মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বললেন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা দেবেশ চন্দ্র সান্যাল

মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বললেন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা দেবেশ চন্দ্র সান্যাল

উপ-সম্পাদকীয় মত, বাঙলার কাগজ : বীর মুক্তিযোদ্ধা। নামটি শুনলেই ভেসে উঠে সেই একাত্তরের চিত্র। যাঁরা একাত্তর চোখে দেখেন নি, তাঁরা গল্প-গান বা কবিতায় কিংবা চলচ্চিত্রে হলেও দেখেছেন সেই বর্বরতার চিত্র। আর সেই মহান মুক্তিযুদ্ধে সম্পর্কে জানেন না, এমন বাংলাদেশি নেই। বরং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই এখন আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চর্চা হয়।

মুক্তিযোদ্ধার জবানিতে মুক্তিযুদ্ধের কথা : আমি দেবেশ চন্দ্র সান্যাল। একজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা। সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার রতন কান্দি গ্রামের সন্তান আমি। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচনি প্রচারণাকারীদের কাছ থেকে জানতে পারি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ বিজয়ী হলে বাঙালিরা পাকিস্তানি অবাঙালি শাসনের নিপীড়ন আর বৈষম্যের শিকার হওয়া থেকে রক্ষা পাবে। দেশের সম্পদ দেশে থাকবে। দেশ ধর্ম নিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক নীতিতে পরিচালিত হবে। সব জেনে আমি আওয়ামী লীগ মনোনীত এমএনএ ও এমপিএ প্রার্থীদের নির্বাচনি প্রচারণায় দলের সঙ্গে কাজ করতে থাকি। এই সাধারণ নির্বাচনে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি গণপরিষদ (জাতীয় পরিষদ) পদের ১৬৭টিরই অধিকারী হয় আওয়ামী লীগ। ফলে আসে সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক শাসক বাঙালিদের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে না। পাকিস্তানি শাসকেরা বিভিন্ন ষড়যন্ত্র শুরু করে। সংসদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করে। এ প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ সারাদেশে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। পরে এক পর্যায়ে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু গর্জে ওঠেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা।’ ওই ভাষণে জাতিকে দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশনাগুলো চলে আসে। পরে ২৫ মার্চের কালোরাত্রিতে পাকিস্তানি বাহিনী ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামক নারকীয় গণহত্যা ও অন্যান্য মানবতা বিরোধী কর্মকাণ্ড শুরু করলে বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে (রাত ১২টা ২০ মিনিটে) বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। স্বাধীনতা ঘোষণার পর পর পাকিস্তানি হায়েনারা জাতির পিতাকে বন্দি করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। এক্ষেত্রে জাতির পিতার পূর্ব ঘোষিত আহ্বানে বাঙালিরা প্রতিরোধ যুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধ শুরু করে। সাধারণ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলাম ও অন্যান্য ইসলামী দলের মনোনীত পরাজিত প্রার্থী, তাদের সমর্থকেরা ও এ দেশের বিহারীরা পাকিস্তানি সৈন্যদের পক্ষ নেয়। ফলে অকুতোভয় হওয়া সত্ত্বেও বাঙালিদের পক্ষে বিজয় অর্জন কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। ‘এ দেশের কিছু কুলাঙ্গার সন্তান মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতা না করলে, পাকিস্তানের পক্ষ না নিলে, নিজ দেশের ভাইদের বিরুদ্ধে অস্ত্র না ধরলে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছাড়াই মুক্তিযোদ্ধারা বিজয় অর্জন করতে পারতো।’ সারাদেশের মতো আমার এলাকাতেও পাকিস্তানি বাহিনী এবং রাজাকারেরা গণহত্যা সংগঠিত করে। ডেমরা ও করঞ্জা গণহত্যায় আমি আমার সাতজন নিকট আত্মীয় হারাই। এরপর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিই। তখন আরও ২২ জনের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে ভারতে যাই। তখন আমি রতন কান্দি আদর্শ নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র ছিলাম। বয়সের কারণে মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুটমেন্ট দল আমাকে ভর্তি করতে চাইছিলো না। পরে সকলের অনুরোধে আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ পাই। প্রথমে ভারতে কামারপাড়া যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভর্তি হই। এরপর কামারপাড়া, কুড় মাইল, মালঞ্চ, প্রতিরামপুর ও শিলিগুড়ির পানিঘাটা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। আমার ভারতীয় প্রশিক্ষণ এফএফ নম্বর ৪৭৪২। আমি ৭ নম্বর সেক্টরের হেড কোয়ার্টার- ভারতের পশ্চিমবঙ্গের তরঙ্গপুর থেকে অস্ত্র নিয়ে একটি গ্রুপের সদস্য হিসেবে মানিকার চর, রৌমারী হয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আসি। ৭ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন লে. কর্নেল (অব.) কাজী নূরুজ্জামান। তাঁর গ্রুপের গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন এম এ মান্নান। আমার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের কারণে রাজাকারদের আলটিমেটামে জীবনের নিরাপত্তার জন্য গোটা পরিবারকেই বাড়িঘর সব ফেলে ভারতের আসামের মানিকার চর শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নিতে হয়েছিলো। গ্রুপের সঙ্গে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এসে আমি বিভিন্ন গেরিলা ও সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। আমার অংশগ্রহণ করা ভয়াবহ যুদ্ধগুলোর মধ্যে (১) বেলকুচি থানা আক্রমণ যুদ্ধ, (২) কালিয়া হরিপুর রেলওয়ে স্টেশন ব্রিজ সংলগ্ন রাজাকার ক্যাম্প অ্যাম্বুস, (৩) কল্যাণপুর যুদ্ধ ও (৪) শাহজাদপুর উপজেলার ধীতপুর নামক স্থানে পাকিস্তানি হানাদার ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধ অন্যতম। আমি যুদ্ধে ছিলাম এক অকুতোভয় দুঃসাহসী কিশোর। পরে আমি অসীম সাহসী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচিতি পাই। আমার নাম শুনলে পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকারেরা আঁতকে উঠতো। আমার অসম সাহসিকতার জন্য স্থানীয় লোকেরা আমাকে ‘বিচ্ছু বাহিনী’র নেতা বলে সম্বোধন করতো। যুদ্ধে আমার কোনও মৃত্যু ভয় ছিলো না। আমি ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনি দিয়ে পাকিস্তানি হায়েনা সৈন্য ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকারদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম।

জনাব দেবেশ চন্দ্র সান্যাল : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার।

ঠিকানা : বীর মুক্তিযোদ্ধা দেবেশ চন্দ্র সান্যাল, পিতা : দ্বিজেন্দ্র নাথ সান্যাল, মাতা : নিলীমা রানী সান্যাল, গ্রাম ও ডাকঘর : রতন কান্দি, ইউনিয়ন : হাবিবুল্লাহনগর, উপজেলা : শাহজাদপুর, জেলা : সিরাজগঞ্জ। গেজেট নং-বে-সামরিক সিরাজগঞ্জ- ১৬৭৯। ভারতীয় প্রশিক্ষণ- এফএফ নং- ৪৭৪২। সমন্বিত তালিকা জেলাভিত্তিক- ১৬১১, উপজেলা ভিত্তিক- ১৫১, ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম নং- ০১৮৮০০০১৪১১।