শহিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, আমার দাদু : আরমা দত্ত

শহিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, আমার দাদু : আরমা দত্ত

কলাম :: ১৯৭১-এর ৭ মার্চ যখন আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল থেকে কোনোরকমে কুমিল্লা পৌঁছলাম তখন দুপুর একটা। আমার দাদু বারান্দায় পায়চারি করছেন অস্থিরভাবে, আমি গাড়ি থেকে নামতেই দাদু আমাকে দুই হাত দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘আইসা পড়ছো দাদু? আর কোনো চিন্তা নাই, বাঁচলে একসঙ্গেই বাঁচমু না হলে সব একসঙ্গেই মরমু।’

আমি কিন্তু এখনো বেঁচে আছি দাদু ছাড়া। আমাদের একসঙ্গে মৃত্যু হয় নি। আমার দাদু শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এবং আমার কাকু শ্রী দিলীপ দত্তকে একসঙ্গে ২৯ মার্চ ১৯৭১ রাত দুটোর সময় নিয়ে গেল পাকিস্তানি মিলিটারি। তাদের মরদেহও আমরা আর দেখিনি। তাই আমার জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দাদু মৃত নয়- আমার কাছে আমার দাদু জীবন্ত ও উজ্জ্বল স্মৃতি। আমার কাছে আমার দাদুর অস্তিত্ব হলো এই বাংলাদেশ। বাংলাদেশ যেমন সত্য আমার দাদুও তেমনি সত্য! আমার সারা স্মৃতিতে শুধু দাদু। আমার ছোটবেলাতে মনে হতো, আর যে কেউ পৃথিবীতে মরবে আমার দাদু কখনো মরতে পারে না। আমি তো দাদুকে মরতে দেখিনি, শুধু আমার দাদুকে এক অসম্ভব গভীর অন্ধকারে হারিয়ে যেতে দেখেছি। তাই মাঝে মাঝে গভীর অন্ধকারে তাকিয়ে থাকি যদি কখনো আমার দাদুকে আবার সেই অন্ধকার ভেদ করে ফিরে আসতে দেখি। জানি আর আসবেন না তবু তাকিয়ে থাকি। ওই রকম যখন ভাবি আমার মনে দাদুকে স্পষ্ট দেখতে পাই- অনেক কিছু তখন মনে পড়ে। তখন তো জানতাম না আমার দাদু যে কত বড়- তা হলে প্রতিটি মুহূর্ত আমি তার কাছ থেকে শিখে নিতে চেষ্টা করতাম। আমি তো জানি না যে এত তাড়াতাড়ি আমার দাদু অন্ধকারে হারিয়ে যাবেন। আমার স্পষ্ট মনে আছে, ১৯৭০-এর গোড়ার দিক থেকে দাদু সবাইকে একটা কথা বারবার বলতেন- মক্কেল থেকে শুরু করে চালআলা দুধআলা প্রত্যেককে Be prepared for a severe bloodbath এটাও বলতেন, বাংলাদেশ আসবেই, তার পতাকা আমি তুলে যাব, হয়তো সেটা আমার রক্তের ওপরই হবে। হয়েছেও তাই। মার্চ মাসের ৭ তারিখেই আমাদের বাসায় দাদু নিজ হাতে বাংলাদেশের পতাকা তুলে দিয়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। আমার দাদু ১৯৭০-এর নির্বাচনে গ্রামে গ্রামে ঘুরে আওয়ামী লীগের জন্য প্রচার কাজ চালিয়ে গেছেন ৮৪ বছর বয়সে এই আশায়, ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮, পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে যে দুটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন, (এই অধিবেশনে দুটি সংশোধনী প্রস্তাব ও দাবি উত্থাপন করা হয়। পূর্ববাংলার প্রতিনিধি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ব্যক্তিগতভাবে প্রস্তাব করেন-১. বছরে অন্তত একবার ঢাকায় পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠান ও ২. উর্দু ও ইংরেজির সঙ্গে বাংলাকেও গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে ব্যবহার) তা যেন তিনি বাস্তবে দেখে যেতে পারেন। তাই ওই বয়সে দিনে-রাতে গ্রামে গ্রামে হেঁটে বেরিয়েছিলেন। মার্চ মাস থেকে দেশ যত অবনতির দিকে যাচ্ছে, দাদু তত সবাইকে বলছেন অন্ধকারের ওপারের আলো এগিয়ে আসছে, তোমরা নিরাশ হবে না, আমরা হয়তো অনেকে নাও থাকতে পারি, কিন্তু তাতে সেই আলো আর কেউ ঠেকাতে পারবে না।

২৫ মার্চ ঢাকায় গণহত্যা শুরু হয়। রাত একটার মধ্যে আমরা খবর পেলাম। দাদু চুপ করে অনেকক্ষণ বসে রইলেন। ২৬ মার্চ কুমিল্লা শহর যেন একটা শ্মশান- শুধু একটু পর পর বিকট আওয়াজ করে মিলিটারি লরি ও জিপ ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছে, কাকগুলো পর্যন্ত যেন ভয়ে ডাকতে ভুলে গেছে- সব যেন কিসের প্রহর গুনছে। দাদু বলতে থাকলেন, রেডিওতে পৃথিবীর যা খবর পাও সংগ্রহ করো। আমরা পাগলের মতো বিবিসি, এবিসি, ভোয়া, আকাশবাণী ও ঢাকার খবর শুনতে চেষ্টা করছি। ঢাকা খুলতেই বীভৎস গলায় সব কথা বলছে এবং শুধুই হুশিয়ার বাণী শোনাচ্ছে। বিদেশি রেডিওর মাধ্যমে জানলাম শেখ সাহেবকে ধরে নিয়ে গেছে এবং ঢাকাতেও গণহত্যা শুরু হয়েছে ও হচ্ছে।

একটা অসহ্য যন্ত্রণা। আমার ঠাকুমা বহু আগে মারা গেছেন। আমার কাকু, যিনি খুব কমই তার মার কথা বলতেন, সেই রাত্রি থেকে বলতে থাকলেন, ‘আমার শুধু মার কথা মনে হচ্ছে।’ কাকুর কথা শুনে বুকের ভেতরটা ধক করে উঠছে। বারবার মনে হচ্ছে আমাদের ওপর কি মৃত্যুর ছায়া নামছে? যতবার মনে হচ্ছে ততবার মনে সাহস আনার চেষ্টা করছি। এমনি করে ২৬ তারিখ কেটে গেল। ২৭ তারিখে একই অবস্থা। দাদুর প্রচণ্ড রক্তচাপ ছিল- তা ভীষণভাবে বেড়ে গেল, বারবার মাথা ধুয়ে বসছিলেন দাদু। এক সময় তিনি আমার মা, আমার কাকা ও আমাকে ডেকে বললেন, সময় খুবই কম, তোমাদের কিছু কথা বলা দরকার। আমার বাঁচার খুবই প্রয়োজন ছিল বাংলাদেশের জন্য, কিন্তু মনে হচ্ছে তার সম্ভাবনা নেই। আমার বন্ধু-কন্যার (ইন্দিরা গান্ধী) সঙ্গে এই মুহূর্তে দেখা হওয়ার খুবই প্রয়োজন ছিল- কিন্তু এখন যদি আমি পালাই তা হলে মিলিটারিরা আমাকে খুঁজে না পেলে আশপাশের সব লোককে মেরে আগুন লাগিয়ে সব শেষ করে যাবে। আমাকে না পেলে নিরপরাধ লোকগুলোর প্রাণ যাবে, সেটা তো হতে পারে না। ‘আই অ্যাম ট্র্যাপড।’ আমাকে পাকিস্তানি সৈন্যরা নিতে এসে দুটো জিনিস করতে পারে। প্রথম হতে পারে- তারা আমাকে ক্যান্টনমেন্টে ধরে নিয়ে গিয়ে আমাকে দিয়ে বিবৃতি দেওয়ানোর চেষ্টা করবে। তাই যদি করে, তাহলে আমি তাদের একটা কথাই বলব- To stop kill these unarmed people, তখন তারা আমার ওপর অনেক অত্যাচার করবে এবং মেরে ফেলবে ওখানেই।

ঠিক আর একটা হতে পারে- মিলিটারিরা আমাকে এখানেই গুলি করে মারবে। আমার বিশেষ অনুরোধ, তোমরা আমার লাশটা বারান্দায় ফেলে রেখো যাতে সবাই আমার মৃতদেহ দেখে মনে সাহস পায় বিদ্রোহ করার জন্য। দাদু এটাও বললেন, দেখো, ওরা আমাকে এই দুদিনের মধ্যেই এসে নিয়ে যাবে। আর আমাকে বিশেষ করে বললেন, পৃথিবীতে আর কেউ আমার জন্য কাঁদলেও তুই যেন না কাঁদিস তাহলে আমি অনেক কষ্ট পাব। দাদু চোখের সামনে যেন পরিণতি দেখতে পাচ্ছিলেন। আমরা শুধু ছটফট করছি যন্ত্রণায়। ২৮ মার্চ দুপুর দুটোর সময় কারফিউ কিছুক্ষণের জন্য তুলে নিলে কুমিল্লার অনেকেই দৌড়ে আমাদের বাড়িতে এসে দাদুর পায়ের ধুলো নিয়ে গেল। সবাই যেন বুঝতে পারছিল, এর পর কারফিউ তুললে এই বাড়িতে আর ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত থাকবেন না। সবাইকে দাদু বলতে থাকলেন, বাঁচাটাও যেমন সত্যি, মৃত্যুও তেমনি সত্যি- তোমরা ভয় পাবে না, শুধু মনে সাহস নিয়ে এগিয়ে যাও- বাংলাদেশ দেখবে। বিকাল চারটায় আবার কারফিউ শুরু হলো। সেই অসহ্য নীরবতা চারদিকে আবার। দাদু সন্ধ্যার সময় মাথা ধুলেন খুব নিশ্চিতভাবে তার পর কয়েকার ওস্ খেলেন। আমাকে এর পর ডেকে বললেন, দাদু, ‘গীতাটা আনো। আমি এনে দিলাম। দাদু বললেন- এবার শোনো। তার পর গীতার একটা অংশ খুলে লাল পেন্সিল দিয়ে দাগ দিয়ে পড়ে শোনালেন, যার অর্থ- ‘দেশের জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দিলে সে মরে না, সে শহিদ হয় এবং সে অবিনশ্বর, তার আত্মা কখনো মরে না।’ আমি তখন দিশাহারা- আমার মা, কাকা সবাই অসহায় হয়ে হতভম্ব হয়ে গেছে। দাদু আবারও বললেন, ওরা আজ রাতে আমাকে নিতে আসবে, যা বলছি তাই করার চেষ্টা করবে এবং কাঁদবে না। কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি শুয়ে পড়লেন। আমি দাদুর মশারি গুঁজে দিয়ে এলাম। ওই ঘরে শুধু আমার কাকু ও দাদু থাকতেন। আমরা যে যার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। হঠাৎ রাত দেড়টার দিকে বিকট আওয়াজ হতে থাকল আমাদের সদর দরজায়। আমার কাকু ছুটে এসে মাকে বললেন, মিলিটারি এসেছে, কী করব? মা বললেন, দরজা খুলে দাও। আমরা ধড়মড় করে উঠে কাঠের পুতুলের মতন দাঁড়িয়ে থাকলাম। অনেক ভাংচুরের আওয়াজ শুনতে পেলাম। একটু পরে দেখলাম চার-পাঁচজন মিলিটারি আমার মায়ের ঘর থেকে আমাদের ঘরে ঢুকছে এবং আমাকে বলছে দরজা খুলতে। আমি একে একে দরজা খুলতে থাকলাম। তারা আমার পেছনে বেয়নেট উঁচিয়ে চলতে থাকল। আমি আবার ঘুরে এসে মায়ের ঘরে থামলাম, তারা সেখান থেকে মার্চ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আমি তাদের পেছনে পেছনে দৌড় দিলাম, ততক্ষণে দেখি, সামনের ঘরে আমার ছোটভাই রাহুল মড়ার মতো ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি গেট পার হয়ে রাস্তায় এসে থামলাম। দেখি অন্ধকারে অনেকগুলো মিলিটারি লরি লাল আলো ‘ব্লিংক’ করতে করতে মিলিয়ে যাচ্ছে। সে কী অন্ধকার! ওখানে অন্ধকার আকাশের নিচে দাঁড়িয়েই বুঝতে পারলাম আমার দাদু ওই অন্ধকারে চিরতরে মিলিয়ে গেছেন। আমার মা টেনে আনল ঘরে, ঘরে ঢুকেই পাটা কিসে যেন পিছলে গেল, দেখি, রক্ত- অনেক ছোপ ছোপ রক্ত। ভাবলাম দাদু চলে গেছে, কাকু নিশ্চয়ই আছে- কোথাও ভয় পেয়ে লুকিয়েছে, জোরে জোরে কাকুকে ডাকতে থাকলাম, কেউ সাড়া দিল না- ছুটে দাদুর ঘরে এলাম, দেখি ফ্যান ঘুরছে তার সঙ্গে খাটে সাদা মশারি হাওয়াতে উড়ছে। খাট দুটো খুলি। আমি মাটিতে বসে পড়লাম, বুঝলাম দাদু চলে গেছে, কাকুও গেছে। আমাদের আর একসঙ্গে যাওয়া হলো না। পরদিন সকালে আমাদের গেটে দাদুর এক পাটি জুতো পড়ে থাকতে দেখেছি।

আমরা ২৯শে মার্চ দুপুর দুটোতে বেরোই অনিশ্চয়তার পথে। পরে শুনেছি ১৪ই এপ্রিলের দিকে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে অকথ্য নির্যাতন করে মেরেছে আমার দাদুকে। আমরা এর বেশি আর জানতে চাই না। আমার দাদু বাংলার মাটিতে তাঁর রক্ত, হাড় মাংস একাকার করে দিয়ে মিলিয়ে গেল। বাংলাদেশ হলো, বাংলাদেশের পতাকা উঠল— -দাদু যা-যা প্রস্তাব করেছিল ১৯৪৮ সালে, বাংলাভাষা বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা হলো- সব হলো শুধু আমার দাদুর কথা আর কেউ সোচ্চার গলায় উচ্চারণ করল না।

আমার দাদুর মতন আধুনিক মানুষ আমি এখনো খুব একটা দেখি না। তাঁর নীতি, চরিত্র ও চিন্তাধারা ছিল বহু বছর এগিয়ে। তাঁর মতো উদার, সবদিক থেকে সংস্কারমুক্ত মানুষ এখনো পর্যন্ত আমার চোখে পড়ে না। একবারের কথা-আমি তখন সবে কুমিল্লাতে দাদুর সঙ্গে স্থায়ীভাবে থাকতে গেছি। আমাদের পাড়ায় একটা ধুনকর পরিবার ছিল। তাদের মেয়েদের সঙ্গে আমার খুব ভাব। আমি তাদের সঙ্গে খেলা করতাম-তাদের বাড়িতে গিয়ে খাওয়া-দাওয়াও করতাম। তখন বয়স আমার ৯ বছর। ওই পাড়াতে একজন বিশিষ্ট উকিল ছিলেন, একদিন উনি আমার কান টেনে ধরে বললেন, এক্ষুনি বাড়ি যাও। এই ধুনকরের বাচ্চাদের সঙ্গে ফের যদি খেলতে দেখি তোমায়-তাহলে মজা দেখাব। জান না তোমরা কত বড় বংশের ও জমিদার বাড়ির মেয়ে? আমার ভীষণ রাগ হলো এই কথা শুনে। ছুটে দাদুর কাছে এসে বললাম, দাদু, আমরা আবার কিসের বড় বংশের জমিদার যার জন্য নূরজাহানের সঙ্গে আমার খেলা মানা? দাদু কাচারি ঘরে ঘরভর্তি মক্কেল নিয়ে কাজ করছিলেন। তিনি আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মক্কেলদের বললেন, তোমরা সবাই এক ঘণ্টা পরে এস, আমার নাতনির সঙ্গে জরুরি কথা আছে। উনি আমাকে বারান্দায় নিয়ে বলতে শুরু করলেন-এই এলাকা, মায় ত্রিপুরা রাজ্য এক সময় জঙ্গল ছিল, চাষাবাদের উপযোগী ছিল না। এই এলাকায় কিছু কাঠুরিয়া কাঠ কেটে জীবন ধারণ করত। এইসব এলাকায় তখন হাতিও ছিল। তখনকার একটা নিয়ম ছিল যে, ত্রিপুরার রাজাকে যে যত হাতি ধরে দিতে পারবে-সে ত্রিপুরা স্টেট থেকে তত জমি পাবে এবং মন্ত্রিপরিষদে পদও পাবে। এতে জঙ্গল পরিষ্কার হতে থাকল, স্টেটের চাষোপযোগী জমিও বাড়তে থাকল। যার যত ভালো পদ রাজা তাকে তত বেশি জমির মালিকানা দিতে থাকল। পত্তনদার থেকে জমিদারি। দাদু এরপরে সামাজিক স্তর বিন্যাস, সাম্রাজ্যবাদ, যুদ্ধনীতির ব্যাখ্যা তো দিলেনই তার সঙ্গে এই এলাকার ভৌগোলিক ও তৎকালীন সমাজের নৃতাত্ত্বিক ব্যাখ্যাও দিলেন (যদিও আমার দাদু নৃতত্ত্ব বা সমাজতত্ত্ব কিছুই পড়েন নি)। শেষে বললেন, ‘আমি ধীরেন দত্ত-এই প্রথাকে ঘৃণা করি এবং এই প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে জমিদার প্রথা থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম ৮ সন্তান, ৩ বোন, বৃদ্ধ পিতা-মাতার হাত ধরে।' আমার দাদুদের পূর্বপুরুষ এমনিভাবেই জমিদার হয়েছিলেন এবং ত্রিপুরা রাজ্যের মন্ত্রী হয়েছিলেন। দাদু সেই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। দাদু আমাকে সাবধান করে দিয়েছিলেন, জমিদার বংশের কথা কাউকে বলবে না-খুব কলঙ্কময় ও লজ্জাকর অধ্যায়-আমাদের পূর্বপুরুষ কাঠুরিয়া— -আমরা মানুষ, এই হলো আমাদের সবচেয়ে বড় পরিচয় আমরা খেটে খাওয়া মানুষ-তুমি মানুষ হতে চেষ্টা করো এটাই হবে তোমার সবচেয়ে বড় পরিচয়।

আর একটি ছোট্ট ঘটনা। দাদুর এক বন্ধু, তিনি সাত তাড়াতাড়ি করে তাঁর মেয়েকে বিয়ে দেবেন। বেশি পড়াশোনা করেনি মেয়েটি। দাদু খুব ধমকালেন তাঁকে, এবং নিজেও বিচলিত। এখানে দাদুর যুক্তি মেয়েদের নিজের প্রয়োজনেই শিক্ষিত হতে হবে যাতে বিপদে-আপদে সে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে, কারো মুখাপেক্ষী না হয়। মেয়েদের যথাসম্ভব উচ্চশিক্ষা দিয়েছিলেন তিনি। নারী জাতিকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন দাদু। তিনি বাড়িতে কাজের মেয়েদের ‘মা’ ছাড়া ডাকতেন না। আজ সত্যি বলতে আমি ৯ বছর বয়সে যে সমাজ-বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ শুনেছি আমার দাদুর কাছে তা পরবর্তীকালে সমাজবিজ্ঞান এমএ ক্লাসে পড়তে এসেও গাদা গাদা বই পড়েও শিখতে পাইনি দাদুর কাছে যে সব মক্কেল আসত তাদের অধিকাংশই পয়সা দিত না। এসেই বলত বাবু হালের গরু বেইচ্যা পয়সা আনছি- সঙ্গে সঙ্গে তার কেস নেওয়া হয়ে গেল। শুধু তাই নয়, খাওয়া, থাকা ও বাড়ি ফেরার পয়সা পর্যন্ত দাদু দিয়ে দিতেন। এমনকী পুরোনো কাপড়ও দেওয়া হতো। আমরা দাদুর সঙ্গে ঝগড়া করেছি-দাদু, ওর কোমরে অনেক পয়সা, ও ওই বারান্দায় লুকিয়ে পয়সা গুনছিল। দাদু ধমক দিয়ে আমাদের থামিয়ে বলতেন-গরিবের সমস্যা ও দুঃখ বুঝতে চেষ্টা কর-না হলে মানুষ হবে না। মানুষকে অবিশ্বাস করবে না। আমরা বড়লোক হব না তবে না খেয়ে তো মরব না। ওরা না খেয়ে মরে যাবে। আমার দাদুর কড়া নির্দেশ ছিল যে আমরা কেউ ২০ টাকার বেশি দামি শাড়ি পরতে পারব না। আমরা অনেক মিথ্যা কথা বলেছি তাঁর কাছে। সিল্কের শাড়ি কিনে বলেছি, এই শাড়ির দাম ১৯ টাকা-এত সরল ছিলেন-বুঝতে পারতেন না। আর একটা ব্যাপার তিনি মনে প্রাণে ঘৃণা করতেন। ধর্ম নিয়ে যারা কারবার করে তাদের তিনি বাড়ির ত্রিসীমানায় ঢুকতে দিতেন না তা সে যে ধর্মাবলম্বীই হোক না কেন। আরো একটা কথা না বললে দাদুকে পূর্ণভাবে বলা হবে না। তাঁর মতো এরকম আধুনিক ও অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তি এখনো দেখি না। দাদু বারবার বলতেন-যে সম্প্রদায়িকতার বীজ ব্রিটিশরা এই দেশে বুনে দিয়ে গেছে মৃত্যুশাল হিসেবে তার থেকে মুক্তি পাওয়ার একটিমাত্র পথ আছে। আর তা হলো এই দেশে ‘ইন্টার ম্যারেজ' হওয়া। যেদিন এটা ঘরে ঘরে হবে, সেদিনই বুঝবে এই দেশের মুক্তি লাভ ঘটেছে এবং অনেক সমস্যার সমাধান হয়েছে। পাকিস্তান হয়েছিল ধর্মের উপরে ভিত্তি করে, আর আজ বাংলাদেশ হয়েছে বাংলা ভাষার উপরে ভিত্তি করে। প্রশ্ন থাকে- তাহলে বাংলাদেশের জন্মের জন্য আমার দাদু শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের কী অবদান? অবদানের কথা সবাই জানে, কিন্তু তার সম্মানজনক স্বীকৃতি কোথায়?

ফিরে তাকাই ইতিহাসের দিকে। আমি অকপটে স্বীকার করি, বাংলাভাষার জন্যে দাদুর ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন আমার স্মৃতির অন্তর্গত নয়, কিন্তু মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার জন্যে তাঁর প্রবল ভালোবাসা বোঝানোর জন্যেই বিষয়টি সবিস্তারে উল্লেখ করার প্রয়োজন রয়েছে। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে বিরোধী দলের তরফ থেকে দুটি সংশোধনী উত্থাপন করা হয়। এ-সম্পর্কে আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। দাদু ব্যক্তিগতভাবেই এই প্রস্তাব করেছিলেন। এ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনাকালে গণ-পরিষদে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি হয়। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান শুধু এই প্রস্তাবটির বিরোধিতা করেই ক্ষান্ত হননি, তিনি প্রস্তাব উত্থাপনকারীর উদ্দেশ্যের সততার প্রতি কটাক্ষ করে সেদিন বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানের অধিবাসীদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করা এবং একটি সাধারণ ভাষার দ্বারা ঐক্যসূত্র স্থাপনের প্রচেষ্টা হইতে মুসলিমদের বিচ্ছিন্ন করাই এর উদ্দেশ্য।” গণপরিষদে পূর্ববাংলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনও সেদিন দাদুর প্রস্তাবের বিরোধিতা করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ অধিবাসীর এই মনোভাব যে একমাত্র উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করা যাইতে পারে।' তবে নাজিমুদ্দিনের এই বক্তব্যের উপযুক্ত জবাব ২৮শে ফেব্রুয়ারি ‘বাংলাভাষা ও পাকিস্তান' শীর্ষক দৈনিক

আজাদের এক সম্পাদকীয়তে দেওয়া হয়েছিলো- ‘আমরা বিশ্বাস করি, গণভোট গ্রহণ করিলে বাংলাভাষার পক্ষে শতকরা ৯৯ ভোটের কম হইবে না।’

পরবর্তীকালে এই প্রস্তাব সম্পর্কে দাদু বিশিষ্ট লেখক ও বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন উমরকে এক পত্রে বলেন : ‘বাংলাভাষা আমাদের রাষ্ট্রীয় ভাষা হউক ইহাই ছিল আমার প্রস্তাব। ইহা আমার পার্টি প্রস্তাবে ছিল বলে মনে হচ্ছে না।' অগাধ দেশপ্রেম যেমন দাদুকে কখনোই দেশ বিভাগের পর জন্মভূমি ত্যাগে উদ্বুদ্ধ করেনি, তেমনি মাতৃভাষার প্রতি অকৃত্রিম দরদই তাঁকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সূচনালগ্নে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাভাষার অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নে অনমনীয় দৃঢ়তা ও বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে বাধ্য করেছিল। সে সময় বাংলাভাষাকে গণপরিষদের অন্যতম ভাষা করার দাবি অগ্রাহ্য হওয়ার সংবাদ ঢাকায় প্রকাশিত হওয়ামাত্র ছাত্র, রাজনীতিক ও শিক্ষিত মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। উর্দুর সপক্ষে খাজা নাজিমুদ্দীনের উক্তিকে তাঁরা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে বর্ণনা করেন। গণপরিষদের বাংলাভাষাবিরোধী সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ২৬শে ফেব্রুয়ারি ঢাকার ছাত্র- সম্প্রদায় ধর্মঘট পালন করে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ক্লাস বর্জন করে একটি মিছিল নিয়ে বাংলাভাষার সমর্থনে স্লোগান দিতে দিতে রাজপথ প্রদক্ষিণ করে। পরে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় খাজা নাজিমুদ্দীনের বক্তৃতার তীব্র প্রতিবাদ করে, বাংলাভাষাকে গণপরিষদের অন্যতম সরকারি ভাষা করার উদ্দেশ্যে একটি সংশোধনী প্রস্তাব আনার জন্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে অভিনন্দন জানানো হয়।

ঢাকায় পূর্ববাংলার ব্যবস্থাপক পরিষদের ওই অধিবেশনে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাভাষার সপক্ষে তাঁর তৎপরতা অব্যাহত রাখেন। এমন পরিষদে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হওয়ার পর পরই ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পরিষদ ভবনের বাইরে বিক্ষোভরত ছাত্রদের ওপর কোনো অত্যাচার হচ্ছে কি না সে সম্পর্কে জানতে চান। ২৭শে ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ আনন্দবাজার পত্রিকা ‘পাকিস্তানের গণতন্ত্র' শীর্ষক দীর্ঘ সম্পাদকীয় প্রকাশ করে, সেখান থেকে কিছুটা অংশ উদ্ধৃত করছি- ‘গণপরিষদের পরিচালনার বিধান যাঁহারা রচনা করিয়াছেন তাঁহারা বলেন যে পাকিস্তান গণপরিষদের আলোচনায় ইংরেজি বা উর্দু ছাড়া আর কোন ভাষা ব্যবহৃত হইতে পারিবে না। পূর্ববঙ্গের অন্যতম সদস্য শ্রীযুক্ত ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত যে সংশোধন প্রস্তাব উত্থাপন করিয়াছিলেন তাহা অখণ্ডনীয়। সমগ্র পাকিস্তানের ৬ কোটি ৯০ লক্ষ লোকের মধ্যে ৪ কোটি ৪০ লক্ষ লোকেরই ভাষা বাংলা। সুতরাং পাকিস্তানের গণ- পরিষদের আলোচনায় বাংলাকে স্থান দান তো করিতেই হইবে, বাংলাকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে স্বীকার করিয়া লওয়া উচিত।’

আমার এই দীর্ঘ উদ্ধৃতির জন্যে আপনাদের কাছে মার্জনা প্রার্থনা করে আপনাদেরই কাছে সবিনয় প্রশ্ন রাখতে চাই- আমার দাদু শহিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে রাষ্ট্র, শিক্ষা, সমাজ ও জীবনের সর্বক্ষেত্রে বাংলা প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তা আজ প্রতিষ্ঠিত সত্য, কিন্তু, সেই স্বাপ্নিক মানুষটার স্বীকৃতি কোথায়? প্রতি বছর ‘শহিদ দিবস’ আসে, যায়, বিদ্বজ্জনে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করেন, কিন্তু না, মনে পড়ে না, শহিদ ধীরেন দত্তের নাম মর্যাদাসহ উচ্চারিত হচ্ছে। ইচ্ছে করলেই তিনি দেশত্যাগ করতে পারতেন, কিন্তু দেশের মাটি ছিল তাঁর প্রাণের চেয়ে প্রিয়, তাই দেশকে অস্থি-মাংস-রক্ত ও সমগ্র অস্তিত্ব নৈবেদ্য দিয়ে তিন হারিয়ে গেলেন। হ্যাঁ, বাস্তব অর্থে তিনি হারিয়ে গেছেন, কিন্তু এই দেশের সত্যিকার ইতিহাস, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস রচিত হলে আমার দাদু শহিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে উপেক্ষা করা যাবে না, যেতে পারে না। সে ইতিহাস আজ হোক, কাল হোক রচিত হবেই; শত্রু ও স্বাধীনতাবিরোধীরা তা বন্ধ করার যত চেষ্টাই করুক। আজ আমি সগর্বেই বলব, স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম স্থপতি আমার দাদুও।

আমি পুনরায় উল্লেখ করছি, দাদুর প্রতি সচেতন উপেক্ষা দেখে আমার যে গভীর বেদনা ও ক্ষোভ, তা আমার স্মৃতিরই অংশ, কারণ সর্বক্ষেত্রে দেখি তাঁরই প্রস্তাবের প্রতিফলন, কিন্তু তিনিই অনুচ্চারিত। আমার এখন একটাই জানার বিষয়- কেন?

আমার দাদু শহিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার রামরাইল গ্রামে ১৮৮৬ সালের ২রা নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। কলকাতার রিপন কলেজ থেকে বিএ ও ল' পাস করেন।

১৯৭০-এ নির্বাচনের সময় গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে ঘুরে প্রচার কাজ করা ছাড়াও গভীর রাত জেগে, স্বাধীনতার সংগ্রামী নেতাদের কুমিল্লার বাড়িতে এনে পরামর্শ ও ড্রাফট করে দিয়ে গেছেন প্রাণ ভরে, করে গেছেন শুধু একটাই বিশ্বাসে বাংলাদেশেও রাষ্ট্রভাষা বাংলা হবে। বাংলাদেশ হয়েছে- রাষ্ট্রভাষা বাংলা হয়েছে- আমার দাদু শহিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সেই বাংলাদেশে ও বাংলাভাষার মধ্যেই বেঁচে থাকবেন। কারণ তাঁর জাতীয়তা ছিল একটাই- ‘বাঙালি’ এবং ধর্মও ছিল একটাই-‘বাঙালি’ !

আমার দাদু রক্ত দিয়ে তাঁর স্বপ্ন, তাঁর বিশ্বাস, তাঁর নীতি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। ইচ্ছে করলেই কি যুগ যুগ ধরে ভুলে থাকা যাবে? সবশেষে দাদুরই একটি স্মৃতিচারণের কথা এখানে উল্লেখ করি। বিষয়টি প্রাসঙ্গিক। বলেছিলেন দাদুঃ

প্রথম গণপরিষদ অধিবেশন শেষে করাচি থেকে ফিরলাম। অনুন্নত তেজগাঁও বিমানবন্দরে সিকিউরিটি বলতে কিছুই নেই। প্লেন থেকে নেমে দেখলাম, প্রায় চল্লিশ- পঞ্চাশ জন যুবক এক জায়গায় দাঁড়িয়ে। তাদের প্রত্যেকের গায়ে চাদর। আমার ধারণা হলো, গণপরিষদে বাংলার সপক্ষে কথা বলার দরুন এরা বিক্ষোভ জানাতে এসেছে, এদের চাদরের আড়ালে অস্ত্রও থাকতে পারে। সংশয় নিয়ে এগিয়ে গেলাম। যখন ওদের একেবারে নাগালের মধ্যে চলে গেছি তখন হঠাৎ প্রত্যেকে চাদরের তলা থেকে রাশি রাশি ফুল বের করে আমার ওপর বর্ষণ করতে লাগল। ওরা সবাই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।

আরমা দত্ত : শহিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নাতনি ও সংসদ সদস্য