ঠিকানা লিখে বঙ্গবন্ধু বললেন ‘মুখস্থ করো’ : তোফায়েল আহমেদ

ঠিকানা লিখে বঙ্গবন্ধু বললেন ‘মুখস্থ করো’ : তোফায়েল আহমেদ

কলাম :: জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হৃদয়ে ছিলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার আজন্ম আকাঙ্ক্ষা। দেশভাগের পর থেকেই তিনি এ ব্যাপারে দৃঢ়সংকল্প ছিলেন। তিনি জানতেন, সত্তরের নির্বাচনে জিতলেও ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন না। কিন্তু নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি সারাদেশ সফর করে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেন। পহেলা মার্চ যখন ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করেন, মানুষ রাজপথে নেমে আসে।

৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু জীবনের শ্রেষ্ঠ ভাষণের মধ্য দিয়ে নিরস্ত্র জাতিকে সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তর করেন। মুক্তিযুদ্ধের জন্য আওয়ামী লীগকে প্রস্তুত করতে সেদিন তিনি সার্বিক দিকনির্দেশনা প্রদান করেন– ‘প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়, প্রত্যেক সাব-ডিভিশনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো’। বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে সারাদেশে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তুলে আসন্ন মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলো।

বস্তুত নির্বাচনের পরপরই ১৮ ফেব্রুয়ারি ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে ডেকে চার জাতীয় নেতার সামনে আমাদের চারজন– মনি ভাই, সিরাজ ভাই, রাজ্জাক ভাই ও আমাকে একটি ঠিকানা মুখস্থ করিয়েছিলেন। ভারতে গেলে আমরা কোথায় আশ্রয় পাব, থাকব–  সে জন্য আমাদের চার টুকরো কাগজ দিয়ে বলেছিলেন– ‘মুখস্থ করো। মুখস্থ করে ছিঁড়ে ফেলো’। কাগজে ঠিকানা লেখা ছিল– ‘সানি ভিলা, ২১ নং রাজেন্দ্র রোড, নর্দার্ন পার্ক, ভবানীপুর, কলকাতা।’ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর এই ঠিকানায় আমরা আশ্রয় গ্রহণ করি। 

আসলে বহু আগে থেকেই বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীনের পরিকল্পনা করেন। সেই ১৯৬২ সালে তিনি দেশ স্বাধীনের পরিকল্পনা নিয়ে আগরতলা গিয়েছিলেন। কিন্তু পরিকল্পনামতো কাজ হয়নি। আগরতলা মামলায় অভিযুক্তরা স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন– এটা সত্য। যার জন্য ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’য় অভিযুক্তরা বলেন, ‘আমরা তো ষড়যন্ত্র করিনি। দেশের স্বাধীনতার জন্যই পরিকল্পনা করেছিলাম।’ আর ১৯৬৬ সালের ৬-দফা কার্যত স্বাধীনতারই নামান্তর।

বঙ্গবন্ধু ১৯৬৯ সালের অক্টোবরে লন্ডন সফরে যান। সেখানে ভারতীয় প্রতিনিধি ফনীন্দ্রনাথ মুখার্জি (পিএন মুখার্জি), যাকে আমরা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ‘মিস্টার নাথ’ বলে সম্বোধন করতাম– বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ভারতের ভূমিকা বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করেন।

বঙ্গবন্ধু একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে তবেই স্বাধীনতা ঘোষণা করার রাজনৈতিক বৈধতা অর্জন করেন। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণেও তিনি বিচক্ষণতার সঙ্গে বক্তব্য দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু সবসময় চেয়েছেন– তিনি আক্রান্ত হবেন, আক্রমণকারী নয়। সে জন্যই ২৫ মার্চ জিরো আওয়ারে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যা শুরু হলে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে পূর্বপ্রস্তুতি অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। জেনারেল নিয়াজির জনসংযোগ কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিক তাঁর ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ গ্রন্থের ৭৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, তারাও বঙ্গবন্ধুর স্বকণ্ঠে রেকর্ডকৃত ঘোষণাটি শুনেছেন- ‘দিস মে বি মাই লাস্ট মেসেজ। ফ্রম টুডে বাংলাদেশ ইজ ইন্ডিপেনডেন্ট।’

আমরা জানি, ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র তৃতীয় খণ্ডে বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণা উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, ২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে এই ঘোষণা দেন তিনি। পরে তা তৎকালীন ইপিআর ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। পরে চট্টগ্রামের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ২৬ ও ২৭ মার্চ বেশ কয়েকজন শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।

বঙ্গবন্ধুর ঘোষণার মূল্যবান দলিলটি সেখানে লিপিবদ্ধ হয়েছে এভাবে- ‘ইহাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণকে আহ্বান জানাইতেছি যে, যে যেখানে আছেন, যার যাহা কিছু আছে, তাই নিয়ে রুখে দাঁড়াও, সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করো। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি হইতে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও। শেখ মুজিবুর রহমান।

২৬ মার্চ, ১৯৭১।’

প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য এ রকম একটি চূড়ান্ত ঘোষণায় পৌঁছতে বঙ্গবন্ধুকে দীর্ঘ ২৪টি বছর নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে, ধাপে ধাপে জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম পরিচালনার মাধ্যমে, জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে, শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন, জেল-জুলুম-হুলিয়া-ফাঁসির মঞ্চকে উপেক্ষা করে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হয়েছে।  

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাটিই ১০ এপ্রিল ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ’ গৃহীত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে অন্তর্ভুক্ত হয়ে সাংবিধানিক বৈধতা অর্জন করে। বঙ্গবন্ধুর এই স্বাধীনতার ঘোষণাই ২৬ মার্চ দুপুরে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে এমএ হান্নানের কণ্ঠে বারবার প্রচারিত হয়েছে। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ‘প্রামাণ্যকরণ কমিটি’র চেয়ারম্যান মফিজুল্লাহ কবীর ও হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় ১৫ খণ্ডে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র’ সংকলনের ৩ নম্বর খণ্ডে আছে– ‘জিয়াউর রহমান মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে ২৭ মার্চ ঘোষণা দেন।’ 

বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা শুনে ২৬ তারিখই যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। মেজর সফিউল্লাহ, খালেদ মোশাররফ, মেজর রফিক জিয়ার ঘোষণার আগেই যুদ্ধ শুরু করেছেন। সুতরাং যারা ২৬ মার্চ জিয়ার ঘোষণার কথা বলেন, তারা অসত্য কথা বলেন। 

এমনকি ইয়াহিয়া খানও ২৬ মার্চের ভাষণে রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ করে বলেছেন, ‘সপ্তাহ খানেক আগেই আমার উচিত ছিল শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা।’ বঙ্গবন্ধুরই বিচার হয় সামরিক আদালতে। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, আবদুল মান্নান, আবিদুর রহমান ও আমাকেও মার্শাল ল কোর্টে ২৭ এপ্রিল ১৪ বছর সশ্রম কারাদণ্ড, অর্ধেক সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়।

আজকাল বিভিন্নজন বিভিন্ন রকম দাবি করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ ছাড়া আমরা কেউ কিছু করতে পারিনি। বঙ্গবন্ধু জাতীয় নেতা হিসেবে যা করতে পারতেন না, ছাত্রলীগ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তা পালন করত। কোনোটাই বঙ্গবন্ধুর অনুমোদন ছাড়া হয় নি।

২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসের ঐতিহাসিক এইদিনে আমাদের মহান নেতা ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে শ্রদ্ধাবনত মস্তকে স্মরণ করি। 

লেখক : তোফায়েল আহমেদ, এমপি; সদস্য, উপদেষ্টা পরিষদ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।