জন্য ঘর ছাড়ে, তাদের ২০২১ সালের শেষ সময়ে টার্গেট করা হয়। কুমেকে পড়াশোনা করা এক যুবক ওই তরুণদের ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ করে। জিহাদের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তাদের বোঝানো হতো। ধর্মীয় জ্ঞান ও ফতোয়ার ব্যাপারে বিশদ ব্যাখ্যার প্রয়োজন হলে কুমিল্লার একজন মুফতির কাছে তাদের নেওয়া হতো। প্রতি দফায় দুই-তিনজনকে নিতো। জিহাদের জন্য মানসিক প্রস্তুতি নেওয়ার পর সপ্তাহ তিনেক আগে একে একে ঘর ছাড়ে সাত তরুণ। আরও ছয়-সাত তরুণও তাদের পথ অনুসরণ করে ঘর ছাড়ার প্রস্তুতি নেয়।

জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ পাওয়ার পরও কেনো শাকিরের স্ত্রীকে গ্রেপ্তার করা হয় নি- এমন প্রশ্নের জবাবে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, ‘তাদের ঘরে দেড় মাস বয়সের শিশু রয়েছে। তাই মানবিক কারণে এখনও গ্রেপ্তার করা হয় নি।’

আরেক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, ঘর ছাড়ার পর তরুণেরা বেশ কয়েকটি জেলায় গেছে। এর মধ্যে রয়েছে চাঁদপুর ও বরিশাল। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, শাকির ও তার সহযোগীরা এসব ঠিকঠাক করে দিয়েছে। কারণ শাকিরের এক আত্মীয়ের বাড়ি চাঁদপুরে। আর স্ত্রীর সুবাদে বরিশালে কিছুদিন বাস করে সে। দুই জায়গায় নিখোঁজ তরুণদের আস্তানা খুঁজে দেওয়ার ঘটনায় তার ভূমিকা থাকতে পারে।

এখন পর্যন্ত শাকির সম্পর্কে গোয়েন্দারা যেসব তথ্য পেয়েছেন, তা হলো- মেডিক্যালে পড়াশোনার সময় থেকে শাকির উগ্র মতাদর্শে বিশ্বাসী। ২০১৮ সালে সে একবার গ্রেপ্তার হলেও পরে ছাড়া পায়। খুব কম সময় সে মোবাইলে কথা বলে। যদি কোনও প্রয়োজন হয়, অ্যাপস ব্যবহার করে। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে অ্যাপস ছাড়া কথা বলে না। কুমিল্লা থেকে নিখোঁজ তরুণ বাড়ি ফিরে গেছে- এমন তথ্য তার কাছে যাওয়ার পর ৩১ আগস্টের পর নিজের ব্যবহৃত একটি পুরোনো ফোনসেট ও সিম ফেলে দেয় সে। নতুন রিক্রুট করা জঙ্গিদের উদ্দেশে বয়ান দিতে মাঝেমধ্যে কুমিল্লা যেতো সে। যদিও চিকিৎসক হওয়ার পর শাকির তার মা-বাবা ও স্ত্রীর সঙ্গে পূর্ব হাজীপাড়ার বাসায় থাকতো।

এ ছাড়া দেশের প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতিতে শাকিরের কোনও বিশ্বাস ছিলো না। শরিয়াহ্‌ ভিত্তিক চিকিৎসা নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করে সে। পুলিশ বলছে, ‘র‌্যামফিট’ নামে একটি পদ্ধতি সে বিশ্বাস করছে।

তদন্ত-সংশ্নিষ্টরা বলছেন, নিখোঁজ সাত তরুণের মধ্যে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী ইমরান বিন রহমান ওরফে শিথিল (১৭), কুমিল্লা সরকারি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী হাসিবুল ইসলাম (১৮) ও একই কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী নিহাল আবদুল্লাহকে (১৭) জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করতে তাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে শাকির। ওই বৈঠকে আবরারুলও ছিলো। 

এ ছাড়া শাকির তার এক আত্মীয়ের ছেলেকেও উগ্রপন্থায় নিতে প্রলুব্ধ করে। ওই ছেলের বাবা সরকারি কর্মকর্তা। বিষয়টি ওই ছেলের বাবা টের পাওয়ার পর শাকিরকে শাসান। দ্রুত শাকিরকে ওই পথ থেকে সরে আসার তাগিদ দেন। তবে শাকির তা কানে তোলে নি। আত্মীয়ের ছেলেকে জঙ্গিবাদে নিতে না পারলেও অন্য তরুণদের ক্ষেত্রে সফল হয়েছে। তবে গোয়েন্দাদের বিশ্বাস- তরুণদের মগজ ধোলাইয়ে শাকিরের সঙ্গে আরও কয়েকজন থাকতে পারে। আর শাকিরের বাবা এ কে এম ওয়ালী উল্লাহ চক্ষু বিশেষজ্ঞ ও সার্জন। তিনি জামায়াত-শিবির ও তাদের সমর্থিত চিকিৎসকদের ফোরাম ন্যাশনাল ডক্টরস ফোরামের (এনডিএফ) সহ-সভাপতি। 

এ ছাড়া শাকিরের শ্বশুর জামায়াতের মতাদর্শে বিশ্বাসী।

এ কে এম ওয়ালী উল্লাহ বলেন, রোববার (১১ সেপ্টেম্বর) বিকেল ৩টার দিকে সিআইডি পরিচয়ে সাদা পোশাকে চার ব্যক্তি বাসায় আসেন। তখন তিনি বাইরে ছিলেন। তাঁরা শাকিরকে জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলে নিয়ে যান। তাঁরা শুধু বলেছেন, ‘আমরা সিআইডির লোক।’ পরে রামপুরা পুলিশ জানায়, শাকিরকে মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হবে।

উগ্রপন্থি নেটওয়ার্কে ছেলের জড়ানোর ব্যাপারে ওয়ালী উল্লাহ বলেন, ‘এটা আমার জানা নেই। টেরও পাই নি। সে সপ্তাহখানেক আগে আমার মোবাইল ফোনসেটটি চেয়ে নিয়েছিলো।’