ডুবে গেছে সব একতলা ঘর। বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট নেই সুনামগঞ্জে।
নিজস্ব প্রতিবেদক, বাঙলা কাগজ; সিলেট : একটি জায়গা নেই সুনামগঞ্জে, যেখানে পানি প্রবেশ প্রবেশ করে নি। সবখানে পানি। একতলা কোনও ঘর আর বসবাসের উপযোগী নেই।
সবগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সবগুলো সরকারি অফিসকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেন এ তথ্য বাঙলা কাগজ ও ডনকে নিশ্চিত করেছেন।
শুক্রবার (১৭ জুন) সন্ধ্যায় তিনি বাঙলা কাগজ ও ডনকে বলেন, ‘বন্যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিদ্যুৎহীনতা। সারা জেলায় বিদ্যুৎ নেই। ইন্টারনেট নেই। দুই-একটি এলাকা ছাড়া বাকি জায়গায় মোবাইল নেটওয়ার্কও নেই। সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়ায় উদ্ধার তৎপরতাও ব্যাহত হচ্ছে।’
জেলা প্রশাসকের বক্তব্য থেকেই ধারণা মেলে সুনামগঞ্জের বর্তমান অবস্থা।
বৃহস্পতিবার রাতেই পানিতে তলিয়ে যায় সিলেট-সুনামগঞ্জ মহাসড়ক। এতে ওই রাতেই সড়ক পথে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে সুনামগঞ্জ।
শুক্রবার সকাল থেকে বিদ্যুতহীনতা, মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট না থাকায় সবদিক থেকেই এখন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে সুনামগঞ্জ।
শুক্রবার ফেসবুক স্ট্যাটাসে সিলেটের জ্যেষ্ঠ গণমাধ্যমকর্মী উজ্জ্বল মেহেদী লিখেন, সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন সুনামগঞ্জ। মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন থাকায়, কথা বলা বা দেখার সংযোগও বিচ্ছিন্ন। দুপুরের পর থেকে সিলেটের কিছু কিছু জায়গায় একই সমস্যা হচ্ছে। মূল কারণ বিদ্যুৎ না থাকা। সিলেটের কুমারগাঁও বিদ্যুৎ স্টেশনে পানি ঢুকছে, সিলেট নগরীর কিছু এলাকাও বিদ্যুৎ সঙ্কটে পড়েছে। জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহে যাতে কোনও বিপর্যয় না ঘটে, এজন্য বন্যা প্রতিরক্ষা বাঁধের মতো করে একাধিক বাঁধ দেওয়া হচ্ছে। গ্রিড লাইনে সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটলে কী দুরাবস্থা হয়, বিগত একটি অগ্নিকাণ্ডে টের পাওয়া গেছে। ভরসার খবর হলো, সেখানে আছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। বিদ্যুৎ স্টেশন সংশ্লিষ্টদের নিয়ে সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, জেলা প্রশাসক মজিবর রহমানও আছেন সেখানে। সেনাবাহিনীর সহায়তায় প্রতিরক্ষা বাঁধের কাজ চলছে সমন্বিতভাবে। এ কাজে যুক্ত হয়ে মেয়র বলেছেন, করণীয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা সচল রাখা। বন্যা থেকে কুমারগাঁওয়ের পাওয়ার স্টেশন রক্ষার চেষ্টা চলছে প্রাণপণ।
‘কুমারগাঁওয়ের অবস্থা নিয়ে নানা কথা গুজবের মতো করে ছড়াচ্ছে। সহনশীল ও দায়িত্বশীল হয়ে সবার সমান সতর্কতা প্রয়োজন। গুরুত্বপূর্ণ স্পট নিয়ে কোনও কিছু শুনে অন্যকে জানানোর ক্ষেত্রেও অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন দরকার। অতি উৎসাহ, আগ বাড়িয়ে নানা কথা বলা থেকে গুজব রটে। আমরা যেনো এসব কথা না-বলি, কেউ যদি বলেও আমরা যেনো না-শুনি। দুর্যোগে যদি গুজব রটে, তাহলে হুজুগে পরিস্থিতি হবে আরও ভয়াল।’
“‘কিছু কিছু সময় ‘নক্ষত্র নিয়ন্ত্রিত নিয়তি’ ভর করে। আমরা এই সময়ে পড়েছি। নিয়তি এখন প্রকৃতির দয়ায় বন্দি। নিরুপায় হয়ে আসমানকে বলছি, আর পানি ফেলো না! জমিনকে বলি, সব পানি শুষে নাও!’”
জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বন্যা আক্রান্ত সুনামগঞ্জ শহর, সদর, তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর, ছাতক ও জামালগঞ্জ উপজেলা। সুনামগঞ্জ শহরের একতলা সব বাসায়ই পানি। তলিয়ে গেছে বিভিন্ন উপজেলার সঙ্গে জেলা সদরের যোগাযোগের সড়কও। ফলে সুনামগঞ্জের একেকটি উপজেলা পরিণত হয়েছে বিচ্ছিন্ন দ্বীপে।
জেলার তেঘরি এলাকার বাসিন্দা রাজন মিয়া বাঙলা কাগজ ও ডনকে বলেন, ‘আমি ৫০ বছরেও এমন পানি কখনও দেখি নি। পানিতে আমাদের ঘরের বিছানাপত্রও তলিয়ে গেছে। এখন ত্রাণের চেয়ে আমাদের আশ্রয় জরুরি। নতুবা পানিতে তলিয়ে যেতে হবে।’
শহরের নতুনপাড়ার বাসিন্দা সুজক নন্দী বাঙলা কাগজ ও ডনকে বলেন, ‘বৃহস্পতিবারই আমাদের পাড়ার সব ঘরে পানি ঢুকে পড়ে। শুক্রবার ঘরের ভেতরেই কোমর পানি হয়ে গেছে। নৌকার অভাবে পরিবারের লোকজনকে আশ্রয়কেন্দ্রেও নেওয়া যাচ্ছে না।’
জেলার ছাতক উপজেলার খুমনা এলাকার বাসিন্দা সৈয়দ আনোয়ারুল হক বাঙলা কাগজ ও ডনকে বলেন, ‘বিদ্যুৎ না থাকায় দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। পুরো এলাকায় ভুতুড়ে পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে আছে সাপসহ বিভিন্ন পোকামাকড়ের ভয়।’
ঘরের গবাদিপশুকে নিয়ে সবচেয়ে সঙ্কটে পড়েছেন বলে জানান এই এলাকার বাসিন্দা আহাদ আহমদ। বলেন, ‘আমরা একটি আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছি। এখানে গরু রাখার মতো জায়গা নেই। ফলে গরুগুলো পানির মধ্যেই আছে।’
কী পরিমাণ মানুষ পানিবন্দি আছে, এমন কোনও তথ্য নেই জানিয়ে জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেন বাঙলা কাগজ ও ডনকে বলেন, ‘সব জায়গায় পানি। জেলার সব মানুষই পানিবন্দি। ফলে আলাদা করে এখন পানিবন্দি কতোজন, তা গুণে দেখা সম্ভব নয়।’
‘জেলার সরকারি-বেসরকারি সব ভবনই এখন আশ্রয়কেন্দ্র। ফলে আলাদাভাবে আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যাও বলা সম্ভব নয়।’
এদিকে শুক্রবার সিলেটে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করলেও সুনামগঞ্জে সেনাবাহিনী শনিবার (১৮ জুন) সকাল থেকে বন্যার্তদের উদ্ধারে কাজ করবে বলেই জানান জাহাঙ্গীর হোসেন।