হায় জিনিয়া, কী মর্মান্তিক! হায় শিক্ষক, কী লজ্জাকর!

হায় জিনিয়া, কী মর্মান্তিক! হায় শিক্ষক, কী লজ্জাকর!

উম্মে রায়হানা : : এতোদিন শুনে এসেছি, সাবেক প্রেমিক বা যৌন হয়রানি করা বখাটে এবং/অথবা ধর্ষণকারীরা মেয়েদের ব্ল্যাকমেইল করতে, ব্যর্থ প্রেমের বদলা নিতে অথবা ধর্ষণের শাস্তি এড়াতে ভিডিও ধারণ করে থাকে। কিন্তু কোনও শিক্ষক ছাত্রীদের ভিডিও ধারণ করে রাখছেন– এমন ঘটনা এই প্রথম শোনা গেলো। তাও আবার ধূমপানের মতো সামান্য অপরাধে। অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ধূমপান নিষিদ্ধ। এমনকি প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যও জনপরিসরে ধূমপান জরিমানাযোগ্য অপরাধ। স্কুলের শিক্ষার্থী স্কুল কম্পাউন্ডের ভেতরে ধূমপান করলে শিক্ষকের সর্বময় ক্ষমতা আছে তাঁদের শাসন করার। এ রকম ক্ষেত্রে সবচেয়ে উপযুক্ত শাসন হতে পারতো অভিভাবকদের ডেকে পাঠানো, তাঁদের সামনে বিচার-সালিশ যা কিছু করা সম্ভব। এমনকি টিসি দিতে চাইলেও অভিভাবকদের জানানো যেতো। তা না করে ভিডিও ধারণ করার মতো নিকৃষ্ট কাজ শিক্ষকেরা কী করে করলেন? শুধু তাই নয়; ছাত্রীদের নোংরা বাক্য বলে শেমিং করতেও ছাড়েন নি ওই শিক্ষকেরা। তাঁরা শিক্ষার্থীদের এতোটাই অপমান করেছেন যে, তিন ছাত্রী আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছিলো, তার মধ্যে কপালজোরে দু’জন বেঁচে গেলেও একজন মৃত্যুবরণ করেছেন।

যেসব মা-বাবা শিশুদের প্রথম স্কুলে ভর্তি করেন, তাদের অনেকেরই হয়তো একটি অভিজ্ঞতা হয়েছে। তা হচ্ছে, চার-পাঁচ বছরের শিশুরা মা-বাবা ও পরিবারের সদস্যদের চেয়েও বেশি মান্য করে স্কুলের শিক্ষকদের। অনেক সময় এমনও হয়, হোমওয়ার্ক করাতে গিয়ে কোনো বিভ্রান্তি হলে সন্তান মাকে বলে বসে, ‘আমার মিস বলেছে, এটা এ রকম; তুমি কিচ্ছু জানো না।’ শুধু পড়াশোনা নয়, কার্টুন কম দেখতে হবে, রোজ দুধ খেতে হবে– এসব কথাও মায়েরা শিক্ষকদের মুখ দিয়ে বলাতে চেষ্টা করেন, যাতে সন্তানরা মানে। শিক্ষকদের ওপর এই কর্তৃত্ব পরিবার ও সমাজ দিয়ে রেখেছে। বলা হয়, মা-বাবার পরই শিক্ষকের স্থান। এই যে সম্মান, তা কিন্তু একতরফা নয়। এর বিপরীতে শিক্ষকের দায়িত্বও অনেক। মা-বাবার কাছাকাছি; কোনো কোনো সময় আরও বেশি। শিক্ষকতা কোনো মামুলি চাকরি নয়। শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের জন্য আদর্শ হিসেবে আবির্ভূত। তাদের মেধাকে শান দেন, মননকে গড়ে তোলেন। কিন্তু আমরা প্রায়ই শিক্ষকদের দেখি নানা রকম দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ করতে। তেমনই এক ঘটনা ঘটেছে কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে।

খবরে প্রকাশ, গত সোমবার (৭ আগস্ট) কয়া ইউনিয়নের সুলতানপুর মাহ্তাবিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এক ছাত্রী জিনিয়া খাতুন (১৪) স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে স্কুলের ইউনিফর্ম পরা অবস্থায়ই গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে। জিনিয়া ছাড়া আরও দুই ছাত্রী একই দিনে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। কিন্তু স্থানীয়রা তাদের সময়মতো জীবিত উদ্ধার করতে সক্ষম হন। কী এমন ঘটেছিল সেদিন– এক স্কুলের তিন ছাত্রী একই দিনে এমন বিধ্বংসী সিদ্ধান্ত নিল? জানা গেছে, ওই দিন কয়েকজন ছাত্রী স্কুলের ছাদে উঠে ধূমপান করে। আয়া দেখতে পেয়ে শিক্ষকদের জানালে মশিউর রহমান লালটু এবং ওলিউর রহমান নামে দুই শিক্ষক ছাত্রীদের ডেকে এনে দুই ঘণ্টা কক্ষে আটকে রেখে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেন। তার চেয়েও ভয়াবহ, তারা ছাত্রীদের ভিডিও ধারণ করেন এবং ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেন।

এ ঘটনার পর জল গড়িয়েছে অনেক দূর। জিনিয়ার জানাজায় এসে স্কুলের প্রধান শিক্ষক লাঞ্ছিত হয়েছেন। অভিভাবক ও শিক্ষকরা পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি ও বিক্ষোভ করেছেন। মৃত শিক্ষার্থীর পরিবার ও সহপাঠীদের দাবি, সে ধূমপান করেইনি; শুধু ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল। জিনিয়া ধূমপান করেছে কি করেনি, সেই গবেষণার এখন আর কোনো মূল্য নেই। তার মৃত্যুর জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা করলে, এমনকি ওই দোষী শিক্ষকদের শাস্তি হলেও সে আর ফিরে আসবে না।

এর আগে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন ও ভিডিও ধারণের অপরাধে দেলোয়ার বলে একজনের সাজা হয়। এ মামলায় ধারণকৃত ভিডিও ন্যায়বিচারে সহায়ক হয়েছিল। কেননা, দেলোয়ার এর আগেও একাধিক ধর্ষণ করে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। তাকে পর্নোগ্রাফিবিষয়ক আইনে আটকানো হয়। কিন্তু এই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির পরও ভিডিও ধারণের প্রবণতা নির্যাতনকারীদের মধ্যে তো কমেইনি, বরং বেড়েছে। যৌন নিপীড়কদের কাছ থেকে ভিডিও ধারণের মোক্ষম অস্ত্র এখন শিক্ষকদের হাতে। কী লজ্জাকর!

মাত্র দিন দুই আগে আমাদের দেশে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট পাল্টে সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট প্রণীত হওয়ার কথা উঠেছে। নতুন এ আইনে জনগণের কোনো উপকার হবে বলে মনে করছেন না কেউই। এ আইন নানা দিক থেকেই জনবিরোধী বলে দেখা গেছে। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কুবরা এক বছরেরও বেশি সময় ধরে কাশিমপুর জেলে আটক। ফলে নতুন অ্যাক্ট জনবান্ধব হবে, সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হবে– এমনটা আশা করা যাচ্ছে না। কিন্তু আমার প্রশ্ন, যে আইন একটা ওয়েবিনার আয়োজন করার জন্য একজন শিক্ষার্থীকে ধরে জেলে পুরে রাখতে পারে, সেই আইন এসব ব্ল্যাকমেইলারের ক্ষেত্রে চোখ বন্ধ করে থাকে কী করে? কাউকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভিডিও ধারণ ও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি কি সাইবার ক্রাইম নয়? নাকি নারীর তথাকথিত পবিত্রতা রক্ষার অস্ত্র হিসেবে ভিডিও ধারণ জায়েজ! এতই জায়েজ যে শিক্ষার্থীর নৈতিক চরিত্র গঠনের কারিগর শিক্ষকের হাতেও এই অস্ত্র এবং অস্ত্রের নিশানা নারীর দিকেই– তা সে যত ছোট শিশুই হোক। লজ্জাকর ও মর্মান্তিক!

লেখক : উম্মে রায়হানা : গল্পকার