মৎস্য সপ্তাহের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী : যারা নাই নাই, গেলো গেলো, হায় হায় করে, তারা তা করতেই থাকবে।

মৎস্য সপ্তাহের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী : যারা নাই নাই, গেলো গেলো, হায় হায় করে, তারা তা করতেই থাকবে।

বাসস : প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘যারা নাই নাই, গেলো গেলো, হায় হায় করে বেড়াচ্ছে, সেই হায় হায় পার্টি হায় হায় করতেই থাকুক। মাঝে মাঝে তাদেরও তো একটু বলতে দিতে হবে। আর আমরা আমাদের কাজ করে যাই। দেশ এগিয়ে যাক এবং বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। তাদের কিছু মানুষ তা সব সময় করতেই থাকবে।’

প্রধানমন্ত্রী আজ রোববার (২৪ জুলাই) সকালে ‘জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ-২০২২’ উদ্‌যাপন এবং ‘জাতীয় মৎস্য পদক-২০২২’ প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন।

তিনি গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের মূল অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন।

‘নিরাপদ মাছে ভরবো দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিপাদ্য নিয়ে মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সারাদেশে ২৩ জুলাই থেকে আগামী ২৯ জুলাই পর্যন্ত জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ পালিত হচ্ছে। 

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘“জনগণের ওপর আমাদের ভারসা আছে, জনগণ আমাদের পাশে আছে। আর জাতির পিতাই তো বলে গেছেন, “বাংলাদেশকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না,” কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না।”’

প্রধানমন্ত্রী মৎস্য সপ্তাহের অনুষ্ঠানে স্থানীয় চাহিদা মেটাতে এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের জন্য রপ্তানি পণ্য বাড়াতে যাঁর যাঁর জলাধার রয়েছে, তাঁকে মাছ চাষের আওতায় আনার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান।

তিনি বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি যে, আমাদের মাছের কোনও অভাব হবে না এবং নতুন রপ্তানি আইটেম যুক্ত করতেও সক্ষম হবো। যাঁর যাঁর জলাধার আছে, তাঁরা যেনো সেই জলাধারকে মাছ চাষের আওতায় আনার ব্যাপারে বিশেষ মনোযোগ দেন।’

হাওর অঞ্চলে মৎস্য উৎপাদনের বিশাল সম্ভাবনার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘শুধু হাওর না, বাওর, খাল, বিল, বিভিন্ন জলাধার এতো জায়গা আমাদের। আমার তো মনে হয় যাঁর যেখানে এই ধরনের জলাধার আছে, তাঁরা যদি এই মৎস্য উৎপাদন করার দিকে একটু নজর দেন, শুধু মাছও না মাছের সঙ্গে কাঁকড়া, শামুক, ঝিনুক সব কিছুই চাষ করা যায়।

তিনি বলেন, ‘কাজেই সেগুলো করতে পারলে আমাদের নিজেদের কোনও অভাব থাকবে না। রপ্তানি ক্ষেত্রে আমরা নতুন নতুন পণ্য দিতে পারবো।’

তিনি সারাদেশে ১ শটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে খাদ্য ও মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প স্থাপনের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন এবং তরুণ প্রজন্মকে এ লক্ষ্যে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। এর ফলে স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানিপণ্যের সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পাশাপাশি কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হবে।

কোভিড-১৯ এর পরবর্তীতে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ এবং রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা, এসবের ফলে বিশ্ব মন্দার পরিস্থিতি বিবেচনা না করেও যাঁরা ঢালাও সমালোচনা করেন এবং বাংলাদেশকে অচিরেই শ্রীলঙ্কার কাতারে এনে দাঁড় করাতে চান, তাঁদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী।

সরকারপ্রধান বলেন, পদ্মা সেতুতে বাধা দিয়েছিলো, সেই বাধা অতিক্রম করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করে বিশ্বকে আমরা এই বার্তাটা পৌঁছে দিয়েছি যে, বাংলাদেশ পারে, আমরা পারি।

প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক মৎস্য খাতে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২১ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মাঝে জাতীয় মৎস্য পদক-২০২২ প্রদান করেন। মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খন্দকার মাহবুবুল হক পুরস্কার পর্বটি সঞ্চালনা করেন।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো. ইয়ামিন চৌধুরী স্বাগত বক্তব্য দেন।

‘জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ-২০২২’ উদ্‌যাপন উপলক্ষে গণভবন লেকে মাছের পোনা অবমুক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী।

অনুষ্ঠানে মৎস্য খাতে দেশের উন্নয়ন বিষয়ক একটি তথ্যচিত্রও প্রদর্শিত হয়। 

এ ছাড়া কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র সংলগ্ন মাঠে ৩ দিনব্যাপী কেন্দ্রীয় মৎস্য মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

মাছের অভয়ারণ্য তৈরির দিকে নজর দেওয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী মৎস্য খাতে গবেষণা বাড়ানোর ওপরও গুরুত্বারোপ করেন।

তিনি বলেন, তাঁর সরকারের বিভিন্ন গবেষণালব্ধ উদ্যোগের ফলে বিলুপ্ত প্রজাতির অনেক মাছকে আবার জলাশয়ে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে এবং মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পেরেছি। আমাদের যে চাহিদা, সে চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি মাছ এখন উৎপাদন করতে পারি।

তিনি বলেন, সবচেয়ে নিরাপদ পুষ্টি পাওয়া যায় মাছ থেকে। যেটা মাংস থেকে হয় না। মাছের যে আবাসস্থল অর্থাৎ অভয়ারণ্য তৈরি করা- এগুলোর দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। পানির প্রবাহ ভালো থাকা, পানি যাতে দূষণ না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী কক্সবাজার এবং কুয়াকাটাসহ সমুদ্র এলকায় চিংড়ি চাষে হ্যাচারি শিল্প গড়ে তোলার গুরুত্বারোপ করে বলেন, নেট দিয়ে চিংড়ির পোনা আহরণে অনেক প্রজাতির মাছ নষ্ট হয়। কাজেই সেগুলো বন্ধ করতে হবে এবং সেখানে হ্যাচারি শিল্প গড়ে তুলতে হবে। স্বাস্থ্যসম্মত চিংড়ি পোনা দেশব্যাপী সরবরাহের ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথাও উল্লেখ করেন তিনি। 

এ সময় বাংলাদেশের প্রকৃতি এবং পরিবেশ যে কোনও ধরনের উৎপাদন অনুকূল বলেও তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন এবং সেটা সকলকে কাজে লাগানোরও আহ্বান জানান।

তাঁর সরকার পদ্মা সেতু করেছে এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় সবগুলো নদীর ওপর ব্রিজ তৈরি করে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করেছে। কাজেই দক্ষিণাঞ্চলের আরও বেশি মৎস্য চাষের উদ্যোগ নেওয়া দরকার। এ ব্যাপারে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় আরও বেশি উদ্যোগ গ্রহণ করবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

‘খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে সরকার জনগণের পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিশেষ দৃষ্টি দিচ্ছে’ উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, পুষ্টি আসবে মাছ, ডিম, দুধ ও মাংস থেকে। শুধু আমরা নিজেরাই চাহিদা মেটাবো না, আমরা এগুলো প্রক্রিয়াজাত করে বিদেশেও পাঠাতে পারবো।

মাছের নানা বৈচিত্র্যের কথা উল্লেখ করে সেটা শুধু প্রক্রিয়াজাত করে দিলে দেশের মানুষই নয়, প্রবাসীরাও নিজের দেশের মাছ গ্রহণ করতে পারবেন বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ‘মাছে ভাতে বাঙালি’ এবং এই মাছে ভাতে বাঙালি হিসেবেই যেনো আমরা থাকতে পারি।

তিনি বলেন, মাছ প্রক্রিয়াজাত করে অক্ষত রেখে এর কাঁটা নরম করে ফেলে খাওয়ার উপযোগী করা যায় এবং এটা খুব বেশি কঠিন কাজ নয়। ঘরে ঘরেও এই পদক্ষেপ নেওয়া যায়। 

এ প্রসঙ্গে তিনি প্রেসার কুকারে একটু বেশিক্ষণ মাছ সিদ্ধ করলেও এর কাঁটা নরম হয়ে যায় এবং বাচ্চাদেরকেও খাওয়ানো যায় বলেও উল্লেখ করেন। নিজের পরিবারেও প্রধানমন্ত্রী এ রকম করেন বলে একটু রান্নার রেসিপিও দিয়ে দেন।

সরকারপ্রধান আরও বলেন, আমরা এ ধরনের ইন্ডাস্ট্রি যদি তৈরি করি এবং প্রেসার দিয়ে মাছ অক্ষত রেখে এর কাঁটা নরম করে যদি একে টিনজাত করতে পারি, প্রক্রিয়াজাত করে দেশে বিদেশে রপ্তানি করতে পারি, পৃথিবীর বহুদেশ এই মাছ আমাদের দেশ থেকে আমদানি করবে। অথবা মাছের তৈরি বিভিন্ন পণ্য আমরা রপ্তানি করতে পারবো।

তিনি বলেন, আমি মনে করি, এক্ষেত্রে আমাদের তরুণ প্রজন্ম আরও এগিয়ে আসবে। এতে করে তাঁদের কর্মসংস্থান যেমন হবে এবং দেশের বেকারত্ব দূর হবে। আর সেইসঙ্গে দেশও রপ্তানিযোগ্য পণ্য পাবে এবং দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদাও মিটবে। সেভাবেই দেশকে আমরা আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবো বলে বিশ্বাস করি।

এই মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণে আরও বেশি সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের সমুদ্রসীমা থেকে আহরণযোগ্য ‘সী উড’ (সমুদ্রের তলদেশীয় জলজ উদ্ভিদ) একটি মূল্যবান সম্পদ। এটা আমরা যতো বেশি উৎপাদন করতে পারবো, ততো বেশি বিদেশেও রপ্তানি করতে পারবো। এবং দেশেও এটার চাহিদা বাড়ছে। সেইসঙ্গে শামুক ও ঝিনুক চাষের ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটাও একটি বড় রপ্তানি পণ্য হবার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে। কাজেই এদিকে একটু গুরুত্ব দেবেন।

শেখ হাসিনা বলেন, এক সময় আমাদের মেঘনা নদীতে পিংক পার্ল (মুক্তা) হতো। সেটাও আমরা গবেষণা করছি। কিন্তু সেটাতে খুব বেশি সাফল্য আসছে না। সে দিকটাতে আরেকটু নজর দেওয়া দরকার। যদিও আমাদের খুব বড় সাইজের (মুক্তা) আসে না, আমাদের ঝিনুক অনেক ছোট। কিন্তু আমাদের রাইস পার্ল যেটা- এটারও কিন্তু অনেক মূল্য আছে। এটা আমাদের খুব ভালো একটা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে। কাজেই সেদিকেও একটু দৃষ্টি দেবেন।