জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় : গৌরবের পথচলা

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় : গৌরবের পথচলা

১২ জানুয়ারি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ১৯৭১ সালের ১২ জানুয়ারি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য রিয়ার অ্যাডমিরাল এসএম আহসান ‘জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে প্রতিষ্ঠানটির উদ্বোধন করেন। ওই বছরের ৪ জানুয়ারি অর্থনীতি, ভূগোল, গণিত ও পরিসংখ্যান বিভাগে ভর্তি হওয়া ১৫০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়’ অধ্যাদেশের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটিকে স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা দেন। এ অধ্যাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম রাখা হয় ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়’। ৬৯৭ দশমিক ৫৬ একর ভূমির ওপর প্রতিষ্ঠিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে কলা ও মানবিকী, গাণিতিক ও পদার্থবিষয়ক, সমাজবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, বিজনেস স্টাডিজ এবং আইন অনুষদের অধীনে ৩৪টি বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের অধীনে প্রায় ১২ হাজার ৬০০ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন। শিক্ষার্থীদের জন্য নবনির্মিত ছয়টি আবাসিক হলসহ মোট আবাসিক হল ২১টি। শিক্ষক ৭২২ জন, কর্মকর্তা ৩৬৫ জন এবং প্রায় ১৫শ কর্মচারী। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতোমধ্যে ছয়টি সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ষষ্ঠ সমাবর্তনে প্রায় সাড়ে ১৫ হাজার গ্র্যাজুয়েট, ৩৪ জন এমফিল এবং ২৮০ জন পিএইচডি ডিগ্রিধারী অংশগ্রহণ করেছেন।

১২ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় উদ্বোধনের দিনকে ২০০১ সাল থেকে ‘বিশ্ববিদ্যালয় দিবস’ হিসেবে উদযাপন করা হচ্ছে। তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুল বায়েস এ দিবসের প্রচলন করেন। বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উদযাপনে তিনি পথিকৃৎ। অবশ্য এর আগে ১৯৯৬ সালে উপাচার্য অধ্যাপক ড. আমিরুল ইসলাম চৌধুরী বর্ণিল আয়োজনের মধ্য দিয়ে ২৫ বছরপূর্তিতে রজতজয়ন্তী উদযাপন করেন। একটি উচ্চতর গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়কে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে এর আনুষ্ঠানিক যাত্রার প্রাক্কালে দেশের খ্যাতনামা শিক্ষকদের এখানে নিয়ে আসা হয়। যে কারণে প্রারম্ভিক কালেই দেশের একমাত্র পূর্ণ আবাসিক এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। দেশের বরেণ্য অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। উপাচার্যদের মধ্যে অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, অধ্যাপক ড. আলাউদ্দিন আহমেদ প্রমুখ খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ এ দায়িত্ব পালন করে বিশ্ববিদ্যালয়কে গৌরবান্বিত করেছেন। শিক্ষা, গবেষণা এবং রাষ্ট্র গঠনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা প্রতিনিয়ত অবদান রাখছেন। বিশ্বসেরা টু পার্সেন্ট বিজ্ঞানীর তালিকায় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষক-শিক্ষার্থী অন্তর্ভুক্ত। এতে তাঁরা বিশ্বখ্যাতি লাভ করার পাশাপাশি এ বিশ্ববিদ্যালয়কেও সম্মানিত করেছেন। 

এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচিত বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. নূরুল আলম ন্যায়-নীতি প্রতিষ্ঠা, সময়ানুবর্তিতা এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বমানের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার ব্রত নিয়ে কাজ করছেন। বর্তমান উপাচার্যের সময়েই যুক্তরাজ্যভিত্তিক টাইমস হায়ার এডুকেশন ম্যাগাজিন কর্তৃক শিক্ষা ও গবেষণার ওপর ‘ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‍্যাঙ্কিং ২০২৪’-এর তালিকায় এ বিশ্ববিদ্যালয় স্থান লাভ করে। অধ্যাপক ড. নূরুল আলম উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণের পর বিশ্ব র‍্যাঙ্কিংয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করে এ লক্ষ্য অর্জনে একটি বিশেষায়িত কমিটি গঠন করেন। এ কমিটির মাধ্যমে তিনি শিক্ষকদের প্রথাগতভাবে গবেষণা গ্রন্থ ও গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশের পাশাপাশি অনলাইনেও প্রচারের তাগিদ দেন। শিক্ষক-গবেষকরা উপাচার্যের এই দিকনির্দেশনা অনুসরণ করায় কাঙ্ক্ষিত ফল অর্জিত হয়। উপাচার্য বিশ্ব র‍্যাঙ্কিংয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানজনক অবস্থান আরও বাড়ানোর জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। 

বর্তমান সরকার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা অনুমোদন দিয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় ছাত্রদের তিনটি এবং ছাত্রীদের তিনটি আবাসিক হল নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। নবনির্মিত ছয়টি আবাসিক হলে শিক্ষার্থী ওঠানো সম্ভব হলে শিক্ষার্থীদের পূর্ণ আবাসিক অবস্থা ফিরে আসবে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে শতভাগ আবাসন নিশ্চিতের লক্ষ্য বাস্তবায়নে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আন্তরিকতার সঙ্গে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। লাইব্রেরি, স্পোর্টস কমপ্লেক্সসহ অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণকাজ চলমান। এ প্রকল্পের অধীনে বিভিন্ন স্থাপনার কাজ সম্পন্ন হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবয়ব আমূল বদলে যাবে। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সকাল ১০টায় জাতীয় পতাকা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে দিবসের কর্মসূচি শুরু হবে। এর পর বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অংশগ্রহণে আনন্দ শোভাযাত্রা বের হবে। এর পর রক্তের গ্রুপ নির্ণয়, স্মৃতিচারণ, প্রীতি ফুটবল, হ্যান্ডবল প্রতিযোগিতা, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র এবং শিক্ষার্থী কল্যাণ ও পরামর্শদান কেন্দ্রের উদ্যোগে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। এ ছাড়াও বিভিন্ন বিভাগ ও প্রতিষ্ঠান নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে। দিনব্যাপী এসব আয়োজনের মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় দিবস সবার মধ্যে অম্লান হয়ে থাকবে বলে প্রত্যাশা করি।

ফরহাদ রহমান সরকার : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত